যাঁরা বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসটা পড়েছেন, তাঁরা জানবেন যে, পাঠান সেনাপতি কতলু খানের মেয়ে আয়েষা রাজপুত জগত সিংহের প্রেমে পড়েছিলেন। একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান নারীর হিন্দু রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে পাঠান সেনাপতি ওসমানকে অস্বীকার করার কাহিনীটা একমাত্র সত্য ধারণের গর্বে গর্বিত সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজিকে এতটা যন্ত্রণাকাতর ও ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল, যে তিনি দুর্গেশনন্দিনীর বিপরীতে রায়নন্দিনী রচনা করে দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে আহমদ ছফার উক্তি ছিল, “বঙ্কিমের শিল্পচাতুর্য ও জীবনদৃষ্টি সিরাজী কোথায় পাবেন? উপন্যাস হিসেবে রায়নন্দিনী কোন পর্যায়েই পড়েনা, কিন্তু তাঁর প্রতিবাদটি খুবই প্রাসঙ্গিক।”
শেষ কথাটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ! বঙ্কিমের মতো অমিত প্রতিভাধর সাহিত্য সম্রাটের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ ও পিছিয়ে পড়া সমাজ (আহমদ ছফার ভাষায়) থেকে উঠে যে প্রতিবাদের নজির রেখেছেন সিরাজী (তা যতই অশোধিত হোক না কেন) তার সাহিত্য গুণ যাই হোক না কেন, তা নিঃসন্দেহে স্বাভিমান আর কৌম (মুসলিম সমাজ) চেতনার একটি সাহসী বহিঃপ্রকাশ ছিল। এই বিষয়টা কখনোই বুঝতে চায়নি হিন্দুদের ঘাড়ে চেপে বসা শেকড়চ্যুত, শিশ্নোদরপরায়ণ ইতর বৃত্তি করে চলা হিন্দু বাম ও হিন্দু লিবারেলরা!
তাই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ও ক্ষমতা দুইই হারিয়েছেন হিন্দুরা, হোক না সেটা শারীরিক, বৌদ্ধিক বা সাংস্কৃতিক। জি বাংলার অনেক সিরিয়ালেই দেখি নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ও বেমানানভাবে মুসলিম ক্যারেক্টার ঢোকানো হচ্ছে, হিন্দু মেয়ের সাথে মুসলিম ছেলের একটা প্রেম সম্পর্ক দেখানো হচ্ছে, তাও আবার মেয়ের মা বাবার জ্ঞাত সারেই! এগুলো করা হচ্ছে মুসলিমদের সাথে একপেশে সম্পর্ক স্থাপনে হিন্দুদের ধীরে ধীরে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলার জন্য! নইলে, আতস কাচ দিয়েও কোন মুসলিম মেয়ের সাথে হিন্দু ছেলের সম্পর্ক খুঁজে পাবেন না, পেলেও অতি অবশ্যই তার কোন পরিণতি পাবেন না! বলাবাহুল্য এই ট্রেন্ডের পায়োনিয়ার কিন্তু বলিউডি সিনেমা ! হিন্দুদের আশীর্বাদ নিতে দর্গা বা মাজারে যাওয়া, জিহাদি সুফীদের অতিমানব বা বিশ্ব মানব হিসেবে উপস্থাপন করা, মানবতাহীণ মুসলিম সন্ত্রাসীদের জীবনের মানবিক বিষয়গুলো তুলে ধরা, মুসলিম গুণ্ডা, সন্ত্রাসী ও গ্যাংস্টারদের পুরুষসুলভ chivalry and gallantry তুলে ধরা (chivalry and gallantry এর টার্গেট কিন্তু হিন্দু মেয়েরা), হিন্দুধর্মকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, মোটামুটি হিন্দুদের সূক্ষ্ম ও স্থুলভাবে তাচ্ছিল্য করে ক্রমাগত আঘাত করে তাদের মানসিকভাবে ভেঙ্গে ফেলা, বিপর্যস্ত করা, তাদের হীনমন্য করে তোলা, পরিচয় সংকট সৃষ্টি করা, যাতে সে নিজের হিন্দু পরিচয় নিয়ে লজ্জা পায়! বিপরীতে অমানবিক ইসলামকে একটি সহনশীল, উদার, সাহসী ও প্রয়োজনীয় বিকল্প হিসেবে তুলে ধরাটাই হল এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের উদ্দেশ্য! বলিউডের বর্তমান মুভিগুলো দেখুন, উত্তর পেয়ে যাবেন! মাথায় রাখুন বিনোদন মাধ্যমগুলোর প্রবল প্রভাব উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের ওপর, হিসাব মিলে যাবে!
এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের স্ট্যান্ডার্ড প্রতিবাদ কি? ভাঙচুর করা, সিনেমা হল বা সিনেমার প্রোডাকশন সেট পোড়ান! কিন্তু লাভ কি কিছু হয়? আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চাই প্রতিরোধ ও পাল্টা আগ্রাসন! সেটা কোথায়? হিন্দুরা কি পাল্টা সাংস্কৃতিক চর্চা শুরু করতে পেরেছেন হিন্দু দৃষ্টিকোণ থেকে? শুরু করার কোন আকাঙ্খাও কি দেখা যাচ্ছে হিন্দুদের মধ্যে? বাংলার ৭০ বছর ধরে চলা একপেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও নীরব গণহত্যা নিয়ে একটা সিনেমা তো দূরের কথা, একটা ডকুমেন্টারী পর্যন্ত হিন্দুরা বানাতে পারেছেন? ইউরোপে বড় বড় শহরে ইহুদীরা হলোকস্ট মিউজিয়াম বানিয়েছে, হিন্দুরা কিছু শিখেছেন কি ইহুদিদের কাছ থেকে ? বাঙ্গালী হিন্দুদের চোখের জল ইহুদিদের থেকে বেশি বই কম হবে না! হিন্দুদের এখনও পর্যন্ত কোন নিজস্ব ধার্মিক, হিন্দু জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক ফ্রন্টই নেই! পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গনটাই হিন্দুরা বামৈসলামিকদের দিয়ে দিয়েছেন। তার দাম পরিশোধ করছেন হিন্দুরা এখন যখন অভ্যন্তরীণ ক্ষয় ও বাইরের নিরন্তর প্রোপাগান্ডার ধাক্কায় হিন্দুদের সমাজব্যবস্থা ও মূল্যবোধ সম্পূর্ণ ধ্বসে গেছে!
এখানেই সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর অশোধিত প্রতিবাদের গুরুত্ব, ভাষার শোধন ব্যবহারেই হয়। ব্যবহারটা তো শুরু করতে হবে! বামৈসলামিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনটার বিরুদ্ধে হিন্দুদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রতিবাদ হোক কবিতায়, গানে, সিনেমায়, আড্ডায়, ডকুমেন্টারিতে, সাহিত্যে আর বিনোদনে। শুধু জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিয়ে মানুষের মন জেতা যায় না, মানুষের কাছে পৌঁছান যায় না। তার জন্য প্রয়োজন সেন্টিমেন্ট, আর সেন্টিমেন্ট এর প্রসারের জন্যই দরকার উপরিউক্ত মাধ্যমগুলো!
হিন্দু জাতীয়তাবাদ বাম ইস্লামিক যুগপৎ আগ্রাসনের সামনে হেরে গেল কি করে? এর বহুমাত্রিক কারণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এম আর আখতার মুকুলের “চরমপত্র” বাংলাদেশ বেতারে শোনানো হতো, কোন সুশীল শুদ্ধ ভাষায় নয়, আঞ্চলিক ভাষায়! যে ভাষায় “শোধন” কম, কিন্তু, মনের টান বেশী! হিন্দু জাতীয়তাবাদ সম্ভবত সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণে করতে পারেনি। হিন্দু জাতীয়তা বাদের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কেও কোন স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠেনি।
এক্ষেত্রে আহমদ ছফা থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাই, “হিন্দু রাষ্ট্রের প্রকৃত রূপরেখা কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বঙ্কিমের নির্দিষ্ট কোন ধারণা ছিল না, শুধু অতীতের ঝাপসা স্মৃতি, ধোঁয়া ধোঁয়া, ছায়া ছায়া কিছু অনুভবই ছিল তাঁর পাথেয়। সহজাত প্রবণতাবশে তিনি শুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্র সৃষ্টি করতে হলে তার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে পারে যেসব আদর্শ সেগুলো ঝাড়ে বংশে উৎপাটন করে ফেলতে হবে।”
Rezaul Manik