প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তথাকথিত বামপন্থী ভাবাদর্শের আধিপত্য বিদ্যমান থাকায় সমগ্র ভারতবর্ষ না হলেও এই রাজ্যে এমন একটি ধারণার জন্ম হয়েছে ( বা পরিকল্পনা মাফিক জন্ম দেওয়া হয়েছে) যে বুদ্ধিজীবী মাত্রেই কম্যুনিস্ট । বলাই বাহুল্য এর চেয়ে হাস্যকর চিন্তাভাবনা অত্যন্ত বিরল। সমগ্র বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষকে যাঁরা তুলে ধরেছিলেন বা তুলে ধরতে পেরেছিলেন সেই স্বামী বিবেকান্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়, কেউই বামপন্থী ছিলেন না । বিবেকানন্দের মৃত্যুর (১৯০২) অনেক আগেই সমগ্র বিশ্বে মার্ক্সবাদ নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়েছিল। ১৮৭১ এর প্যারিস কমিউন, ( ২৬ মার্চ থেকে ৩০ শে মে) , শ্রমিকশ্রেণির প্রথম সফল বিপ্লব ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধিজীবী মহলে সোরগোল ফেলে দিয়েছিল। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়াতে বলশেভিক পার্টির আত্মপ্রকাশও একটি যুগান্তকারী ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। না, স্বামীজী তবু শ্রেণি সংগ্রাম নয়, শ্রেণি সমন্বয়ের কথাই বার বার বলে গেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী তোমার রক্ত, তোমার ভাই। আর রবীন্দ্রনাথ? বামপন্থার আন্তর্জাতিক সাফল্যের বাতাবরণেই তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে। বলশেভিক বিপ্লবের ( ১৯১৭) পরবর্তী ইউরোপ তথা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, নাজিবাদ তথা ফ্যাসিবাদের উত্থান এসবই তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছিল বলা যায়। মুশোলিনির ইতালি থেকে লেনিনের রাশিয়া তাঁর ভ্রমণসূচীতে কোনো পক্ষপাতিত্বও ছিল না। মুসোলিনির আতিথেয়তা তথা নিয়মানুবর্তিতায় মুগ্ধ হওয়া ( যদিও রোমা রোঁলা তাকে বেশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে “সঠিক” মূল্যায়ণে সহায়তা করেন) , রাশিয়ার চিঠিতে সমসাময়িক সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবেশ তথা শিক্ষাব্যবস্থা সব কিছুতেই তিনি তাঁর মূল্যবান মতামত রেখে গেছেন। কিন্তু বামপন্থী? নৈব নৈবচ! তিনি ওপথ মাড়ান নি! আর সত্যজিৎ রায়? তাঁর জীবনের সিংহভাগই তো বামপন্থার ছত্রছায়ায় কেটেছে। যুক্তফ্রন্টের জন্ম, সত্তরের টালমাটাল নকশালবাড়ি আন্দোলন, বরানগর, কাশীপুরের গণহত্যা, পরিশেষে ১৯৭৭ এ পশ্চিমবঙ্গে একটি বামপন্থী দলের চোখধাঁধানো সাফল্য — এত কিছু চাক্ষুষ করার পরেও তিনি ও পথ মাড়ান নি। ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনেরা যেপথে হেঁটেছেন তিনি ঠিক তার বিপরীত পথই বেছে নিয়েছেন। অথচ চরম নিন্দুকও বলবেন না তিনি একজন রাজনৈতিক চেতনারহিত পরিচালক ছিলেন। তাঁর প্রখ্যাত রাজনৈতিক ট্রিলজি প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ এবং জন অরণ্য তার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। প্রতিদ্বন্দ্বী চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে( প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তরে বোমা বিস্ফোরণ এবং তার পর এক পাগলের আবির্ভাব) তিনি নাকি নকশালপন্থী আন্দোলনকে উন্মাদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এমনটাই বিশ্বাস। যদিও ১৯৪৯ সালে মার্ক্সবাদী নামক একটি স্বল্প পরিচিত পত্রিকায় তিনি ২০০০ শব্দের একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন বলে জানা যায়। বিষয় — সাহিত্য এবং দর্শনে শিল্পীর সংগ্রাম। সেখানে তিনি সর্বহারা শ্রেণির প্রতি শিল্প তথা শিল্পীর দায়বদ্ধতার উপর জোর দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মোহভঙ্গ হওয়ার কারণেই তাঁর কার্যকলাপে এই আদর্শের কোনো ছাপ লক্ষ করা যায়নি। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি একজন প্রগতিশীল মানবতাবাদী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর একটি বক্তব্য এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
” সত্যজিৎবাবু বামপন্থী ছিলেন বলে জানি না। বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে ওঁর কোনো যোগ ছিল বলেও শুনিনি। উনি প্রগতিশীল ছিলেন। ওঁর নতুন চিন্তধারার সব কটি ছবিতে প্রগতিশীল মনোভাব পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।”
না, সত্যজিৎ রায়ও শেষপর্যন্ত “বামপন্থী” হন নি। ভাগ্যিস হন নি।