প্রতাপশালী চৌহান শাসন……..।।।৫

#আমি_অদৃশ্য_৫

পান্না রায় তারঁ জীবনের শ্রেষ্ঠ দুটি চিত্র এঁকেছিলেন। এক পৃথ্বীর ,অপরটি হল সংযুক্তার। কনৌজ ত্যাগের পূর্বে শেষ বারের জন্য পান্না রায় সাক্ষাৎ করলেন রাজকুমারীর সঙ্গে। রাজকুমারী তখন প্রেমে, বিরহের আগুনে জ্বলছেন নিজ গৃহের গবক্ষের নিকট বসে।

পান্না রায় নিজের লৌহ পেটিকা থেকে বস্ত্রখণ্ডে আচ্ছাদিত একটি তৈলচিত্র উন্মোচিত করে পরম যত্নে চিত্রের উপর থেকে বস্ত্রটি সরিয়ে সেটি মেলে ধরলেন রাজকুমারী সংযুক্তার সম্মুখে।

চিত্রটির পানে দৃষ্টিপাত করবার পর মুহূর্তেই মধ্যেই যেন কোন অজানা জগতে হারিয়ে গেলেন রাজকুমারী। এক অজানা আকর্ষণে তিনি নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে রইলেন ছবিটির দিকে।

এই নতুন চিত্রটিতে রাজকুমারী সংযোগিতাকে স্বর্ণালঙ্কার আভূষণ সহকারে নীল বর্ণের কাঁচুলি আর বস্ত্র পরিহিতা অবস্থায় দুহস্তে একটি স্বর্ণপাত্র ধরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছিল।

পাত্রটির উপর একটি পূর্ণ অবয়বের অর্ধ প্রস্ফুটিত রক্তিম বর্ণের কমনীয় গোলাপ পুষ্প শোভিত হচ্ছিল। চিত্রটিতে রাজকুমারীকে এই ধরাধামের কোন সাধারণ নারী নয় বরং স্বয়ং দেবলোকের অপ্সরাদের ন্যায় অসামান্য রূপবতী বলে বোধ হচ্ছিল আর গোলাপ পুষ্পটিকেও কোন সাধারণ পুষ্প নয় বরং একটি প্রণয় পুষ্পের ন্যায় ভ্রমিত হচ্ছিল।

“চিত্রটি আপনার পছন্দ হয়েছে মাননীয়া রাজকুমারী ?”

“অসাধারণ আপনার এই চিত্র। কে এই চিত্রে অঙ্কিত নারী ? আমি প্রত্যহ  দর্পণের কাঁচে নিজের প্রতিচ্ছবি দর্শন করি। কিন্তু আমার নিজেকে কখনই আপনার চিত্রে অঙ্কিত রমণীর ন্যায় রূপবতী বলে মনে হয়নি।”

“রাজকুমারী আমি একজন শিল্পী। আর একজন লেখক যেমন সত্য ঘটনাকে নিজের কলমের সহায়তায় ফুটিয়ে তোলে তেমনি একজন শিল্পী হিসাবে সত্যকে নিজের রং-তুলিকার মাধ্যামে ফুটিয়ে তোলাই আমার একমাত্র কর্ম। যাত্রার পূর্বে আপনি কি দিল্লিশ্বর সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহানের উদ্দেশ্যে আপনার একান্ত ব্যক্তিগত কোন বার্তা প্রেরণ করতে ইচ্ছুক ?”

রাজকুমারী উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “অবশ্যই প্রবলভাবে ইচ্ছুক।  কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোন বার্তা প্রেরণ করবো।”

এই পর্যন্ত বলে কিছুক্ষণ নিরব থেকে আচমকা রাজকুমারী সংযোগিতা নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মুখে পান্না রায়ের পেটিকায় রাখা তুলিটি তুলে নিয়ে সযত্নে সেটিতে রং মিশ্রিত করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন নিজের চিত্রটির দিকে। তারপর নিজ চিত্রটির উপর সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখলেন, হে মহান দিল্লিশ্বর, বীরবালা সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহান কনৌজের রাজকুমারী সংযোগিতার পক্ষ থেকে এই ক্ষুদ্র উপহার গ্রহণ করুন।”

এরপর পান্না রায় কনৌজের রাজপুরী ত্যাগ করে অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে দিল্লির উদ্ধেশ্যে ধাবিত হলেন।

দিল্লির প্রাসাদে তখন নিজের বার্ষিক শিকার অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পৃথ্বী। ঠিক এহেন সময় আমি দ্রুতপদে এসে উপস্থিত হমাল তাঁর গৃহে।

পান্না রাজ্যে ফিরেছে। এ সংবাদ আমি প্রভাতেই পেয়েছিলাম। পৃথ্বী কে জানানোর আশু প্রোয়জন ছিল। আমি দ্রুত পদে তার নিকট উপস্থিত হলাম। হাফাতে দেখে পৃথ্বীরাজ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে নিজের বামপ্রান্তের কটিদেশের তরবারির কোষ স্পর্শ করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, “কি হয়েছে মিত্র চাঁদ ? এতো হাফাচ্ছ কেন ? সীমান্তের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে কি আবার ঝঞ্ঝাবতের ন্যায় যবন দস্যু হানাদারদের আগমন হয়েছে ?”

আমি নিজেকে কিছু সময় সামলে নিলাম, “আজ্ঞে না মিত্র।  দীর্ঘ তিনমাস কনৌজবাসের পর দিল্লির রাজপ্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করেছেন শিল্পী পান্না রায়। সেইসাথে উনি কনৌজের রাজনন্দিনীর সমন্ধে অনেক অজানা সংবাদ এনেছেন।”

“তাহলে আজকের মতো শিকার যাত্রা স্থগিত। দ্রুত পান্না রায়কে আমার মন্ত্রণা কক্ষে নিয়ে এসো।”

আমার নির্দেশ অনুযায়ী শিল্পী পান্না রায় একাকি প্রবেশ করলেন মহারাজ পৃথ্বীর মন্ত্রণা কক্ষে। কক্ষের অভ্যন্তরে পৃথ্বীরাজ তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন শিল্পীর আগমনের। পান্না রায় কক্ষে প্রবেশ করে যুক্তকর হস্তে মাথানত করে বিনয়ী কণ্ঠে বললেন, “দিল্লিশ্বর মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানের জয়”।

পৃথ্বীরাজ উৎসুক কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, “বলুন শিল্পী, কনৌজ থেকে কি সংবাদ আনলেন ?”

পান্না রায় ধীরভাবে বললেন, “মহারাজ কনৌজ অধিপতি জয়চন্দ্র এবং তাঁর সভাসদরা দিল্লির উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং মহারাজ জয়চাঁদ নিজে আপনার অভূতপূর্ব বীরত্ব, পরাক্রম আর অগ্রগতির প্রতি তীব্র ঈর্ষাপূর্ণ।”

পৃথ্বীরাজ কিছুটা অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠলেন, ” আপনি আমাকে বলুন, কনৌজের রাজকুমারীর সাথে আপনার সাক্ষাৎপর্ব হয়েছে কি ? দিল্লির প্রতি তাঁর মনোভাব কেমন ?”

ক্রমশঃ……

তথ্যঃ

Cynthia Talbot (2015). The Last Hindu Emperor: Prithviraj Cauhan and the Indian Past, 1200–2000