এতদিন ইসলামপন্থিদের সাম্প্রদায়িকতা দেখতে দেখতে একঘেয়ে উঠে থাকলে এবার প্রগতিশীল মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতা দেখে ভিন্ন স্বাদ নিতে পারবেন! এরকম সুযোগ অনেকদিন বাদে আসে। শেষবার এসেছিলো ‘হিন্দু মহাজোট’ নেতা গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিকের একটি মন্তব্য থেকে যখন তিনি বলেছিলেন, ‘খুনীদের গ্রেফতার ও শাস্তি না হওয়ায় জনগণ বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সরকার ইচ্ছা করেই এই খুনীচক্রের মূল্যেৎপাটন করছে না। হিন্দু সম্প্রদায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, বাড়িঘর, মন্দির হারিয়ে, যাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠায়, তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিষয়ে কোন ভূমিকা রাখেন না (প্রথম আলো, ১৮.৬.২০১৬)। এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রমাণ দাঁড় করানো যখন কঠিন তখন হিন্দু মহাজোটের অপর নেতা সুভাষ চন্দ্র সাহা করা একটি মন্তব্যকে মূল ধরে নিয়ে কথিত ‘অসাম্প্রদায়িক লেখক-বুদ্ধিজীবীরা’ পুরো অভিযোগ অস্বীকার করে ফেলেছিলেন। সুভাষ চন্দ্র সাহা মন্তব্য করেছিলেন, “হিন্দু নারীরা এখন নিরাপত্তার অভাবে হাতের শাঁখা খুলে ও সিঁদুর মুছে চলাফেরা করেন।” (প্রথম আলো, ১৮.৬.২০১৬)।
বাংলাদেশে হিন্দুরা অনেক সময়ই হিন্দু হিসেবে পরিচিত হতে বিব্রতবোধ করেন। কখনো ঠকে যাবার ভয়ে, কখনো বঞ্চিত হবার ভয়ে। কোন হিন্দু বাংলাদেশে খাবার হোটেলে গিয়ে ‘জল’ বলে আলাদাভাবে চিহ্নিত হতে চায় না। এই অস্বস্তি যে আছে তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবু সুভাষ চন্দ্র সাহার এই মন্তব্যকে ‘বাড়াবাড়ি’ ধরে নিলেও গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের বক্তব্য কি অসত্য হয়ে যায়? বাংলাদেশে কে কতখানি অসাম্প্রদায়িক তা ৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে আলোচনার সময়ই বেরিয়ে পড়ে। নিজ প্রিয় দলের সময় সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখল, দেশত্যাগের সংখ্যা যখন গবেষণায় উচ্চহারে বেরিয়ে আসে তখন অনেক উচ্চমাত্রার ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী আদাজল খেয়ে নামেন সংখ্যালঘু নির্যাতনের সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে। ১৯ জুন ২০১৬ সালে এমনই একটি কলাম লেখেন স্যার মুনতাসির মামুন (লেখার লিংক http://www.muldharabd.com/?p=1288)।
তিনি সেই কলামে বাংলাদেশের হিন্দুদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। গোবিন্দ চন্দ্র প্রমাণিকের অভিযোগকে সুভাষ চন্দ্র সাহার মন্তব্য দিয়ে বাতিল করে দেন। দেশের মান-সন্মান নষ্ট করার জন্য রানা দাশগুপ্ত ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করে স্যার মুনতাসির মামুন লিখেন, ভারতে মুসলমানরা নির্যাতিত হয়েও বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে আসে না- আর বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতকে হিন্দু দেশ ভেবে সেখানে চলে যেতে এক পা দিয়ে রাখে… ইত্যাদি। বিজেপি’র সঙ্গে দেখা করে রানা দাশগুপ্ত ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন সম্পর্কে তথ্য দেয়ার নিউজ বের হবার পর তাদের দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী হিসেবে দেখানো হয়েছিলো। একই কাজ যখন শাহরিয়ার কবীর বিএনপির আমলের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রমাণ্য চিত্র নির্মাণ করেছিলেন তখন তাকেও বিএনপি-জামাত সরকার দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী হিসেবে ঘোষণা করেছিলো। তবে মূল সত্যটি আরো অন্যরকম। হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী নিপীড়নে, সম্পত্তি দখলে যেমন স্থানীয় পর্যায়ে সর্বদলীয় ঐক্য গড়ে উঠে, তেমনি বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন, দেশত্যাগের ইতিহাস মুছে ফেলতে সর্বদলীয় বুদ্ধিজীবী ঐক্য সাধন ঘটে। যে কারণে সলিমুল্লাহ খানের মূলধারা বাংলাদেশ সাইটে মুনতাসির মামুনের হিন্দু নির্যাতন খন্ডনকারী কলাম রি-পোস্ট হয়। যেমন আওয়ামী লীগের ছায়াও যিনি সহ্য করতে পারেন না সেই বাম কমরেড বদরুদ্দিন উমার লীগ আমলে ঘটা বড় বড় সম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতনের সময় সেই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে সরকারের সমালোচনার বদলে উল্টো সরকারের ইমেজ উদ্ধার করে দেন। এমনটি ভারতে দেখা যায় না। বিজেপি ক্ষমতার সময় বাম ও কংগ্রেস যে কোন মুসলিম নিপীড়নের ঘটনাকে বিশাল করে দেখানোর চেষ্টা করে যাতে রাজনৈতিকভাবে তারা লাভবান হয়। কিন্তু এরকম রাজনৈতিক সুযোগও হেলায় হারানো হয় বাংলাদেশে যখন হিন্দু নির্যাতনের প্রসঙ্গ চলে আসে। এ বিষয়ে সম্ভবত অঘোষিতভাবে কোন মানসিক ঐক্য আছে যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ইতিহাস রাখা হবে না। হিন্দুরা সুখে শান্তিতে থাকার পরও বিনা কারণে ভারতে চলে গিয়েছিলো কারণ ভারতকে তারা নিজেদের বাপের দেশ মনে করত… এরকম ইতিহাসই শেষ হিন্দুটি দেশ ত্যাগের পর সর্বদলীয় বুদ্ধিজীবীরা মিলিতভাবে লিখবেন। নাসিরনগর হামলা হলো আওয়ামী লীগ আমলে, কমরেড বদরুদ্দিন উমার এই সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে মন্তব্য করলেন এভাবে, ‘প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সাধারণ হিন্দুরা নয়, দুর্নীতিবাজ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত লোকই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।…
বদরুদ্দিন উমার যেরকম পার্ভাট মন্তব্য তার কলামে করেছিলেন সেরকমটা কমিউনিস্টদের কাছে থেকে যদিও নতুন নয়। কিন্তু এখানে কি ভয়ংকরভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনকে তত্ত্ব দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো দেখুন, লোকটি লিখেছিলো, ‘বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের ওপর এ ধরনের কোনো নির্যাতন বাস্তবত নেই। দেশে সাধারণভাবে যে নৈরাজ্য এবং আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, তাতে সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে, অনেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারি লোকদের দ্বারা অপহৃত ও নিহত হচ্ছেন। এদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাটি সব থেকে বেশি, কারণ দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তারাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু হিন্দুরা বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ, শতকরা নয়-দশ ভাগের মতো। কাজেই সাধারণভাবে দেশে সরকারি ও বেসরকারি ক্রিমিনালদের দ্বারা মানুষের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, তার দ্বারা জনগণের অংশ হিসেবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এটাও বলা দরকার যে, হিন্দুদের জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা অল্প। (বদরুদ্দিন উমারের লেখার লিংক http://www.muldharabd.com/?p=1129)
উমারের তত্ত্ব অনুযায়ী তাহলে পৃথিবীর কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটে না কারণ সংখ্যায় কম হওয়ায় সংখ্যাগুরুর তুলনায় তাদের উপর নির্যাতনের হারও কম। না, উমার এতখানি বেখায়েলী নয়, ভারতে ‘মুসলিম নির্যাতন’ নিয়ে তিনি বিস্তর কলাম লিখেন। ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের উত্তানে গোস্বা হোন। ফিলিস্তিনি, রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি এই তত্ত্ব খাটান না। এই তত্ব কেবলমাত্র বাংলাদেশী হিন্দুদের উপর পযজ্য। এই বেলায় উমার মামুন ভাই ভাই। সলিমুল্লাহ কলিমুল্লায় কোন বিভেদ নাই। প্রিয়া সাহা আরো একবার সেই ভ্রাতৃত্ব আর মেলবন্ধনের সুযোগ করে দিয়েছে। আবারো আমরা সর্বদলীয় বুদ্ধিজীবী ঐক্য দেখতে পাবো আমরা। প্রিয়া সেনের বলা সংখ্যাটাকে ধরে নিয়ে আমাতী বামাতী জামাতী হেপাজাতী সবার ঐক্য দেখতে চুপ করে অপেক্ষা করে বসে থাকুন। আবুল বারাকাতের গবেষণা, শাহরিয়ার কবীরের বিএনপি জামাতের সময় হিন্দুদের ধর্ষণ নিপীড়নের রেকর্ড সব চাপা রাখুন। গণিমতখোরদের যার যার দলীয় আলখাল্লা দিয়ে ঢেকে রাখুন। হিন্দু চাটার দল যে কোন প্রকারে দলীয় ইজ্জ্বত রক্ষায় জানপ্রাণ দিয়ে লড়ুন। যেমন করেই হোক বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইতিহাস স্বীকৃতি দেয়া যাবে না। যেমন করে আমরা মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের প্রতি পাকিস্তানী সেনাদের ঘোষণা করে জেনেসাইডের ইতিহাসকে ‘বাঙালী জাতির উপর বর্বরতা’ দিয়ে হিন্দু শব্দটি মুছে দিয়েছি। যেমন দেশভাগের দাঙ্গার পর পূর্ব পাকিস্তানে ঘটা ৫০, ৬৪, ৬৫, ৭১, ৯০ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণকে চাপা দিয়ে ফেলেছি। আমাদের কোন উপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার কখনই হিন্দু হলোকাস্ট নিয়ে লেখেননি। কারণ আমরা সকলেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ওভারকোট থেকে বের হয়েছি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের চেতনা- সবই তো দ্বিজাতি তত্ত্বের ওভারকোটের তলা থেকে এসেছে। আম গাছের চাড়া থেকে আম গাছই বের হবে। যতই অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীরতার দাবী করুক, বাপকা বেটা সিপাহি কা ঘোড়া…