১)
পাহাড়ে একটি মৃত্যু বা একটি ধর্ষণ নিয়ে যখন আমরা প্রতিবাদ করি তখন সেখানকার সেটেলার এবং সেই সাথে সমতলের কিছু বাঙালীর কাছ থেকে কিছু বার্তা পাই। এইসব বার্তার কিছু তো থাকে গালাগালি ইত্যাদি। সেগুলির কথা বাদ দেন। কিছু লোকজন আবার প্রশ্ন করে একই ধরনের অপরাধ তো সমতলেও হয়। সমতলেও ধর্ষণ হয়, সমতলেও হত্যাকাণ্ড হয়। একজন চাকমা মারমা বা ত্রিপুরা বা অন্য কোন আদিবাসীর ক্ষেত্রে কেন আমরা একটু বেশী সোচ্চার হই। অনেকে ঠাট্টা করে বলে, চাকমাদের প্রতি আপনার এত প্রেম কেন?
দেখেন, বিষয়টা চাকমাদের প্রতি প্রেম বা আদিবাসীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা সেটেলারদের প্রতি শত্রুতা নয়। পাহাড়ে যখন অন্যায় হয় সেটি কেবল একটি সাধারণ অপরাধ থাকে না। সেটি হয়ে যায় জাতিগত নির্যাতন। একদল সেটেলার যখন একটি আদিবাসী শিশুকে গনঅত্যাচার করে, সেটি সমতলের একটি অপরাধের তুলনায় দ্বিগুণ ঘৃণ্য। কেননা এখানে শুধু যে একটি নারীর প্রতি অন্যায়টা হচ্ছে সেটাই কেবল না, এই অপরাধটি কোন না কোনভাবে একটি জাতিগত নির্যাতন হিসাবে দেখা হবে। এই কারণেই পাহাড়ের অত্যাচারটির প্রতিবাদ করা বেশী জরুরী।
আমি নিজে একজন বাঙালী এবং আমি আমার বাঙালী পরিচয় নিয়ে অহংকার করতে চাই। আমি চাই না আমার জাতি অর্থাৎ বাঙালী জাতি একটি নির্যাতক জাতি হিসাবে পৃথিবীর অন্যান্য সব মানুষের কাছে ঘৃণ্য হোক। উদাহরণ তো আমাদের নিজেদেরই আছে। পাকিস্তানকে একটি জাতি হিসাবে আমরা কেন ঘৃণা করি? কারণ ওরা আমাদের বাঙালী পরিচয়ের জন্যে আমাদের উপর নির্যাতন করেছে। এমন যদি হতো যে পাকিস্তানের সরকার মা’দেরকে নির্যাতন করছে কিন্তু সেখানকার নাগরিকরা আমাদের হয়ে প্রতিবাদ করছে, তাইলে কিন্তু পাকিস্তানীদের প্রতি আমাদের ঘৃণা এরকম তীব্র হতো না। কিন্তু ১৯৭১ হাতে গোনা কয়েকজন বামপন্থী ছাড়া পাকিস্তানের কোন মানুষ আমাদের পক্ষে কোন কথা বলেননি।
আমি চাইনা পৃথিবীর কোথাও গিয়ে আমার সন্তানকে তার বাঙালী পরিচয় নিয়ে লজ্জিত হতে হোক। আমি মরে যাওয়ার পরও দশ বিশ বা ত্রিশ বছর পর পৃথিবীর কোন কোনায় কোন মানুষ যদি আমার মেয়েকে বলে, তোমরা বাঙালীরা তো সংখ্যায় কম পেয়ে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীকে নির্যাতন করেছ, সেদিন যেন আমার মেয়ে মাথা উঁচু করে বলতে পারে যে, না, আমরা পাহাড়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমতলের মানুষরা একসাথে অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছি।
(২)
সমতলের বাঙালী বন্ধুরা, আপনাদেরকে বলি, জাতির মাথায় এই যে কলঙ্কটা ওরা চাপিয়ে দিচ্ছে দিনের পর দিন মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর, এটা প্রতিবাদ করবেন না? আপনি কি চান আপনার প্রাণপ্রিয় এই দেশের মানুষ, আপনার প্রাণপ্রিয় বাঙালী পরিচয় পাকিস্তানীদের মতোই সারা বিশ্বে একটি ঘৃণ্য তস্কর জাতি হিসাবে পরিচিত হোক? প্লিজ প্রতিবাদ করেন। নিজের স্বার্থেই করেন।
আজকে দেখেন কি হয়েছে। খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর পাড়ার ওখানে একটা ছোট্ট মিছিল বের করেছে হিল উইম্যান ফেডারেশনের মেয়েরা। কেন এই মিছিল? কল্পনা চাকমার অপহরণ মামলার বিচারের একটি পদক্ষেপ নিয়ে এই মিছিল। খুব বেশী লোকজন যে ছিল তা নয়। পুলিশ আর বিজিবি মিলে একটা বিশাল যৌথ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই মিছিলে। বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এ যেন হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিষ্পাপ মেশশাবকদের পালে। কোনপ্রকার বাছবিচার ছাড়া মেয়েদেরকে বেদম মারধোর করছে ব্যাটাছেলে পুলিশ আর বিজিবির দল। সামান্য সৌজন্য, সামান্য সম্মান, সামান্য সহানুভূতি কিছুই ওরা দেখানোর দরকার মনে করেনি।
মারধর করে মিছিল ভেঙে দিয়েছে। মিছিল থেকে নেত্রীবৃন্দকে গ্রেফতার করেছে। মিছিলে আশেপাশে যেখানে যাকে পেয়েছে তাঁকে মারধোর করেছে। বাড়ীতে বাড়ীতে ঢুকে তছনছ করেছে। জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। কেন? কেন ওরা একটা মিছিল করতে গেল!
একটা ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করেছেন অনেকে, দেখেন। দেখেই বুঝা যায় স্কুল কলেজে পরে মেয়েগুলি। ওদেরকে কিভাবে পিটাচ্ছে পুলিশ। আরে, ওরা যদি কোন অপরাধও করে, তবুও তো একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে একটু দ্বিধা করার কথা, নাকি? আপনি ছোট কয়েক সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখেন, কিভাবে মেয়েগুলিকে মারছে। ওদের কাপড় ধরে টানাটানি করছে, গায়ে হাত দিচ্ছে। এরা আমদের মেয়ে না?
কেন ভাই? একটা মিছিল করতে পারবে না আমদের মেয়েরা? দাবী ন্যায্য কি অন্যায্য সেই কথা পরে। একটা মিছিল করতে পারবে না? এরা কি আমাদের দেশের নাগরিক না? এরা কি এই দেশে জন্ম নেয়নাই? সংবিধানে যে ফ্রিডম অফ এসেম্বলি অ্যান্ড এসোসিয়েশনের কথা লিখে রেখেছেন, সেটা কি ওদের জন্যে প্রযোজ্য না? কেন? আমাকে বলেন, পুলিশ মেয়েগুলিকে কেন মারবে? কেন মারবে? কি করেছে ওরা? একটা মিছিল করতে পারবে না? এইটা কিরকম বিচার?
(৩)
আর এই ঘটনা তো নতুন কিছু না। এটা চলছে সেই কবে থেকে। আপনারা এইখানে এই ঢাকা শহরে বসে টের পাননা। একটা আদিবাসী ছেলে বা মেয়ে জন্মের পর থেকেই জানতে বাধ্য হয় যে সে একজন বাঙালীর সমান না। একটা আদিবাসী শিশু বুদ্ধি হবার পর থেকেই জানে সামান্য একটা পুলিশের সিপাই বা আর্মির জওয়ান একজন কলেজ ছাত্রকে তুই তোকারি করে কথা বলতে পারে। নিজেকে কল্পনা করেন তো সেই অবস্থায়? সেটেলারদের কথা আর বললাম না। এরা একটা মিছিলও করতে পারবে না?
আজকের এই মিছিল থেকে আমি জেনেছি যে পঁচিশজন ছেলেমেয়েকে গ্রেফতার করেছে। হিল উইম্যান ফেডারেশনের নেত্রী এন্টি চাকমা আর সুমিতা ত্রিপুরাকে ভয়ংকর মারধোর করেছে, মেরে তারপর ধরে নিয়ে গেছে। এছাড়া যারা গ্রেফতার হয়েছে এদের মধ্যে রুপা চাকমা, কেটি চাকমা, বিশাখা চাকমা, সোনালী চাকমা, মেকিনা চাকমা, জনতা চাকমা, রুমিতা ত্রিপুরা এদের নাম জেনেছি। বাকিদের নাম জানা যায়নি।
এই যে আজকে ঘটনাটা ঘটলো, এটাকে আপনি জাতিগত অত্যাচার বলবেন না তো কি বলবেন? আমার পাহাড়ি মেয়েটির ওড়না ধরে টান দিতে একটা বাঙালী পুলিশ একটা মুহূর্তও দ্বিধা করে না। আমার পাহাড়ি মেয়েটিকে ঘুষি মারতে একটি বাঙালী পুলিশ একটুও অপরাধবোধে ভোগে না। কেন? আমার রাষ্ট্র ওর আর্মি ওর পুলিশকে নিয়োগ করেছে আদিবাসীদেরকে দমন করে রাখতে হবে। এটাকে আপনি জাতিগত অত্যাচার বলবেন না তো কি বলবেন?
এইসবের fঅলে কি হচ্ছে জানেন? পাহাড়ের একটি আদিবাসী ছেলে বা মেয়ে যদি গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিবাদ করতে না পারে তাইলে সে কি করবে? আপনি কতিদিন ওকে দমন করে রাখবেন। মানুষকে মেরে ফেলা যায়, কিন্তু মানুষের অধিকার দমন করে শান্তিতে থাকা যায় না। মানুষকে দমন করা যায়না- একদিন দেখবেন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ওরা প্রতিরোধ করবে। প্রতিরোধ করতে গিয়ে মরে যাবে- কিন্তু প্রতিরোধ ঠিকই করবে।
একটি চাকমা ছেলে বলছে, “বালর আমা জাত তু এদক হি দুজ গুজ্জি দে??? অত্যাচার, নিযার্তন বেক আমার সহ্য গরা পরেদে।।।” এই প্রশ্নটি আমি আপনাকে ভাবানুবাদ করে দিই ‘আমার জাতিটি কি এমন দোষ করেছে যে সব অত্যাচার নির্যাতনই আমাদেরকে সহ্য করতে হচ্ছে?’ আপনি জবাব দিন।
(৪)
বাঙালী ভাই বোন বন্ধুরা, আপনি এই পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চান? একটি অত্যাচারী জাতির সদস্য হয়ে বাঁচতে চান? আমি চাই না। এইজন্যে আমি বলেই যাবো। পাহাড়ে আমাদের আদিবাসীদের সাথে যে আচরণ করা হয় সেটা অন্যায়। আজকে এই যে মেয়েদের মিছিলটিতে হামলা করলো পুলিশ, এটা অন্যায়। এর বিচার করতে হবে। দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। নাইলে এর মূল্য আমাদেরকে দিতে হবে। অনেক বড় মূল্য- আজকে না হয় কাল, নাহয় পরশু।
যে পুলিশটি আমার আদিবাসী মেয়েটির ওড়না টেনে ধরেছে, সে আমার ভাই না। যে বাঙালী পুলিশটি আমার আদিবাসী বোনটির গায়ে হাত তুলেছে, সে আমার জাতের কেউ না।
© Imtiaz Mahmood