বাঙালি_পল্টনের_ইতিহাস_২

#বাঙালি_পল্টনের_ইতিহাস_২

বেঙ্গল আর্মিতে ভারতের অধিকাংশ প্রসিদ্ধ ইউনিটগুলো ছিল। যেমন, বাংলার স্কিনার’স হর্স, হিমালয়ের গুর্খা ও খাইবার-পাখতুনখা অঞ্চলের কর্পস অব গাইডস।

#অশ্বারোহী
গভর্নর জেনারেলের দেহরক্ষী
১ম ও ১০ম বেঙ্গল লাইট কেভালরি রেজিমেন্ট। ১৮৫৭-৫৮ সালে এই নিয়মিত রেজিমেন্টের আটটি বিদ্রোহ করে এবং দুইটিকে ভেঙ্গে দেয়া হয়। বিদ্রোহ পরবর্তী সেনাবাহিনীতে এদেরকে রাখা হয়নি।

১ম ও ৪র্থ বেঙ্গল ইউরোপীয়ান লাইট কেভালরিরেজিমেন্ট। বেঙ্গল লাইট কেভালরির আটটি বিদ্রোহী রেজিমেন্টকে সরিয়ে এদেরকে আনার জন্য ব্রিটেনে ১৮৫৭ সালের নভেম্বরে এদেরকে দ্রুত রিক্রুট করা হয়। নামে “ইউরোপীয়ান” শব্দ দ্বারা বোঝা যায় যে এই দলে ভারতীয় সওয়ারদেরপরিবর্তে সাদা সৈনিকদের অন্তভুক্ত করা হয়। ১৮৬১ সালে চারটি ইউরোপীয় রেজিমেন্টকে ১৯তম, ২০তম ও ২১তম হুসারদের মত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে স্থানান্তরিত করা হয়।

বেঙ্গল হর্স আর্টিলারি
বেঙ্গল ইউরোপীয়ান ফুট আর্টিলারি
বেঙ্গল নেটিভ ফুট আর্টিলারি
পাঞ্জাব হর্স আর্টিলারি, পাঞ্জাব ইরেগুলার ফোর্স

#প্রকৌশল
দ্য করপস অব বেঙ্গল সেপারস এন্ড মাইনারস
দ্য সেবান্ডি সেপারস এন্ড মাইনারস

#পদাতিক
১ম বেঙ্গল (ইউরোপীয়ান) ফুসিলিয়ারস

২ম বেঙ্গল (ইউরোপীয়ান) ফুসিলিয়ারস

৩য় বেঙ্গল (ইউরোপীয়ান) লাইট ইনফেন্ট্রি

৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ বেঙ্গল ইউরোপীয়ান রেজিমেন্ট

১ম রেজিমেন্ট অব পাঞ্জাব বেঙ্গল নেটিভ ইনফেন্ট্রি

২য় থেকে ৭৪ম রেজিমেন্ট অব বেঙ্গল নেটিভ ইনফেন্ট্রি (গুর্খা ৬৬ম রেজিমেন্ট অব বেঙ্গল নেটিভ ইনফেন্ট্রি এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল)। এই নিয়মিত রেজিমেন্টগুলোর মধ্যে শুধু বারটি (২১তম, ৩১তম, ৩২তম, ৩৩তম, ৪২তম, ৪৩তম, ৪৭তম, ৫৯তম, ৬৩তম, ৬৫তম, ৬৬তম, ৭০তম বিএনআই) বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে বহাল ছিল।

১ম বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ ব্যাটেলিয়ন
কমান্ডার
প্রেসিডেন্সি আর্মিগুলোর মধ্যে বেঙ্গল আর্মি সর্ববৃহৎ ছিল বিধায় এর কমান্ডারকে ১৮৫৩ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত কমান্ডার-ইন-চিফ, ইন্ডিয়া বলা হত।

বেঙ্গল কমান্ডের কমান্ডার ইন চিফরা হলেন

লেফটেন্যান্ট-জেনারেল স্যার উইলিয়াম এলিস(১৮৯৫-১৮৯৬)
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল স্যার বেকার রাসেল(১৮৯৬-১৮৯৮)
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল স্যার জর্জ লাক(১৮৯৮-১৯০৩)
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল স্যার আলফ্রেড গেসেলি(১৯০৩-১৯০৭)

একটি রেজিমেন্টের অধীনে থাকে এক বা একাধিক ব্যাটালিয়ন। এই ব্যাটালিয়নগুলোই মূলত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ব্যাটালিয়নগুলোর হারজিতের উপর রেজিমেন্টের মর্যাদা নির্ভর করে।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়। সৈনিক নিয়োগের জন্য এক নতুন তত্ত্ব খাড়া করা হয় যার নাম ছিল “Martial Race Theory”। এই তত্ত্ব অনুসারে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু জাতিগোষ্ঠী থেকে সৈন্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেমন শিখ, গুর্খা, পাঞ্জাবী, জাট, মারঠা ইত্যাদি।

মূলত যেসকল অঞ্চল থেকে সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছিল, সেখানকার মানুষদেরই  Non-martial হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও সিপাহী বিদ্রোহের সময় সেভাবে বাঙালি সৈনিক ছিল না, তবুও বাঙালিদের “Non-martial race” এর তালিকায় রাখা হয়। ফলে বাঙালিদের সেনাবাহিনিতে অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়।

১৯১৪ সালে  ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীও যুদ্ধে যোগদান করে। যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত সৈন্যের প্রয়োজন পড়ে। এরফলে বাঙালি নেতৃবৃন্দ সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিক নেওয়ার জন্য দাবি জানাতে থাকে।এই নেতাদের মধ্যে ছিলেন মহারাজা মাহতাব চাঁদ, মতিলাল ঘোষ, এ কে ফজলুল হক , ডাক্তার ( লে কর্নেল) সর্বাধিকারি প্রমুখ।

ডাঃ সর্বাধিকারি ছিলেন বেঙ্গল মেডিকেল অ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি। তিনি ভাইসরয়কে একটি বাঙালি মেডিকেল টিম গঠনের প্রস্তাব দেন। ভাইসরয় তার প্রস্তাবে সাড়া দেন, যার ফলে গঠিত হয় “বেঙল অ্যাম্বুলেন্স কোর”। এতে ১৫ জন ডাক্তার এবং ১৭৫ জন নার্স, কম্পাউন্ডার, ড্রেসার থাকার কথা থাকলেও পরবর্তীতে তা ১০০ জনে সীমিত করা হয়। এই বাহিনী ইরাকে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎ সায় নিয়োজিত থাকে।

১৯১৬ সালের ২৮ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনী ইরাকে তুরষ্কের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কোরে কেউ কেউ তুর্কিদের হাতে বন্দি হয়। আর্থিক কারণে অ্যাম্বুলেন্স কোর রাখা না রাখা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ঐ বছরের ৩০ জুন অ্যাম্বুলেন্স কোর স্থগিত করা হয়। এই অ্যাম্বুলেন্স কোর ব্রিটিশদের প্রশংসা পায়। অন্যদিকে চন্দননগর থেকে ফ্রান্সের বাহিনীতে বাঙালী সৈন্য যোগ দিতে থাকে, ফলে বেঙল রেজিমেন্টের দাবী জোরালো হয়।

অবশেষে সবার দাবি মেনে নিয়ে ভাইসরয় জেমস চ্যামসফোর্ড ১৯১৬সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাঙালি   ইউনিট গঠনের ঘোষণা দেন।প্রথমে এই ইউনিটের নাম দেওয়া হয় “বেঙ্গল ডাবল কোম্পানি”।

সৈনিকদের বয়স ১৬-২৫, এবং সর্বনিম্ন উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি ঠিক করা হয়। প্রত্যেক সৈনিককে মাসিক ১১ টাকা বেতন ঠিক করা হয়।

ডাবল কোম্পানি কোনো পূর্ণাঙ্গ রেজিমেন্ট নয়, অন্যদিকে ডাবল কোম্পানির লোকবলও পূর্ন হয়ে গিয়েছে, ফলে পূর্ণাঙ্গ রেজিমেন্ট গঠনের দাবি উঠতে থাকে। জনবল পূর্ণ হওয়ায় এবং করাচি বাঙালি সৈন্যরা ভাল করায় রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯১৭ সালের ২৬ এ জুন বাঙালি পল্টন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম রাখা হয় “49th Bengal Regiment”। 

ডাবল কোম্পানির সদস্যদের এই রেজিমেন্টে যুক্ত করা হয়।এই রেজিমেন্ট ছিল এক ব্যাটালিয়নের, ব্যাটালিয়নে চারটি কোম্পানিতে মোট  ৮৯৬ জন সৈনিক ছিল।

এর অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল আর্থার ব্যারেট । পল্টন গঠনের পর পুরোনো সদস্যদের উচ্চতর আর নতুনদের সাধারণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এরই মাঝে সিদ্ধান্ত আসে বাঙালিদের রণাঙ্গনে পাঠানোর । ১৯১৬ এর ৫ জুলাই রেজিমেন্টকে মেসোপটেমিয়া(ইরাক) এ পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। করাচি থেকে জাহাজে তাদের ইরাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

আগস্টের মধ্যেই পুরো ব্যাটালিয়ন ইরাকে পৌছে। এদিকে বাগদাদে যুদ্ধ চলছে । রেজিমেন্টকে বাগদাদে পাঠানো হয়।

সেপ্টেম্বর মাসে তারা বাগদাদে পৌছে। ততদিনে ব্রিটিশ বাহিনী বাগদাদ দখল করায় বেঙল রেজিমেন্টকে শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ডিসেম্বর মাসে বাঙালি পল্টন ভয়াবহ বিপদে পড়ে। নানা কারণে অধিকাংশ সৈনিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। বেশ কিছু সৈনিক মৃত্যুবরণ করে। অবস্থা নিয়ন্ত্রনের বাইরে গেলে পল্টনকে ১৯১৮ এর জানুয়ারিতে আজিজিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। এখানে অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠে।

মার্চ মাসে তাদের কুটে সরিয়ে নেওয়া হয়। এখানে তাদের দায়িত্ব ছিল স্থাপনা পাহাড়া আর তুর্কি বন্দিদের নিরাপত্তা দেওয়া। জুন মাসে এখানে এক কলংকজনক ঘটনা ঘটে। 

বাঙালি সুবেদার সুকুমার পদন্নোতির লোভে আরেক সুবেদারকে  রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করে। এতে সুকুমার ও তার এক সহযোগীকে কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয়।

১৯১৮ এর ১১ নভেম্বর ১ম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। বাঙালি পল্টন তখন তনুমাতে। যুদ্ধ শেষ হওয়ায় প্রায় ২৫০ জন সৈনিককে ছুটি দেওয়া হয়।

এদিকে কুর্দিরা বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহ দমনে ২১০ জন বাঙালি সৈনিক ঠিক করা হয়। ১৯১৯ এর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এরা বিদ্রোহ দমনে কাজ করেছিলো।

যুদ্ধ শেষে  ব্রিটিশ বাহিনীতে বাঙালি পল্টনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। যুদ্ধে বেশিরভাগ সৈন্যের অসুস্থতা ও সুবেদার হত্যা মোটেও ভাল চোখে নেয়নি তারা।

অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঙালিদের অংশগ্রহনের ফলে সেনাবাহিনীতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সব বিবেচনায় পল্টন ভেঙ্গে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯২০ সালের ১৫ অক্টোবর বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হয়।

২য় বিশ্বযুদ্ধে কোনো বাঙালি পদাতিক ইউনিট তৈরি করা হয়নি।

সমাপ্ত…..

তথ্যঃ

Mollo, Boris (১৯৮১)। The Indian Army।