এ ‘রাধা’ আসলেন কোথা হতে?
বিশেষ প্রতিবেদকঃ ‘রাধা’ হল সাধকের জীবনের একটা ভাব। ব্রজভাব, গোপীভাব ও রাধাভাবের মধ্য দিয়ে সাধক এগিয়ে চলে তার পরম লক্ষ্যের পানে। এই রাধাভাব জাগ্রত হবার পরেই সাধক তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। আবার বৈষ্ণব তন্ত্র মতে প্রতিটি মানুষের মূলাধারস্থিত জীবভাব বা কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে রাধা বা আহ্লাদিনী শক্তি বলে। সহস্রার চক্রে রয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই রাধাকৃষ্ণের মিলনেই সাধকের জীবনের সার্থকতা। তাই প্রতিটি সাধকই রাধা। রাধা বলতে কোন গোপী বা নারীকে বোঝায় না। শ্রীকৃষ্ণের সময়ে বৃন্দাবনে ‘রাধা’ নামে কেউ ছিল না।
শ্রীকৃষ্ণ ঐতিহাসিক পুরুষ। শাস্ত্রীয় বিবরণ ও জ্যোতিষ গণনার ভিত্তিতে লোকবিশ্বাস ও উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল ৩২২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১ আগষ্ট বুধবার। প্রচলিত ধারণায় তাঁর সম-সাময়িক মহামুনি ব্যাসদেব মুখ্যতঃ শ্রীকৃষ্ণের বাল্য জীবন নিয়ে ভাগবত ও তাঁর কর্মজীবন নিয়ে মহাভারত ও হরিবংশ রচনা করেন। গীতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী। কিন্তু এই ভাগবতে, মহাভারতে, হরিবংশে বা গীতায় কোথায়ও ‘রাধা’ নামে কোন নারীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যজীবনের কাহিনী বৃন্দাবন লীলাই ভাগবতে প্রাধান্য পেয়েছে। কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এই ভাগবত। কিন্তু এই ভাগবতে কোথাও রাধার নাম গন্ধও নেই। অথচ আজকাল রাধা বিনা কৃষ্ণের কোন মন্দির নেই, রাধা বিনে কৃষ্ণের নাম নেই, রাধা শব্দ বৈষ্ণবগণের মজ্জার সঙ্গে মিশে আছে।
এই রাধাকে নিয়ে কৃষ্ণের সম্পর্কে যে সব আদি রসাত্মক কাহিনী কিছু বৈষ্ণব সাহিত্যের বা পালা কীর্তনের মাধ্যমে বাংলার গ্রামে গ্রামে প্রচার করা হয়েছে বা আজও হচ্ছে, তা কোন ভদ্র রুচিসম্পন্ন মানুষ ছেলেমেয়েদের নিয়ে একসঙ্গে বসে শুণতে বা আলোচনা করতে পারেন না। এখানে কৃষ্ণকে দেখান হয়েছে একটা নারীলোলুপ, চরিত্রহীন, লম্পট হিসেবে। যেখানে তিনি সম্পর্কে মামী, বয়সে বড় আয়ানপত্নী রাধার সঙ্গে অবৈধ পরকীয়া প্রেম করছেন, মেয়েদের বস্ত্রহরণ করছেন, মাখন চুরি করছেন। আবার অনেক তথাকথিত গুরু গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও কৃষ্ণের প্রতি তাদের ভক্তির সুযোগ নিয়ে কৃষ্ণ সেজে রাসলীলায় মাতোয়ারা হয়, ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।
এ ‘রাধা’ আসলেন কোথা হতে?
এই রাধা তত্ত্ব নিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপধ্যায় তাঁর ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পাঠকের সুবিধার জন্য সেখান থেকে কিছুটা তুলে দিলাম,-
“ভাগবতের এই রাসপঞ্চাধ্যায়ের মধ্যে ‘রাধা’ নাম কোথাও পাওয়া যায় না। বৈষ্ণবাচার্য্যদের অস্থিমজ্জার ভিতর রাধা নাম প্রবিষ্ট। তাহারা টিকা টিপ্পনীর ভিতর পুনঃ পুনঃ রাধা প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিয়াছেন, কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নেই। গোপীদিগের অনুরাগাধিক্যজনিত ঈর্ষার প্রমান স্বরূপ কবি লিখিয়াছেন যে, তাহারা পদচিহ্ন দেখিয়া অনুমান করিয়াছিল যে, কোন একজন গোপীকে লইয়া কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাও গোপীদিগের ঈর্ষাজনিত ভ্রমমাত্র। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হইলেন এই কথাই আছে, কাহাকেও লইয়া অন্তর্হিত হইলেন, এমন কথা নাই এবং রাধার নামগন্ধও নাই।
রাসপঞ্চাধ্যায়ে কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নাই। ভাগবতে কেন, বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশ বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নাই। অথচ এখানকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণনাম নাই। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির নাই বা মূর্ত্তি নাই। বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন। যদি মহাভারতে, হরিবংশে, বিষ্ণুপুরাণে বা ভাগবতে ‘রাধা’ নাই, তবে এ ‘রাধা’ আসিলেন কোথা হইতে?
রাধাকে প্রথমে ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে দেখিতে পাই। উইল্সন্ সাহেব বলেন যে, ইহা পুরাণগণের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ বলিয়াই বোধ হয়। ইহার রচনা প্রণালী আজিকালিকার ভট্টাচার্য্যদিগের রচনার মত। ইহাতে ষষ্ঠী মনসারও কথা আছে।———সর্বশেষে প্রচারিত হইলেও ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ বাঙ্গালার বৈষ্ণবধর্মের উপর অতিশয় আধিপত্য স্থাপন করিয়াছে। জয়দেবাদি বাঙ্গালী বৈষ্ণব কবিগণ, বাঙ্গালার জাতীয় সঙ্গীত, বাঙ্গালার যাত্রা মহোৎসবাদির মূল ব্রহ্মবৈবর্ত্তে।তবে ব্রহ্মবৈবর্ত্তকার কথিত একটা বড় মূল কথা বাঙ্গালার বৈষ্ণবেরা গ্রহণ করেন নাই, অন্ততঃ সেটা বাঙ্গালীর বৈষ্ণব ধর্মে তাদৃশ পরিস্ফুট হয় নাই- রাধিকা রায়ান পত্নী বলিয়া পরিচিতা, কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত্তের মতে তিনি বিধি বিধানানুসারে কৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নী। সেই বিবাহবৃত্তান্তটি সবিস্তারে বলিতেছি।—-
“একদা কৃষ্ণসহিত নন্দ বৃন্দাবনে গিয়াছিলেন। তথাকার ভাণ্ডীরবনে গোপগণকে চরাইতেছিলেন। সরোবরে স্বাদুজল তাহাদিগকে পান করাইলেন এবং পান করিলেন। এবং বালককে বক্ষে লইয়া বটমূলে বসিলেন। হে মুনে! তারপর মায়াতে শিশুশরীর ধারণকারী কৃষ্ণ অকস্মাৎ মায়ার দ্বারা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং কাননান্তর শ্যামল; ঝঞ্ঝাবাত, মেঘশব্দ, দারুণ বজ্রশব্দ, অবিরল বৃষ্টিধারা এবং বৃক্ষসকল কম্পমান হইয়া পতিতস্কন্ধ হইতেছে, দেখিয়া নন্দ ভয় পাইলেন। গোবৎস ছাড়িয়া কিরূপেই বা আপনার আশ্রমে যাই, যদি গৃহে না যাই, তবে এই বালকেরই বা কি হইবে, নন্দ এইরূপ বলিতেছেন, শ্রীহরি তখন কাঁদিতে লাগিলেন; মায়াভয়ে ভীতিযুক্ত হইয়া বাপের কন্ঠ ধারণ করিলেন। এই সময় রাধা কৃষ্ণের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন”।
রাধার অপূর্ব লাবণ্য দেখিয়া নন্দ বিস্মিত হইলেন, তিনি রাধাকে বলিলেন, “আমি গর্গমুখে জানিয়াছি, তুমি পদ্মার অধিক হরির প্রিয়া আর ইনি পরম নির্গুণ অচ্যুত মহাবিষ্ণু; তথাপি আমি মানব, বিষ্ণু মায়ায় মোহিত আছি। হে ভদ্রে! তোমার প্রাণনাথকে গ্রহণ কর; যথায় সুখী হও, যাও। পশ্চাৎ মনোরথ পূর্ণ করিয়া আমার পুত্র আমাকে দিও”।
এই বলিয়া নন্দ রাধাকে কৃষ্ণ সমর্পণ করিলেন। রাধাও কৃষ্ণকে কোলে করিয়া লইয়া গেলেন। দূরে গেলে রাধা রাসমণ্ডল স্মরণ করিলেন, তখন মনোহর বিহারভূমি সৃষ্টি হইল। কৃষ্ণ সেইখানে নীত হইলে কিশোরমূর্ত্তি ধারণ করিলেন। তিনি রাধাকে বলিলেন ‘যদি গোলকের কথা স্মরণ হয়, তবে যাহা স্বীকার করিয়াছি, তাহা পূর্ণ করিব’।
তাঁহারা এইরূপ প্রেমালাপে নিযুক্ত ছিলেন, এমন সময়ে ব্রহ্মা সেইখানে উপস্থিত হইলেন। তিনি রাধাকে অনেক স্তবস্তুতি করিলেন। পরিশেষে নিজে কন্যাকর্তা হইয়া, যথাহিহিত বেদবিধি অনুসারে রাধিকাকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করিলেন। তাঁহাদিগকে বিবাহ-বন্ধনে বদ্ধ করিয়া তিনি অন্তর্হিত হইলেন। রায়ানের সঙ্গে রাধিকার যথাশাস্ত্র বিবাহ হইয়াছিল কিনা, যদি হইয়া থাকে, তবে পূর্বে কি পরে হইয়াছিল, তাহা ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে পাইলাম না। রাধাকৃষ্ণের বিবাহের পর বিহার বর্নন। বলা বাহুল্য যে, ব্রহ্মবৈবর্ত্তের রাসলীলাও ঐরূপ।
যাহা হউক, পাঠক দেখিবেন যে, ব্রহ্মবৈবর্ত্তকার সম্পূর্ণ নতুন বৈষ্ণব ধর্ম সৃষ্ট করিয়াছেন। সে বৈষ্ণবধর্মের নামগন্ধ বিষ্ণু বা ভাগবত বা অন্য পুরাণে নাই। রাধাই এই নূতন বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্রস্বরূপ। জয়দেব কবি গীতগোবিন্দ কাব্যে এই নূতন বৈষ্ণবধর্মাবলম্বন করিয়াই গোবিন্দগীতি রচনা করিয়াছেন। এই ধর্ম অবলম্বন করিয়াই শ্রীচৈতন্যদেব কান্তরসাশ্রিত অভিনব ভক্তিবাদ প্রচার করিয়াছেন। বলিতে গেলে সকল কবি, সকল ঋষি, সকল পুরাণ, সকল শাস্ত্রের অপেক্ষা ব্রহ্মবৈবর্ত্তকারই বাঙ্গালীর জীবনের উপর অধিকতর আধিপত্য বিস্তার করিয়াছেন”।
(কৃষ্ণ চরিত্র, পৃঃ-১০০-১০৪)
শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ- দর্শনে ও সাহিত্যেঃ
এখানে দেখা যাচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সময়ে ‘রাধা’ নামে কেউ ছিল না, প্রাচীন কোন গ্রন্থেই তার কোন প্রমান পাওয়া যায় না। এই রাধার উৎপত্তি ও বিকাশ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শশীভূষন দাশগুপ্ত তাঁর ‘শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ- দর্শনে ও সাহিত্যে’ গ্রন্থে লিখেছেন,-
“প্রথমে মুখ্যতঃ সাহিত্যকে অবলম্বন করিয়াই শ্রীরাধার বিকাশ; ধর্ম তাহার সহিত পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকিলেও সেখানে ধর্মের কোনও স্পষ্ট স্ফুরণ নাই। সাহিত্য ধারার ভিতর দিয়া ক্রম বিকশিত শ্রীরাধাই ক্রমে তাঁহার বিভিন্ন কবি বর্ণিত মানবী দেহের পরিমণ্ডলে বিচিত্র রম্য ধর্মবিশ্বাস এবং দার্শনিক তত্ত্বের বর্ণশাবল্য গ্রহণ করিতে লাগিলেন এবং ইহার ভিতর দিয়াই প্রেম ধর্মের কেন্দ্রমনি রাধা দিন দিন ‘কান্তা শিরোমনি’ রূপে পরিপূর্ণতা লাভ করিতে লাগিলেন। এই ‘কান্তা শিরোমনি’ রূপে শ্রীরাধার পূর্ণ পরিণতি চৈতন্য যুগে”।
(শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ- দর্শনে ও সাহিত্যে, পৃ- ৩০৪)
এই প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন- “বাংলাদেশে আমরা রাধাকৃষ্ণকে লইয়া নিরন্তর লীলা বিস্তার দেখিতে পাইতেছি। এই লীলা উপাখ্যানের উৎপত্তি ও বিস্তার প্রথমাবধিই কবি কল্পনায়। প্রত্যেক যুগের কবিকল্পনাকে অবলম্বন করিয়া লীলা উপাখ্যান নিত্য নূতন শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হইয়া উঠিয়াছে। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে দেখিতে গেলে মানুষের এই প্রেমকে নিত্যনূতন অবস্থানের ভিতর দিয়া আমরা নূতন করিয়া লই। সকল বৈষ্ণব কবিকেই এক রাধাকৃষ্ণের প্রেম লইয়া কবিতা রচনা করিতে হইয়াছে; এই এক রাধাকৃষ্ণ প্রেমকে বিচিত্র করিয়া লইতে না পারিলে তাহাকে অবলম্বন করিয়া নিত্যনূতন কাব্য কবিতা রচনা করা সম্ভব নহে। এই জন্য বিভিন্ন যুগের কবিগণকে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে লইয়া দেশোচিত এবং যুগোচিত বিচিত্র অবস্থান সৃষ্টি করিয়া লইতে হইয়াছে। এইজন্য রাধাকৃষ্ণের সাহিত্যকে ঐতিহাসিক ক্রমে বিচার করিলে দেখিতে পাইব, যত দিন অগ্রসর হইয়াছে ততই লীলার বিস্তার ঘটিয়াছে।
জয়দেবের পূর্ববর্তী রাধাকৃষ্ণ কবিতার ভিতরে বিভিন্ন লীলার আভাস মেলে, কিন্তু জয়দেব তাঁহার গীতগোবিন্দ কাব্যে এই রাধাকৃষ্ণ লীলাকে নিজের নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভার দ্বারা অনেকখানি বিস্তার করিয়া লইলেন; জয়দেবের ভিতরে যে লীলা পাইতেছি, বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের ভিতরে তাহা আবার বিচিত্রভাবে পল্লবিত হইয়া উঠিয়াছে। প্রচলিত চণ্ডীদাসের পদাবলীতে দেখি রাধাকে লইয়া ভার-লীলা, দান-লীলা, নৌকা-লীলা প্রভৃতি লইয়াই কবি সুখী হইতে পারে নাই; কবিকে মিলন-বিরহের আরও অসংখ্য ‘ব্যপদেশ’ সৃষ্টি করিতে হইয়াছে। তাঁহাকে বেদে হইয়া সাপের ঝাঁপি মাথায় লইতে হইয়াছে, দোকানী হইয়া পসরা লইয়া ঘুরিতে হইয়াছে, বাজীকর হইয়া কত রকমের বাজী দেখাইতে হইয়াছে। শুধু কি তাই? কৃষ্ণ প্রয়োজন মত নাপিতানী, মালিনী, দেয়াসিনী, বনিকিনী, চিকিৎসক, গ্রহবিপ্র প্রভৃতি সবই হইয়াছে। গোবিন্দ দাসের একটি প্রসিদ্ধ পদে দেখি, কৃষ্ণকে গোরখযোগী সাজিয়া শিঙ্গা বাজাইয়া দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করিয়া রাধার অভিমান ভাঙ্গাইতে হইয়াছে”।
(শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ-দর্শনে ও সাহিত্যে)
রায়ানপত্নী রাধাঃ
এই শ্রীরাধাকে আমরা প্রথম পাই ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে। শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রয়ানের প্রায় দুই হাজার বছর পরে। পৌরাণিক যুগের গোড়ার দিকে ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ রচিত হয়। এই ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে প্রথম রাধার কাহিনী পাওয়া যায়। তবে এখানে রাধা শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী, ব্রহ্মা নিজে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধার বিবাহ দেন। এখানে রায়ান পত্নী রাধার কাহিনী নেই। এর পরে আজ থেকে প্রায় আটশত বৎসর পূর্বে কবি জয়দেব তাঁর ‘গীত গোবিন্দ’ কাব্য লিখলেন- সেখানে রাধাকৃষ্ণের কাহিনী, লীলাকথা আরও বিস্তারিত হলো। কিন্তু এখানেও রায়ান পত্নী রাধার উপাখ্যান নেই। এরপরে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে অনেক কবিতা, গান, পদাবলী রচনা করে রাধা-কৃষ্ণের লীলা কাহিনী নানারূপে পরিবেশন করলেন। কিন্তু এর মধ্যেও রায়ান-পত্নী রাধার কাহিনী নেই। চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের ব্যাপক প্রচার বাংলার জন সাধারণের মধ্যে ঘটে।চৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন বৈষ্ণব তন্ত্র প্রভাবিত ভক্ত সাধক। তিনি সংসার ত্যাগ করে, কামিনি-কাঞ্চন ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছিলেন। বৈষ্ণব তন্ত্র মতে রাধাভাবে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতেন। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন তাঁর ধ্যানের ধ্যেয়, পরমারাধ্য উপাস্য।
সাধকের হৃদয়ে যখন ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণ জাগে, ভালবাসা জাগে তাকে বলে ভক্তি বা প্রেম। সাধকের হৃদয়ের এই প্রেম ব্রজভাব, গোপীভাবের মধ্য দিয়ে রাধাভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করে। ব্রজভাবে সাধক পরমপুরুষকে, কৃষ্ণকে ভালবাসে কারণ তাঁকে ভালবেসে যে তার ভাল লাগে। যেমন স্ত্রী স্বামীকে ভালবাসে, কেননা স্বামীকে ভালবেসে তার ভাল লাগে। তাই স্ত্রীর স্বামীকে ভালবাসা স্বকীয় প্রেম। এখানে স্বার্থ আছে। ঠিক তেমনি কৃষ্ণকে আমি ভালবাসি, তাঁকে ভালবেসে আমার ভাল লাগে, তাঁকে দেখেও আমার ভাল লাগে। ভক্তির এই স্তরটাকে ব্রজভাব বলে। বৈষ্ণব মতে একেই বলে স্বকীয় প্রেম বা কান্তাকান্ত প্রেম। শুদ্ধাভক্তির এটাই প্রথম স্তর রাগানুগা ভক্তি।
সাধকের হৃদয়ে পরমপুরুষের প্রতি প্রেম যখন আরও তীব্র হয় তখন সে অনুভব করে পরমপুরুষকে আনন্দ দেওয়াই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, আর তার জন্যে আমাকে যত দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করতে হয়, হোক। তখন তার সেই ভাবকে বলে গোপীভাব। সাধককে এখানে বলে গোপ। বৈষ্ণব মতে একেই বলে ‘পরকীয় প্রেম’। শুদ্ধাভক্তির এটাই চরম স্তর রাগাত্মিকা ভক্তি।
সাধক যখন সাধনায় আরও এগিয়ে যায়, তখন সে বুঝতে পারে এ জগতে খাওয়া, পরা, বাড়ী-গাড়ী বা ধন-সম্পদ কোন কিছুই চরম নয়, একমাত্র পরমপুরুষই সার সত্তা। তাঁকে না পেয়ে আমার জীবন নিরর্থক, আমি শুধু তাঁকে পেতে চাই।সে তখন অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পরমপুরুষের পানে ছুটে চলে। এই যে চরম ভাব একেই বলে রাধাভাব। সে কৃষ্ণের আরাধনা ছাড়া আর কিছুই তখন বুঝতে পারে না। এই রাধাভাবের চরম বিকাশ ঘটেছিল চৈতন্য মহাপ্রভুর মধ্যে।
কিন্তু মনের কামনা-বাসনা, ষড়রিপু-অষ্টপাশকে জয় করতে না পারলে হৃদয়ে পরমপুরুষ কৃষ্ণের প্রতি প্রেম জাগে না। চৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোভাবের পরে বৈষ্ণব গোস্বামীগণ কামনা-বাসনা, ষড়রিপু-অষ্টপাশকে জয় করার সাধনা না করে কান্তাকান্ত প্রেমের পথ ধরেন। রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্ত্তি বৈষ্ণব গোস্বামীদের আরাধ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। ফল স্বরূপ বৈষ্ণব ধর্মের বিবর্তনের ধারায় এল বৈষ্ণব সহজিয়া মত, এল নায়িকা সাধনা, কিশোরী ভজন ইত্যাদি। বৈষ্ণব গুরুদের সাথে এল বোষ্টমী। এল পরকীয়া প্রেমের ভজন তত্ত্ব। এইসব বৈষ্ণব গুরুরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তাদের ভোগমুখী মনের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে তাদের বিকৃত ভোগ সাধনার সমর্থনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নারীমাংস লোলুপ, কামার্ত পরকীয়া প্রেমের খল নায়ক রূপে প্রতিষ্ঠা করে রচনা করলেন নৌকা বিলাস, শ্রীরাধার মানভঞ্জন ইত্যাদি পালাকীর্তন, নাটক। এল জটিলা, কুটিলা, এল রায়ান পত্নী রাধার কাহিনী। বাংলার মানুষ শ্রীকৃষ্ণকে জানলো এইসব বৈষ্ণব গুরুদের দ্বারা, নাটক আর পালাকীর্তনের মাধ্যমে। তাই কৃষ্ণের সঙ্গে সঙ্গে রাধার ধারণাও মানুষের মনে দৃঢ়মূল হলো। কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত্তকারের কপোল কল্পিত এই রাধা চরিত্রের সঙ্গে বা চৈতন্যোত্তর আদর্শভ্রষ্ট বৈষ্ণব গোস্বামীদের সৃষ্ট নাটক, পালাকীর্তনের এই রায়ানপত্নী রাধার সঙ্গে ঐতিহাসিক শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্ক কোথায়? তাই ঐতিহাসিক শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে এই কাল্পনিক রাধা চরিত্রের কোন সম্পর্কই নেই আর থাকতে ও পারে না।