অমৃত বাজার পত্রিকা, ২২/১০/১৯৪৬) স্টেটসম্যান পত্রিকার জনৈক সাংবাদিক নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্ত অঞ্চলে রিপোর্ট করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার সম্মূখীন হয়েছিলেন তা মধ্যযুগীয় মুসলমান শাসন ব্যবস্থা বা ইসলাম প্রতিষ্ঠাও ততপরবর্তী কালের আরব ইরান ও অন্যান্য অঞ্চলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি স্টেটসম্যান পত্রিকায় তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন এভাবে-
“নোয়াখালীর রামগঞ্জ থানার একটি বাচ্চা মেয়ে আমাকে এই ঘটনাটি বলেছিল।
১০ ই অক্টোবর সকালে একদল লোক ঐ মেয়েটির বাড়িতে এসে মুসলীম লীগের তহবিলে পাচ শ টাকা চাদা চায়। চাদা না দিলে বাড়ির সবাইকে খুন করা হবে বলে ওরা হমকি দেয়। প্রাণের ভয়ে মেয়েটির বাবা ওদের পাচশ টাকা দেন। এর কিছুক্ষন পর আবার ওরা আসে, সঙ্গে এক বিরাট জনতা। ঐ বাড়ির জনৈক অভিভাক, যিনি আবার পেশায় মোক্তার, ঐ উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে এগিয়ে যান, কিন্তু তিনি কোন কথা উচ্চারণ করবার আগেই তার মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর গুণ্ডারা পরিবারেরে সবচেয়ে বয়স্ক লোকটিকে (মেয়েটির দাদু) খুন করে। এবার মেয়েটির বাবার পালা, মেয়েটির বাবাকে তারাই সদ্য খুন হওয়া বাবার মৃতদেহের উপর শুইয়ে দেওয়া হল। তখন মেয়েটির ঠাকুরমা তার ছেলেকে বাচাবার জন্য ছেলের দেহের উপর ঝাপিয়ে পড়েন এবং ওদের কাছে ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে থাকেন। কিন্তু তাতে ওরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ঐ মহিলার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে এবং তার অচৈতন্য দেয় দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। এবার আবার ওরা মেয়েটির বাবাকে মারতে উদ্যেগী হয়। মেয়েটি ভয়ে এতক্ষণ ঘরের কোণে লুকিয়ে ছিল। বাবার প্রাণ বাচাবার জন্য সে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং ঐ ঘাতকের হাতে গহনা ও চারশ টাকা দিয়ে তাকে কাকুতি মিনতি করে আর বাবাকে না মারবার জন্য। ঐ ঘাতক তখন বা হাতে মেয়েটির কাছ থেক গহনাগুলি গ্রহন করে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাতের দা দিয়ে মেয়েটির বাবার মাথা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলে।”
(দি স্টেটসম্যান, ২৬/১০/১৯৪৬)অবিভক্ত বঙ্গ র দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত নোয়াখালী জেলার অতীব সংখ্যালঘু হিন্দু অধিবাসীরাও ছিলেন পুজার্চনায় ব্যস্ত। অকস্মাৎ রাত্রি র নিস্তব্ধতা খান খান করে ধেয়ে এলো কাশেম র ফৌজ, মুসলিম লীগ র নোয়াখালী অঞ্চলের নেতা কাশেম আলী র আদেশে। সঙ্গত দিল গোলাম সারওয়ার র নিজস্ব বাহিনী। উদ্দেশ্য – হিন্দু বিনাশ।আনুমানিক ৫, ০০০ হিন্দু খুন হন নোয়াখালি গণহত্যা র দরুণ; ৫০, ০০০-৭৫, ০০০ হিন্দু আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা প্রমুখ স্থানে অবস্থিত relief camp গুলিতে।
দুটি উদাহরণ বিশেষ দ্রষ্টব্য এই ক্ষেত্রে – অক্টবর ১১ – গোলাম সারওয়ার র মিয়াঁ র ফৌজ আক্রমণ করে শ্রী রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী, নোয়াখালী বার এসোসিয়েশন র সভাপতি ও হিন্দু মহাসভার জেলা সভাপতি, র গৃহ। সেই সময় তাঁর গৃহে অবস্থান করছিলেন স্বামী ত্র্যম্বকানন্দ, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। সমগ্র দিন রাজেনবাবু রাইফেল র সাহায্যে সেই আগ্রাসী বাহিনীর মোকাবিলা করেন। রাত্রে স্বামীজী ও পরিবার র বেশ কিছু সদস্যকে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেন। পরের দিন, ১২ ই অক্টবর, আরো বিশাল বাহিনী রায়চৌধুরী গৃহ আক্রমণ করে ও পরিবারের ২২ জন সদস্যদের হত্যা করে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রী রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী, শ্রী চিন্তাচরণ রায়চৌধুরী (তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) ও শ্রী সতীশচন্দ্র রায়চৌধুরী (তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা) …..রাজেনবাবুর মাথা কেটে একটি থালায় করে গোলাম সারওয়ার কে উপহার দেওয়া হয়।রায়চৌধুরী পরিবার র নারীদের ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেয় ইসলামিক বাহিনী।অক্টোবর ১২ – শায়েস্তানগর, রায়পুর পুলিশ স্টেশন অন্তর্গত, এ শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্তরায়চৌধুরী র গৃহ আক্রান্ত হয়। দত্তরায়চৌধুরী মশাই কলকাতায় থাকতেন, বৃদ্ধা মাতা তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন লক্ষীপূজা হেতু। পরিবার র সমস্ত সদস্যদের উনি বাড়ির ছাদে নিয়ে যান নিরাপত্তা র জন্য। একটি মাত্র রাইফেল র সাহায্যে উনি সমস্ত দিন অসীম সাহসে মুসলিম বাহিনী র মোকাবিলা করেন। শেষ পর্যন্ত, উপায় না দেখে, বৃদ্ধা মাতা, বাড়ির শিশুদের ও নিজে হত্যা করেন।
শ্রী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী /মহাত্মা গান্ধী তাঁর বিখ্যাত নোয়াখালী যাত্রা করেন অবস্থা কে আয়ত্তে আনার জন্য। কিন্তু ব্যর্থ হন প্রত্যেক প্রকারে। শ্রীমতি লীলা রায়, প্রখ্যাতা স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবিকা, গান্ধীজির দাঙ্গা-বিধ্বস্ত নোয়াখালীতে পদার্পণ র পূর্বেই, একক প্রচেষ্টায় relief camp খোলেন ও ৪০০ র অধিক অপহৃত হিন্দু নারীকে উদ্ধার করেন। প্রসঙ্গত, গান্ধীজির যাত্রায় অন্তর্ভুক্ত সাংবাদিকরা দেখেন আক্রান্ত ও ধর্মান্তরিত হিন্দুরা মনুষ্যেতর অবস্থায় বসবাস করছেন। যাঁরা তখনো সজ্ঞানে ছিলেন তাঁরা জানতে চান তাঁদের পরিণতি কি হবে। শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁদের উদ্দেশ্যে একটি পত্র প্রদান করেন, স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন – পরমপূজ্যপাদ শ্রী শ্রী শঙ্করাচার্য (পুরী), মহামহোপাধ্যায় শ্রী দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ততীর্থ, মহামহোপাধ্যায় শ্রী হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ সিদ্ধান্তবিদ্যালয়, শ্রী শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ, শ্রী গৌরী শাস্ত্রী, শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পত্রটিতে লেখা ছিল – না হিন্দু পতিত ভবেৎ – হিন্দু র পতন হয়না।বস্তুতপক্ষে, এই পত্রটি দেখেই নোয়াখালীর চরমতমভাবে নির্যাতিত হিন্দুরা নিরাপদ স্থান র উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করেন।
এবং এটাই ছিল বাঙালি হিন্দু র শেষ র যাত্রা র শুরু। যার প্রারম্ভ হয়েছিল বাংলায় ১৯৩২ সালে কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ডভারত রক্ষা আইন – ১৯৩৫, (১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ র আন্দোলন র হেতু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ (হিন্দু সমাজ র তীব্র বিরোধিতা সত্বেও) বিশ্ববিদ্যালয় র প্রতীক শ্রী-পদ্ম মুছে দেয়)- র মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশে বরিশাল গণহত্যা, ভৈরব ব্রীজ গণহত্যা, ১৯৬৪ র গণহত্যা, গোলাঘাট গণহত্যা, নাড়িয়া গণহত্যা, শাঁখারিকাঠি গণহত্যা, ঈশানগোপালপুর গণহত্যা, ডাকরা গণহত্যা, জাটিভাঙা গণহত্যা, মাকালকান্দি গণহত্যা, শতনিখিল গণহত্যা, গালিমপুর গণহত্যা, আদিত্যপুর গণহত্যা, সুত্রপুর গণহত্যা, সেন্ডিয়া গণহত্যা, কালীগঞ্জ গণহত্যা, কড়াই কাদিপুর গণহত্যা, চুকনগর গণহত্যা, ১৯৮৯-৯২ সালের হিন্দু র ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণ, বাঙালী হিন্দু আজ এক হতভাগ্য জাতিতে পরিণত হয়েছে। ছাগলনাইয়া, স্বন্দীপ অঞ্চলগুলি হল চরমতমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। পার্শ্ববর্তী টিপেরা জেলার হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর , লক্ষম ও চৌদ্দগ্রাম অঞ্চলগুলো হয়ে উঠলো উপদ্রুত। এক perfect planning র সাহায্যে Hindu racial extermination র পরিকল্পনা execute করা হল। এক সার্বিক হিন্দু গণহত্যা র দরুণ কতজন যে প্রাণ হারালেন, কত হিন্দু নারী হলেন ধর্ষিতা, কতজন কে জোর করে গরুর মাংস খাওয়ানো হল, কতজন পুরুষকে জোর করে সুন্নত করিয়ে মেরে ফেলা হল, কতজন হিন্দু নারীকে গণধর্ষণ করে পা দিয়ে তাঁদের মাথার সিঁদুর ডলে দেওয়া হল, কতজন চিরতরে হারিয়ে গেলেন, কতজন হিন্দু নারী এক লহমায় গৃহবধূ থেকে গনীমতের মালে রূপান্তরিত হলেন তার হিসেবে গত ৭৫ বছরেও পাওয়া যায়নি ।