ক্ষুদ্রঋণ থেকে কূটনীতি: ডক্টর ইউনুসের অবস্থান বদল
ডক্টর ইউনুস, যিনি একসময় এনজিও পরিচালনা এবং ক্ষুদ্রঋণের ধারণা নিয়ে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছিলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের জাদুকরী সমাধানের কথা বলে এসেছেন। কিন্তু এখন তিনি একটি দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান। প্রশ্ন উঠছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বিনিয়োগের মতো জটিল বিষয়গুলো তিনি কীভাবে দেখছেন? তার সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য ও পদক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি হয়তো প্রচলিত বিনিয়োগের ধারণার বাইরে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির কাছে বন্দর লিজ দেওয়া বা স্টারলিংকের মতো প্রযুক্তি আনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন, যা হয়তো তার পুরনো গ্রামীণ উদ্যোগগুলোর সম্প্রসারণকেই সাহায্য করবে।
কূটনৈতিক ভারসাম্যের অভাব: চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ভারতের প্রতিক্রিয়া
তবে এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বাস্তব কূটনৈতিক ভারসাম্যের ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, যখন বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি নিয়ে ভাবা হচ্ছে চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির সঙ্গে, তখন প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার এই বাস্তবতা একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ বাজার ও বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে, তেমনি বাইরের রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়াও নিয়ন্ত্রণ করে।
চীন সফরে বিতর্কিত মন্তব্য: ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার কি স্বতঃসিদ্ধ?
সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ডক্টর ইউনুস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের বিশাল বাজারের সম্ভাবনার কথা বলেন। তিনি পরামর্শ দেন, চীন এই বাজার ধরার জন্য সীমান্ত এলাকায় বা এমনকি বাংলাদেশেই শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে পারে এবং বাংলাদেশ সেই পণ্য পরিবহনের কেন্দ্র হতে পারে। একইসাথে, তিনি বাংলাদেশকে এই অঞ্চরের “সমুদ্রের অভিভাবক” হিসেবে উল্লেখ করেন। এই ধরনের মন্তব্য করার সময় তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে, ভারতের ঐ সাত রাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণভাবে দু’দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক এবং কার্যকর বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ওপর নির্ভরশীল, এটি কোনো অধিকারের বিষয় নয়।
বাংলাদেশি পণ্যের বাজার তৈরি হয়েছিল ধৈর্য ও পারস্পরিক বোঝাপড়ায়
অথচ, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ এই বাজারগুলোতে তার আসবাবপত্র, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিল। সেই অবস্থান এসেছে ধীরে ধীরে বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তোলার মাধ্যমে। বিশেষ করে, ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভূবেষ্টিত হওয়ায় এবং সরবরাহ চেইন দুর্বল থাকায় বাংলাদেশি পণ্যের জন্য সেখানে একটি স্বাভাবিক চাহিদা তৈরি হয়েছিল, যা ভারতও বুঝতে পেরেছিল।
ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা: পণ্য রপ্তানিতে বড় ধাক্কা
ডক্টর ইউনুসের এই ধরনের মন্তব্যের পর ভারত থেকে কিছু প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ হলো স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে ভারতের বিধিনিষেধ আরোপ। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, যা ভারতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য, সেটিসহ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, আসবাবপত্র, সুতা এবং ফলের রস জাতীয় পানীয় এখন অনেক স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না।
বাজার হারাচ্ছে প্রাণ-আরএফএল ও হাতিলের মতো প্রতিষ্ঠান
প্রাণ-আরএফএল-এর মতো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা ভারতের “সেভেন সিস্টার্স” নামে পরিচিত রাজ্যগুলোতে নিজেদের পণ্যের একটি বড় বাজার তৈরি করেছিল, তারা এখন সংকটের মুখে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নিরাপত্তার ঝুঁকি এবং বাংলাদেশ সরকারের কিছু সদস্যের বেফাঁস মন্তব্য, যেমন “অখণ্ড বাংলা” গঠনের ধারণা বা ভারতের “চিকেন নেক” করিডোর নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনার কারণেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ভারত হিসাব করে আমদানি সীমিত করছে
তবে ভারতও কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সব পণ্যের আমদানি বন্ধ করেনি। মাছ, পাথর, ভোজ্যতেল, পাটজাত দ্রব্যের মতো কিছু পণ্য তারা এখনও নিচ্ছে, যেগুলো তাদের নিজেদের রাজ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, ভারতও হিসাব কষেই পদক্ষেপ নিয়েছে। “দ্য হিন্দু” পত্রিকার প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে তারা কোনো বাণিজ্য সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নন।
বিকল্প রুট কার্যকর নয়: খরচ ও সময় দুটোই বাড়ছে
বিকল্প হিসেবে ভারত কলকাতা সমুদ্রবন্দর বা মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দরের কথা বলছে। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে একদিকে যেমন সরাসরি বড় জাহাজ কলকাতায় যায় না, তেমনি মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দরে পণ্য পাঠাতে হলে শ্রীলঙ্কার কলম্বো হয়ে যেতে হবে। এতে সময় ও খরচ উভয়ই এতটাই বেড়ে যাবে যে, চিপস বা জুসের মতো পণ্যের দাম আর প্রতিযোগিতামূলক থাকবে না।
রাজনৈতিক অঙ্গনে নিঃসঙ্গতা ও কূটনৈতিক দুর্বলতা
অতীতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাথে ডক্টর ইউনুসের সাক্ষাৎ বা দুই দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনার খবর শোনা গেলেও, বর্তমানে কার্যকর কোনো কূটনৈতিক চ্যানেল তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এমনকি সীমান্তে পুশ-ইনের মতো ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর মতো ব্যবস্থাও দুর্বল। ফলে বাংলাদেশ এখন এক অস্বস্তিকর কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতার মধ্যে রয়েছে।
করণীয় কী? পাল্টা নয়, পরিণত কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বেফাঁস মন্তব্য এবং প্রতিবেশী দেশের সাথে কার্যকর আলোচনার অভাব এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের পর প্রথমে তেমন ক্ষতি হবে না বলা হলেও, পরে ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতির কথা স্বীকার করা হয়েছিল। এবার স্থলবন্দর দিয়ে প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলোতে নিষেধাজ্ঞা আসায় ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই অবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় কী? পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে হয়তো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এর পরিণতি হতে পারে আত্মঘাতী। বরং, পরিণত নেতৃত্ব এবং সুসংগঠিত কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে সম্পর্ক পুনর্গঠনই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান। ডক্টর ইউনুসের কিছু মন্তব্য সম্ভবত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে — সেই দায় এড়ানো কঠিন হবে।