প্রাচীন ভারতে ধর্ম মানে মানুষের ব্যক্তিগত উত্তরোনের জায়গা। মুসলমান সাজিয়ার সাথে প্রেম করার জন্য হিন্দু অঙ্কিত সাক্সেনাকে তার প্রেমিকার ভাই এবং বাবা দিল্লীর রাস্তায় সবার সামনে কুপিয়ে খুন করেছে। লোকেরা সেই দৃশ্য মোবাইলে তুলতে ব্যস্ত ছিল-কেউ এগিয়ে আসেনি তাকে বাঁচাতে।
স্পষ্টতই তিন বছর আগে ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকার বুক ফেয়ারে অভিজিত রায়ের খুনের ঘটনা মনে এল। সেও খুন হয়েছিল প্রকাশ্যেই-কেউ এগিয়ে আসে নি। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে।
হিন্দু-মুসলমান প্রেমের ঘটনায় ফ্যামিলির হাতে খুন, অনার কিলিং ভারত-বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি সপ্তাহেই ঘটে। হিন্দু -মুসলমান যুবক খুন হয়। মাঝে মাঝে মোমবাতি মিছিল হয়। হলে হবে কি? যেখানে ভারতের রাজনীতি, মিডিয়া ব্যস্ত হিন্দু-মুসলমান আলাদা সম্প্রদায় এই দ্বিজাতি তত্ত্বের পুঃনপ্রতিষ্ঠায়, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিশাক্ত ছোবলে অসংখ্য প্রেমিক প্রেমিকার প্রাণ যাবে-তা আর আশ্চর্য্য কি!
প্রাচীন ভারতের গোষ্ঠি অবশ্য ছিল, কিন্ত “ধর্মীয় পরিচিতির” ভিত্তিতে গোষ্ঠী -এই ধারনা ভারতে এসেছে ইসলামের মাধ্যমে। বৃটিশ আমলে তা পরিপোক্ত ধারনা নেয়। প্রাচীন ভারতে “ধর্ম” মানে মানুষের ব্যক্তিগত উত্তরোনের জায়গা। ধর্মের মাধ্যমে গোষ্ঠি বানানো ব্যপারটা মধ্যপ্রাচ্যের-প্রথমে ইহুদি,
পরে খ্রীষ্ঠান এবং ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক অভিলাষের মধ্যে দিয়ে বিজয়ী গোষ্ঠিগুলির রাজনৈতিক এবং সামাজিক নীতি একেশ্বরবাদি ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। বিজিত জনগণ অবশ্য সেই গোষ্ঠিবাজির ধর্মকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সুপ্রীম ইচ্ছা বলেই আফিম সেবনে রত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা অধিক পাকে কোকেন হিরোয়িন হয়ে সন্ত্রাসবাদির ও জন্ম দেয়।
মেয়ের বিয়ে নিয়ে গোষ্ঠিতে গোষ্ঠিতে সংঘর্ষ ইতিহাস জুরে। প্রাচীন ভারতের রীতিনীতির প্রামান্য যদি মহাভারত হয়, তাহলে কিন্ত পরিস্কার প্রাচীন ভারতে, মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল না।
মহাভারতে পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কন্যাহরণ করে বিয়ের উদাহরন অনেকগুলো- এর মধ্যে বিখ্যাত দুটি অবশ্য কৃষ্ণের রুক্কিনী হরন এবং অর্জুনের সুভদ্রাহরণ। এই দুই ইলোপ এপিসোড মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেললে দেখা যাবে, প্রাচীন ভারতে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের ইচ্ছাকে সর্বদাই গুরুত্ব দেওয়ার রীতি ছিল।
এই দুটি বিখ্যাত ইলোপের ঘটনার সাথে জড়িত দ্বারকা রাজ্য এবং তার দুই রাজকুমার বলরাম এবং বাসুদেভ কৃষ্ণ। দ্বারকা একই সাথে বন্দর এবং নগর রাষ্ট্র। বন্দর নগররাষ্ট্রগুলি পৃথিবীর ইতিহাসে শুধুই মালামালের আমদানী রপ্তানীর জন্য বিখ্যাত ছিল না- সেখানে দেশ বিদেশের বণিকেরদের মধ্যে দর্শন এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও হত। খুব স্বাভাবিক কারনে দ্বারকাবাসীরা মভাভারতের যুগে “প্রগ্রেসিভ” এক জনগোষ্ঠি।
কৃষ্ণ রুক্ষিনীর কাছ থেকে পত্র পেলেন তার পিতা বিদর্ভরাজ ভিষ্মক , শিশুপালের সাথে তার বিবাহ স্থির করেছেন-কিন্ত রুক্কিনী ভালোবাসেন কৃষ্ণকেই। সুতরাং কৃষ্ণ যেন তাকে উদ্ধার করেন।
রুক্ষিনীকে নিয়ে বিদর্ভ থেকে পালানো সহজ ছিল না। রুক্কিনীর সাথে শিশুপালের সম্মন্ধ নিয়ে বিদর্ভরাজের কাছে এসেছেন স্বয়ং জরাসন্ধ্র । মগধরাজ জরাসন্ধ্র তখন গোটা ভারতের রাজচক্রবর্ত্তী সম্রাট হওয়ার অভিলাসী।
ছেদির যুবরাজ শিশুপাল জরাসন্ধ্রের ডানহাত। সেই যুগে অন্য রাজ্যকে, স্বীয় ক্ষমতার ছত্রতলে আনার দুটোর উপায় ছিল- যুদ্ধ অথবা বিবাহ। রাজকন্যারা ছিলেন রাজনীতির বোরে। জরাসন্ধ্র তখন সব থেকে শক্তিশালী সম্রাট এবং তিনি বিদর্ভকে নিজের ক্ষমতার বৃত্তে আনার জন্য শিশুপাল ও রুক্কিনীর বিয়ে ঠিক করলেন।
সেই রাজনৈতিক বিয়ে ভেঙে কেউ যদি রুক্কিনীকে হরণ করে, তার ব্যাকলাশ কিহবে, তা সহজেই অনুমেয়। জরাসন্ধ্রের রক্তচক্ষু, দ্বারকার মতন এক ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের জন্য আপদ ত বটেই!
বলরাম সবই জানতেন। রুক্কিনীর পত্র দেখা মাত্র ঠিক করলেন তিনি বিদর্ভ আক্রমণ করবেন । ঠিক হল কৃষ্ণ রুক্কিনীকে মন্দির থেকে রথে তুলে পালাবেন। বলরাম বিদর্ভের রাজধানী অবরোধ করে রাখবে, যাতে কোন সেনা কৃষ্ণের পেছনে না আসতে পারে।
এই পর্বে বলরামের একটা উক্তি মহাভারতে খুবই উল্লেখযোগ্য- বিদর্ভরাজকে সভ্যতা সেখানো দরকার! অর্থাৎ যেসব গোষ্ঠি তাদের কন্যাকে স্বয়ংবরের সুযোগ দেয় না, তাদের অসভ্য বললেন বলরাম!
লেখক-ড: মিনাল কান্তী দেবনাথ
আরো পড়ুন….
- উপমহাদেশের রত্নগর্ভা তক্ষশীলা,পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।-দুরর্ম
- ইতিহাসের এক ভয়ংকর অধ্যায়, গজনীর মাহমুদ, যে ইতিহাস হয়নি বলা।-দুরর্ম
- বেদ- একটা গল্প ও তার কাটাছেঁড়া, শ্রেণীসংগ্রাম অর্থাৎ ইতিহাস কিন্ত থেমে নেই, থেমে নেই পথ…
- তিতুমীর কেন জামায়াত-হেফাজত অনুসারীদের কাছে মহানায়ক।-দুরর্ম