পবিত্র হজ ও আবদুল মোতালিবের ধর্ম
…………………………………………………
কাবাঘরের বড় ধরণের সংস্কার ঘটে ইসলামের নবী মুহাম্মদের ৩৫ বছর বয়স কালে। তখনো তিনি নবী হননি। সেসময় কোন রকম গাঁধুনি ছাড়াই পাথরের উপর পাথর রেখে কাবার দেয়াল গড়া হতো। এতে করে দেয়াল ধসে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকত। এই সময় রোমান বাণিজ্য জাহাজের ভাঙ্গা কাঠের তক্তা কুরাইশরা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। ঘটনাচক্রে একজন মিশরীয় মিস্ত্রি সে সময় কুরাইশদের মধ্যে থাকায় তাকে দিয়ে কাবাঘরটা নতুন করে সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয়। মূলত কাবাঘরের একটি ছাদ বানানোর জন্যই বিশেষ করে এই সংস্কার। কাবাঘরে ছাদ না থাকায় রাতের আঁধারে চোররা কাবার দেয়াল টপকে চুরি করে নিয়ে যেতো ধনসম্পদ। (সীরাতে ইবনে হিশাম, অনুবাদ: আকরাম ফারুক, পৃষ্ঠা-৪৮)।
কাবাঘরের কথা সেমিটিক ধর্মের কয়েক হাজার বছরের যত ধর্মীয় নথি আছে কোথাও উল্লেখ নেই। ইসলাম দাবী করে এই ঘর আদম প্রথম নির্মাণ করেন। পরে ইব্রাহিম নবী সংস্কার করেন। সেই হিসেবে ধরলে এই ঘর সেমিটিক সব ধর্মের কাছেই অন্যতম প্রধান তীর্থ হবার কথা। ইসলামের নানা সোর্স ছাড়া কাবাঘরের কথা আর কোথাও নেই। কাবাঘরের প্রাচীন ইতিহাস বলতে সীরাত ইবনে হিশাম থেকে যা জানা যায়, ‘অর্জিত পদ মর্যাদার ব্যাপারে আবদে মান্নাফের সন্তানরা কোরা অর্থাৎ লটারির ব্যবস্থা করেন। কোরায় আবদে মান্নাফের পুত্র হাশেমের নাম ওঠে। এর ফলে হাশেম সারা জীবন হাজীদের পানি পান করানো এবং হাজীদের মেহমানদারীর দায়িত্ব পালন করেন। হাশেমের মৃত্যুর পর তার ভাই মোত্তালেবের এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মোত্তালেবের পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র আব্দুল মোত্তালেবের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। তিনি ছিলেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাদা। আবদুল মোত্তালেবের পুত্র আব্বাস এ দায়িত্ব লাভ করে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড পৃ: ১২৯, ১৩২, ১৭৮, ১৭৯)।
আরবে যে ধর্ম প্রচলিত ছিলো তাকে ভারতের জ্ঞাতী ধর্মই বলা উচিত। ব্রাহ্মণদের মত কুরাইশদেরই কেবল পুরোহিত হবার যোগ্যতা ছিলো। কুরাইশদের বংশ মর্যাদাকে মনে করা হতো আল্লাহ নির্ধারিত শ্রেষ্ঠত্ব। এই জাত্যাভিমান হযরত মুহাম্মদের মধ্যেও চলে এসেছিলো। হাদিস থেকে জানা যায় নিজের বংশ গৌরব করতে গিয়ে মুহাম্মদ বলেছেন, ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন, আল্লাহ পাক মাখলুক সৃষ্টি করোর পর আমাকে সর্বোত্তম দলের মধ্যে সৃষ্টি করেন। এরপর পরিবার বাছাই করেন এবং আমাকে সবচাইতে ভালো পরিবার সৃষ্টি করেন। কাজেই আমি গোত্রর দিক থেকে উৎকৃষ্ট গোত্রজাত এবং পরবার বা খান্দানের দিক থেকে ও সর্বোত্তম (তিরিমিযি ২য় খন্ড, পৃ:২৩১)।
হজ ওমরা আরবদের বহু পুরোনো পৌত্তলিক আচার। আশেপাশের অন্যান্য পৌত্তলিকরাও তাই কাবাঘরের নানা রকম উপঢৌকন পাঠাতো। যেমন পারস্যবাসীরা কাবাঘরে মূল্যবান সম্পদ, সোনার হরিণ, স্বর্ণের তলোয়ার ইত্যাদি উপহার হিসেবে কাবাঘরে পাঠাতো। (মুরাও অযজাহাব ১ম খন্ড, পৃ:২ও৫)।
ঈদ, নামাজ, কুরবাণীসহ নবীদের কাহিনী প্রায় একই বিষয় হলেও কাবাঘর এবং হজ আব্রাহামীয় ধর্মের কোথাও এরকম কিছু নেই। বরং আরবদের কাবাঘর এবং হজের অনুসঙ্গের সঙ্গে ভারতের পৌত্তলিকদের হুবহু মিল। আজকের যুগে যে রীতিতে হাজি সাহেবরা হজ করে আসছেন তার সবই ছিলো আবদুল মোতালিবের আমলে। একই রকম সেলাইহীন কাপড় পরে কাবাঘরকে সাতবার পাঁক দিতো। আগত হাজি সাহেবদের কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা দেয়া ছিলো কুরাইশদের একটি দায়িত্ব। যেমন সীরাত থেকে জানা যায়, ‘কয়েকটি হাউজে হাজীদের পানি ভরে রাখা হতো। এরপর সেই পানিতে খেজুর এবং কিসমিস মিশিয়ে পানি মিঠা করা হতো। হজ্জ যাত্রীরা মক্কায় এলেই সেই পানি পান করতেন’ (মোহাদেরাতে খাযরমি, ১ম খন্ড, পৃ-৩৬)।
হযরত মুহাম্মদের দাদাজান আবদুল মোতালিবের ধর্ম কি ছিল? এই প্রশ্ন অনেক ইসলামী স্কলারের কাছে করে ভিত্তিহীন উত্তর পেয়েছি। তাদের দাবী, আবদুল মোতালিবের ধর্ম ছিল ইব্রাহিমি একেশ্বরবাদ। এটি পরিস্কার মিথ্যাচার। আবদুল মোতালিব যদি ইব্রাহিমি তথা সেমিটিক ধর্মের অনুসারী হবেন তো তিনি মক্কার কাবাঘরের রক্ষাকর্তা বা এর দেখভালের যোগ্য হন কিভাবে? যে কাবাঘরে বহু ঈশ্বরবাদের আরাধনা চলত সেখানে আবদুল মোতালেবই বা যাবেন কেন? বহু ঈশ্বরবাদের পুজারী কুরাইশরা কেন আবদুল মোতালিবকে তাদের নেতা মান্য করতে যাবে? নিশ্চিত করেই তাই বলা যায় আবদুল মোতালেব ছিলেন একজন আরব পৌত্তলিক বহু ঈশ্বরবাদের পুজারী। হজের সময় যে কালো ঘরকে ঘিরে সাতবার পাঁক দেয় হাজি সাহেবরা, সেভাবেই, আবদুল মোতালিব, আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, আবু তালিবরা হজ করতেন। হজের ব্যবস্থাপনা এই কুরাইশদের হাতেই ছিলো যুগ যুগ ধরে। কিন্তু দুনিয়ার কোন ধর্মীয় সূত্রেই দাবী করেনি মুসা বা যীশু মক্কায় গিয়ে হজ করে এসেছেন। অথচ তাদের তো আল্লার এই সর্বশেষ ঠিকানায় একবার হলেও আসা উচিত ছিল। এতে প্রমাণিত হয় আবদুল মোতালিব পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন। যদি মুহাম্মদের চাচা আবু তালিব দোযোগ যায় কাফের হবার কারণে তাহলে একইসূত্রে আবদুল মোতালিব দোযগী। একইভাবে নবীর পিতা আবদুল্লাহ দোযগী কাফের। আমি ঠিক জানি না, মুসলমানরা তাদের ছেলে সন্তানদের নাম আবদুল মোতালিব কিংবা আবদুল্লাহ রাখেন কি বিবেচনায়? তারা নাকি ‘ইসলামিক নাম’ রাখেন?
এবার কাবাঘর ভাঙ্গতে আসা রাজা আবরাহারের ঘটনাটা নিয়ে দু-চারটে কথা বলে শেষ করি। রাজা আবরাহার মক্কা আক্রমণ করতে আসছেন জেনে কুরাইশদের নেতা আবদুল মোতালিব রাজা আরবাগের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। আবদুল মোতালিব জানালেন, রাজার বাহিনী তার দুশো উট ধরে নিয়ে এসেছে তিনি সেটা ফেরত চান। রাজা আবরাহা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তোমার বাপ-দাদার ধর্মের কেন্দ্রে যে কাবাঘর আমি সেটাকে ভাঙ্গতে এসেছি আর তুমি বলছ দুশো উটের কথা বলছ!… আবদুল মোতালিব বললেন, আমি শুধু দুশো উটের মালিক, কাবাঘরের যে মালিক তিনিই তার ঘর রক্ষা করবেন…।(সূত্র: ইবনে হিশাম, কা’বা ধ্বংস করতে আবরাহার অভিযান, পৃষ্ঠা- ৭৫)
আবদুল মোতালিব এতটাই নির্ভার ছিলেন তার “আল্লাহ” উপর। গোটা ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় ইসলামের শত্রু কাফের আরব কুরাইশরা আল্লাহর কসম কাটছে, আল্লাহর সাহায্য চাইছে, আল্লার গজব চাচ্ছে…। আবদুল মোতালিবের যুগে আরব পৌত্তলিকদের কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি নিয়ে ‘আল্লাহ’ প্রধান দেবতা। স্বয়ং আবদুল মোতালিব তৎকালিন পৌত্তলিক ধর্মীয় বিশ্বাস মতে যে কোন ফয়সালার জন্য কাবায় রক্ষিত হুবাল দেবতার কাছে রক্ষিত সাতটি তীর ছুড়ে সিদ্ধান্ত ঠিক করতেন। নিজ পুত্র আবদুল্লাহকে তিনি কাবার পাশে কোরবানী দিতে চাইলে প্রতিবেশীরা বাধা দেন। আবদুল মোতালিবের যমযম কূপ খননের সময় আল্লাহ’র কাছে শপথ করেছিলেন যে তার যদি দশটি ছেলে জন্ম নেয় তাহলে একটিকে তিনি আল্লাহ’র নামে জবাই করে উৎসর্গ করবেন। তার দশম সন্তান জন্মালে তিনি তার শপথ রক্ষা করতে তীর ছুড়ে সন্তান নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। আবদুল্লাহ নাম লেখা তীর উঠে আসলে আবদুল্লাকেই বলি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কারইশদের বাধার মুখে এর বিকল্প কি হতে পারে জানতে হুবাল দেবতার কাছে রক্ষিত তীর ছুড়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা হয়। আবদুল মোতালিবের ধর্ম কি ছিল এই ঘটনাটাও একটা প্রমাণ। (সূত্র: ইবনে হিশাম, আবদুল মোত্তালিব কর্তৃক নিজ সন্তানকে কুরবানী করার মানতের বিবরণ, পৃষ্ঠা- ১৪৯)।
তো এই কাবাঘরের চাবিই আবদুল মোতালিবের জিম্মায়। তিনিই কাবার প্রধান খাদেম। প্রধান পুজারী। বছরান্তে যে মেলা হয় (হজ) সে সময় যে বিপুল অর্থ অর্জন হয় মূলত তা থেকেই কুরাইশদের হাশিমি গোত্রের প্রধান উপার্জন। রাজা আবরাহা আবদুল মোতালিবের উট ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি মক্কার কাবাঘর অভিযান করবেনই। মূর্তি পূজারী কুরাইশরা এবার তাদের প্রধান দেবতা আল্লাহ’র কাছে সমবেত হলো কাবাঘরকে রক্ষা করতে। আবদুল মোতালেব কাবার দরজার চৌকাঠ আকড়ে ধরে বললেন, হে আল্লাহ! একজন দাসও তার দলবলকে রক্ষা করে। অতএব তুমি তোমার ঘর ও লোকজনকে রক্ষা করো।(সূত্র: ইবনে হিশাম, কা’বা ধ্বংস করতে আবরাহার অভিযান, পৃষ্ঠা- ৭৫)।
কথিত আল্লাহ’র ইচ্ছায় মুহাম্মদের হাত থেকে ৩৬০টি মূর্তিকে রক্ষা করতে পারেনি কুরাইশরা, আবার সেই আল্লাহই আবাবিল পাখি দিয়ে নিজের ঘর ও ৩৬০টি মূর্তি রক্ষা করেছিলেন! কেমন গোজামিল একবার ভেবে দেখুন।