পাকিস্তানপ্রীতি একটি মানসিক রোগ।।।

পাকিস্তানপ্রীতি একটি মানসিক রোগ
-আরিফ রহমান, ২১ নভেম্বর ২০১৬

বিপিএল এর আসরে পাকিস্তানী ক্রিকেটারেরা খেলছেন। একটু উন্নত দেশে কাজ করে পরিবারের জন্য দুটো পয়সা কামিয়ে নেয়ার বিষয়টাতে আমরা খুব একটা আপত্তি করতে পারি না। তবে ভয়াবহ সমস্যাটা হচ্ছে টেলিভিশনে যখন দেখতে পাচ্ছি আমাদের প্রজন্মের একটা বড় অংশ পাকিস্তানী প্লেয়ার কিংবা আফ্রিদিদের জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করে মাঠ গরম করে রাখছে। যখন টেলিভিশনে দেখতে পাই শুধু আফ্রিদিকে এক পলক দেখার জন্য মাঠে ললনাদের ভিড়।

এই ললনাদের উদ্দেশ্য কিছু ঘটনা তুলে ধরতে চাই-

“প্রতিটি মেয়ের মুখমণ্ডল বিষণ্ণ, বিমর্ষ ও বিষময় দেখেছি। মিলিটারি জীপে ও ট্রাকে যখন এভাবে যুবতী মেয়েদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আনা হতো তখন পুলিশ লাইনে হৈচৈ পড়ে যেত, পাঞ্জাবী বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ জিভ চাটতে চাটতে ট্রাকের সম্মুখে এসে মেয়েদের টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ দেহের পোশাক পরিচ্ছদ কাপড় চোপড় খুলে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে উলঙ্গ করে আমাদের চোখের সামনেই মাটিতে ফেলে কুকুরের মতো ধর্ষণ করতো। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও অঞ্চল থেকে ধরে আনা এসকল যুবতী মেয়েদের সারাদিন নির্বিচারে ধর্ষণ করার পর বিকালে আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের উপর তাদেরকে উলঙ্গ করে চুলের সঙ্গে লম্বা রডের সাথে বেঁধে রাখা হতো। রাতের বেলায় এসব নিরীহ বাঙ্গালী নারীদের উপর অবিরাম ধর্ষণ চালানো হতো। আমরা গভীর রাতে আমাদের কোয়ার্টারে বসে মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনে অকস্মাৎ সবাই ঘুম থেকে ছেলেমেয়েসহ জেগে উঠতাম। সেই ভয়াল ও ভয়ঙ্কর চিৎকারে কান্নার রোল ভেসে আসতো, “বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও, তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাদের বাঁচাও, পানি দাও, এক ফোটা পানি দাও, পানি পানি।”
-সুবেদার খলিলুর রহমান, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস

১৯৭১ সালে ধর্ষণে লিপ্ত এক পাকিস্তানী মেজর তার বন্ধুকে লেখা চিঠির কথা- “আমাদের এসব উশৃঙ্খল মেয়েদের পরিবর্তন করতে হবে, যাতে এদের পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তন আসে। তারা যেন হয়ে ওঠে ভালো মুসলিম এবং ভালো পাকিস্তানী”। ১৯৭২ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটক এক পাকিস্তানী অফিসারের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় কেন তারা এরকম নির্মমভাবে ধর্ষণ করেছিলো, তার জবাবে সেই অফিসার বলে- “আমাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিলো, যে একজন ভালো মুসলমান কখনোই তার বাবার সাথে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের যত বেশী সম্ভব বাঙালী মেয়েদের গর্ভবতী করে যেতে হবে।”

আপনারা কি লক্ষ্য করেছেন টিক্কা খান কতোটা সফল ছিলো, পাকিস্তানীরা হেরে গেলেও আমাদের সাচ্চা পাকিস্তানী করে রেখে গেছে। রাস্তাঘাটে আজ পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার লোকের অভাব হয় না, গোলাম আযমের জানাজায় লোকের অভাব হয় না। ‘সেলফি’ আর ‘ম্যারি মি আফ্রিদির’ অভাব হয় না।

পাঠক খেয়াল করে দেখুন টিক্কা খানেরা সবসময় গুড মুসলিম আর গুড পাকিস্তানী শব্দদুটো একসাথে বসায়। অর্থাৎ “গুড মুসলিম=গুড পাকিস্তানি”। ইসলাম আর পাকিস্তানকে মিলিয়ে ফেলার এই প্রবণতা দেশের একশ্রেণীর মানুষেরও আছে। এরা ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত পাকিস্তানবিরোধী কথা বললেই জাত গেলো, ধর্ম গেলো ধোঁয়া তুলে জিকির চালাতে থাকে। আর সেই ধোঁয়ার ভেতর দিয়েই ধীরে ধীরে মাথা তুলতে থাকে জঙ্গিবাদের আস্ফালন।
কোনো বাঙালি যদি পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই মানুষের মানসিক সমস্যা আছে। একমাত্র বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া পাকিস্তানকে কোনো নিম্নশ্রেণীর পশুও পছন্দ করার কথা না। কারণ তারা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো এই দেশে অসহায় মানুষদের প্রতি, সেটা হার মানিয়েছিলো হিটলার, মুসোলিনি, গেস্টেপোদেরও।

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মমতম ৫টি গণহত্যার অন্যতম গণহত্যাটি হয়েছিলো বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের হাতে। ওরা পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পুরস্কারটা পাকিস্তানকে দেয়। যদি গিনেস কর্তৃপক্ষ ঘুণাক্ষরেও জানতো সেই নিপীড়িত জাতির মানুষরাই এখনো পাকিস্তানের জন্য আস্ফালন করে, সেইসব খুনি-রাজাকারদের মৃত্যুতে এখনো কান্নাকাটি করে— তাহলে হয়তো আমাদেরও একটা পুরস্কার দিতো; শ্রেষ্ঠতম বেহায়া, নির্লজ্জ জাতির পুরস্কার। কোন যুক্তির ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আজও আমরা পাকিস্তানকে ঘৃণা করি সেটা নিয়ে লিখেছিলাম “কেন আজও পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে হয়” পাঠকদের ঘুরে আসতে অনুরোধ করবো। এতো কিছু জানা এবং মানার পরেও যারা আজও পাকিস্তানকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন দিয়ে চলেছেন তাদের মানসিক বিকারগ্রস্ত ছাড়া তেমন কিছুই বলার নেই আমার।

আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি ‘পাকিস্তানকে সমর্থন’ কিংবা ‘রাজাকারদের সমর্থন’ আদতে একটা রোগ, একটা মানসিক রোগ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘Stockholm syndrome’। এই রোগটির উৎপত্তি এবং বিভিন্ন লক্ষণ দেখে আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়া অনেক বাঙালি এই সিনড্রোমে আক্রান্ত। মিলিয়ে দেখুন, আপনার পরিচিত কারো ভেতরে এই রোগের অস্তিত্ব খুঁজে পান কি না!

Stockholm syndrome’ এর নামকরণের ইতিহাসটা চমকপ্রদ।

১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট সুইডেনের ‘Stockholm’ এ দুই সন্ত্রাসী দুটো মেশিনগান নিয়ে একটা ব্যাংকে হামলা চালায়। তারা ব্যাংকের চারজন কর্মকর্তাকে ১৩১ ঘণ্টা জিম্মি করে রাখে। কর্মকর্তাদের তিনজন ছিলেন মহিলা এবং একজন পুরুষ। সেই কর্মচারীদের ডিনামাইটসহ বেঁধে ব্যাংকের ভল্টে ফেলে রাখা হয়। ৪ দিন পর ২৮ তারিখ তাদের অসুস্থ অবস্থায় মুক্ত করা হয়।
এরপরের ঘটনা আরও বিস্ময়কর।

বিভিন্ন মিডিয়া যখন সেইসব ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে এই মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ জানতে চায়, তখন তারা সবাই সেইসব অপরাধীদের সমর্থন দিতে শুরু করে এবং যারা তাদের উদ্ধার করতে আসে তাদের শত্রু মনে করতে থাকে। তাদের মনে থাকে, সন্ত্রাসীরা বুঝি তাদেরকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করছিলো। সেই চার ব্যাংক কর্মকর্তাদের একজন পরবর্তীতে সেই সন্ত্রাসীদের একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং আরেকজন ব্যাংক কর্মকর্তা সেইসব সন্ত্রাসীদের আইনী খরচ চালানোর জন্য অর্থ উত্তোলন শুরু করে।

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট Dr. Joseph M. Carver তার “Love and Stockholm Syndrome: The Mystery of Loving an Abuser” আর্টিকেলে বলেছেন—
“In clinical practice, some of the most surprised and shocked individuals are those who have been involved in controlling and abusive relationships. When the relationship ends, they offer comments such as “I know what he/s’s done to me, but I still love him/her”, “I don’t know why, but I want him/her back”, or “I know it sounds crazy, but I miss her/him”…

এবারে একটু মিলিয়ে দেখুন আপনার আশেপাশে এসব কথা বলা লোক খুঁজে পান কি না-

“আমি জানি পাকিস্তান আমাদের সাথে কি করেছে, তবুও তাদের সমর্থন করি। কেন সমর্থন করি জানি না, তবুও সমর্থন করি। পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র, পাকিস্তানিরা আমাদের ভাই, হয়তো কিছু খুন-ধর্ষণ করেছেই, তাই বলে সমর্থন করতে সমস্যা কোথায়?। আহ, বেচারা আফ্রদির কি দোষ!। পুরনো ঘটনা ভুলে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাই।”

মিল কি কিছু খুঁজে পাচ্ছেন? এবার আসুন জেনে নেয়া যাক এই ‘Stockholm syndrome’ রোগের লক্ষণ গুলো কি কিঃ

১) Victim having positive feelings toward the abuser.
(রোগী তার নির্যাতনকারীর প্রতি ইতিবাচক অনুভূতি অনুভব করবে)

তিরিশ লাখ শহীদ আর ছয় লাখ বীরাঙ্গনার রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত যেই দেশ, যেই দেশের আজও একশ মানুষের ভেতর একজন করে একাত্তরের শহীদের বংশধর পাওয়া যায় সেই রক্তস্নাত দেশের মানুষ, সেই রক্ত যারা ঝরিয়েছিলো তাদের সমর্থন যোগায়।

২) Victim having negative feelings toward family, friends, or authorities.
(রোগী তার পরিবার, তার বন্ধুবান্ধব কিংবা তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি নেতিবাচক আচরণ করবে।)

যেই বন্ধু বা অভিবাবকটি তাদেরকে এই ঘৃণ্য সমর্থন থেকে সরে আসতে উৎসাহ দেয়, তাদের বিনা উসকানিতে অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ করে। অথচ গালি-গালাজ করার মতো কোনো কথাই সেই বন্ধু কিংবা অভিবাবক বলেন নি।

৩) Abuser having positive feelings toward the victim
(নির্যাতনকারী যাকে নির্যাতন করেছে তার প্রতি ইতিবাচক অনুভূতি অনুভব করবে।)

পাকিস্তানের গণহত্যাকে ছোট করে দেখা, অস্বীকার করা, ‘ভারতের ষড়যন্ত্র দেশ ভাগ হয়েছে’ বলা, পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যাক্ত করা। অথচ তার দেশে তার বাসার পাশেই হয়তো তখনো পাকি নির্মমতার সাক্ষ্য নিয়ে কোন বীরাঙ্গনা কাতরাচ্ছেন। কোনো মুক্তিযোদ্ধা পায়ে গুলি নিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে ভিক্ষা করছেন।

৪) Victim supporting or helping the abuser.
(রোগী তার ওপর নির্যাতনকারীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে এবং সমর্থন যোগাবে।)

রাজাকারের বিচারকে বানচাল করার প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টা।

এবারে জেনে নেয়া যাক ‘Stockholm Syndrome’ এ আক্রান্ত রোগীদের কি কি পর্যায় রয়েছে:

১) রোগী যখন তার নির্যাতনের যন্ত্রণা/ব্যাথা থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হয়ে যায় তখন সে নির্যাতনের সময়কে নির্যাতকের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। রোগী তার ওপর নির্যাতনকারীর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হতে থাকে এবং তার নিজের যন্ত্রণার সময়গুলোর স্মৃতি ধামাচাপা পড়ে যেতে থাকে।

২) এভাবে চলতে থাকলে রোগী নিজের অজান্তেই নির্যাতনকারীকে খুশি করার চেষ্টা করতে থাকে।

৩) এভাবে একসময় তার কাছে নির্যাতনকারী আর সাধারণ অন্য মানুষের আর কোনো তফাৎ থাকে না।

৪) এক পর্যায়ে এই দ্বন্দ্বমূলক অযৌক্তিক অনুভূতি রোগীর সাথে নির্যাতনকারীর একটা সম্পর্কের সূচনা করে। রোগী তার নির্যাতনকারীর উপকার করার জন্য নিজের প্রয়োজনীয়তাকে পর্যন্ত অবজ্ঞা করা শুরু করতে পারে।

তবে এই রোগের চিকিৎসাও রয়েছে। নিচের বর্ণনা অনুসারে পথ্য গ্রহণের আগে অবশ্যই কোন সার্টিফাইড ডাক্তারের কাছ থেকে প্রেস্কিপশন করিয়ে নেবেন। আমি যেহেতু চিকিৎসক নই সুতরাং ওষুধ দেয়ার ক্ষমতা আমি রাখি না। আসুন চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নেই-

medical-dictionary.thefreedictionary অনুসারে ‘Stockholm Syndrome’ রোগের চিকিৎসা ‘Post-traumatic stress disorder (PTSD)’র মতোই। সাধারণত ছয় মাস ব্যাপী থেরাপি দেয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন থেরাপি রয়েছে যেমন:

১) Group therapy
২) Brief psychodynamic psychotherapy
৩) Family therapy

এসব নিয়ে আর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে আমেরিকার Veterans Health Administration ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে কিছু ওষুধের কথা উল্লেখ করেছে, যেমন-

১) citalopram (Celexa)
২) fluoxetine (such as Prozac)
৩) paroxetine (Paxil)
৪) sertraline (Zoloft)

কিছু বাঙালির পাকিস্তানপ্রেম, রাজাকারপ্রেম যে অসুস্থ অস্বাভাবিকতার দিকে যাচ্ছে, তাতে এ ধরনের মানুষদের চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। আমি আশা করবো এ বিষয়টি সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ আমলে নেবেন!

তথ্যসূত্র:
১) counsellingresource.com/therapy/self-help/stockholm/
২) crclips.com/lib/2006/03/06/stockholm-syndrome/
৩) jewishcommunitywatch.org/stockholm-syndrome/
৪) ptsd.va.gov/public/treatment/therapy-med/treatment-ptsd.asp