হেমলকের পেয়ালা হাতে নাস্তিক এর সন্ধানে সক্রেটিস ঘাতকের প্রেতাত্মারা।

হেমলকের পেয়ালা হাতে নাস্তিক এর সন্ধানে সক্রেটিস ঘাতকের প্রেতাত্মারা। ৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার আন্দোলন এর আত্মপ্রকাশ ঘটলো, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এর ধমনীতে এর ঢেউ যেন  জোয়ার হয়ে ফুঁসে উঠলো । দেশের প্রতিটি ঘরে-বাইরে এই জোয়ার যেভাবে বইতে থাকলো তা আম জনতার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিল এক ভয়ংকর মুক্তিকামী নেশা । তখন আমি প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র ।

 

রাজনীতি কি, এবং কাকে বলে তা বুঝতে শিখলাম প্রতিদিন সৈয়দপুরের মত একটি মফস্বল শহরে সকালে আসা আগের দিনের দৈনিক পত্রিকা আজাদ ও মর্নিং নিউজ ( MORNING NEWS ) এর ব্যানার হেডিং গুলো পড়ে ।

এই নিউজগুলো পড়ার জন্যে আব্বার  ডিসপেনসারিতে  ( ডাক্তারখানা ) সকাল – বিকেল জড়ো হতো  প্রখর রাজনৈতিক চেতনায় উদবুদ্ধ অসংখ্য কৌতুহলী মানুষ । প্রতিদিন রেডিও সংবাদ বা পত্রিকায় ৬ দফার আন্দোলনের সংবাদ  ( এবং পরবর্তীতে ৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সংবাদ্গুলোও ছিল এমনই উত্তেজক) শোনার নেশায় যেন সকাল – সন্ধ্যা বুঁদ হয়ে থাকতেন এলাকার সব বাঙালি ।

 

সন্ধ্যায় শুনতেন আমাদের   চার ব্যান্ডের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের মারফি( MURPHY ) রেডিওতে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ ।

সকালে একজন উঁচু স্বরে পত্রিকা পড়তেন আর বাকি সবাই তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন । তখনই জানলাম , রাজনীতি কি এবং কাকে বলে । তখন কে আওয়ামী লীগ , কে ন্যাপ, কে মুসলিম লীগ, কে কমিউনিস্ট পারটি, কে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন করতো । পাড়ার কোন চাচা এবং বড় ভাইয়েরা বাম রাজনীতি বা কমিউনিস্ট পার্টি , ছাত্র ইউনিয়ন করতেন , তা সবার কাছেই ছিল বিশেষভাবে চিহ্নিত । তবে কমিউনিস্ট, ন্যাপ , ছাত্র ইউনিয়ন বা যে যেই পার্টিই করুক না কেন সবারই নিরংকুশ সমর্থনটা ছিল ৬ দফা বা শেখ সাহেবের প্রতি । তখন শেখ মুজিবকেই বলা হতো শেখ সাহেব ।

 

তখন  কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত এবং সবার কাছেই পরিচিত এলাকার বড় ভাই ও চাচারা    মোটা মোটা লাল বই পড়তেন । তারা খুব অধ্যাবসায়ী ও মেধাবি হিসেবেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন । তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক আকর্ষণীয় বাংলা তথ্য মাগাজিন পত্রিকা পড়তেন । তার মধ্যে সোভিয়েত নারী নামের একটা ম্যাগাজিন শফিক চাচা আমাদের বাসায় নিয়মিত দিয়ে যেতেন ।

ধর্মান্ধ গোষ্ঠী
ধর্মান্ধ গোষ্ঠী

আমরা তা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাম এবং সেখানকার নারী ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে খুবই আকৃষ্ট হতাম । তখন মনের মধ্যে খেয়াল চাপতো , আহা ! এমন একটি উন্নত দেশে যদি একবার যেতে পারতাম যেমন পাড়ার অন্যান্য ভাইয়েরা গিয়েছে সেই দেশে স্টুডেন্ট হিসেবে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে । আমাদের বাসায় আরো অন্যান্য সোভিয়েত ম্যাগাজিন দেয়া হতো । এই মুহূর্তে সবগুলর নাম মনে পড়ছে না ।

 

তবে ঐ মোটা মোটা লাল বই গুলো তারা ছাড়া  আর  অন্য কেউ পড়তো না । পড়ার আগ্রহও বোধ কেউ করতো না । তখনই শুনেছিলাম, ঐ বইগুলো নাস্তিকেরা পড়ে । সাধারণ মানুষেরা পড়ে না এবং বুঝেও না । খুব জ্ঞানী ছাড়া  ঐ বই এর মর্ম বোঝাও দুঃসাধ্য । যেমন ঐ বই পড়ুয়াদের কথায় কথায় বুর্জোয়া , পেটি বুর্জোয়া, পুঁজিবাদ , ধনতন্ত্র , শ্রেনী সংগ্রাম , সমাজতন্ত্র,  সাম্যবাদ, সর্বহারা , প্রলেতারিয়েত, পলিটব্যুরোর মত  উচ্চারিত জটিল শব্দগুলো সবাই বুঝতো না । তাই ওই ধরনের বই পড়ার আগ্রহ ও ধৈর্যও কারো ছিল না । তাদের মুখে খুব উচ্চারিত হতো, লেলিন, মাও সেতুং, কার্ল মার্ক্স প্রমুখ নেতা ব্যক্তি ও লেখকের নাম ।

 

তখন শুনতাম, শুধু নাস্তিকেরাই কমিউনিস্ট পার্টি করে এবং  ওই বইগুলো পড়ে । আসলে ওদের কাজটা কী ? ওদের সম্পর্কে সবাই বলতো, ওরা ধর্ম- কর্ম করে না । নামায ইবাদত-বন্দেগী থেকে ওরা  দূরে । তাই ওদেরকে মানুষ নাস্তিক বলে ।

কিন্তু সবাই এ কথা জানতো এবং স্বীকার করতো যে, ওই লোকগুলো খুবই মেধাবী । অগাধ জ্ঞানও পান্ডিত্যের অধিকারী । স্বভাবে এবং চলনে-বলনে অত্যান্ত মৃদু ভাষী সজ্জন । পরনে পাঞ্জাবী-পায়জামা, ঘাড়ে ঝোলানো মোটা মোটা  লাল বই এর ব্যাগ ।  তারা গান-বাজনা করতেন । ছিলেন সংস্কৃতিসেবী । গান, ছড়া , কবিতা গল্প ও নাটক লিখতেন ।  অভিনয় করতেন । রেডিওর গীতিকার – নাট্যকার ছিলেন । সাংবাদিকতাও করতেন । নিজের লেখা বইও প্রকাশ করতেন , যে গূণগুলো অন্য সাধারণের মাঝে দেখা যেত না ।

আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের শাসন ও শোষন  ব্যবস্থা
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের শাসন ও শোষন  ব্যবস্থা

পাড়ায়-মহল্লায়  নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে এদের সক্রিয় ও অগ্রনী ভূমিকা ছাড়া কল্পনাই করা যেত না কোন অনুষ্ঠান । সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এরা ছিলেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব । তখন আমরা উদীচীর নাম শুনতাম । ওদের সরব কর্মকাণ্ড দেখতাম । রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়া আর যে সব গান তারা শুনতেন এবং গাইতেন তখন  কিশোর বয়সে  তা আমাদের মোটেও আকৃষ্ট করতো না । বুঝতামও না ।

২১ শে ফেব্রুয়ারীর দিন পাড়ার সবাইকে নিয়ে দল বেঁধে  খালি পায়ে  প্রভাত ফেরিতে সামিল হয়ে গান গাইতে গাইতে মিনারে গিয়ে ফুল অর্পণ করার দায়িত্বগুলো তারা যেন নিজের এক মহান ব্রত হিসেবেই পালণ করতেন । এ ক্ষেত্রে শামসুল ভাই ছিলেন অগ্রনী । তাদের হাতের লেখা ছিল অসাধারণ সুন্দর । তাদের হাতে লেখা পোস্টার – প্ল্যাকার্ড গুলো আমরা নিজ হাতে বহন করতাম  মৌণ শভাযাত্রা বা প্রভাত ফেরীতে ।। 

 

এই মানুষগুলো ছিলেন সমাজের সুশৃঙ্খল  ও নান্দনিক জীবনাচারের অনুপম প্রতীক । এ কারণেই তাদের প্রতি ঘৃণা –  কটু সমালোচনা তো দূরে থাক,  সমাজের  সর্বত্রই    ছিল তাদের শ্রদ্ধার আসন । কারো সঙ্গে তাদের ঝগড়াঝাটি – বিরোধ আমরা দেখিনি । মিষ্টভাষী হিসেবে  সবার সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ ।যে কারো বিপদে তারা এগিয়ে আসতেন সবার আগে । তারা করতেন না কোন জাত-পাত বিচার ।সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকা উদার ও অনন্য মানসিকতার মানুষ ছিলেন তারা ।   

 

প্রতিবেশী , কারো  বন্ধু বা সহপাঠী হিসেবে  তাদের বাসায় গেলে দেখতাম পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ঠিকই নামায-কালাম ও কোরান পাঠ নিয়মিতই করছেন । রোজা রাখছে্ন । একই সাথে নাস্তিক চাচাও বসে ইফতার করছেন । ঈদের দিন আমরা সবাই এক সাথে দল বেঁধে গিয়েছি  নামাযে । কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়তো না । পাড়ায় কারো বাসায় মিলাদ মাহফিল বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দেখতাম তাদের । মুখে ঠিকই শুনতাম আল্লাহ-খোদার নাম ।

স্বাভাবিক কথা বার্তার মধ্যে – আল্লাহ খোদার নাম নাও, ভরসা রাখো আল্লাহর ওপর । আল্লাহর নাম নিয়ে যাও পরীক্ষার হলে । এবার রেজাল্ট ইনশা আল্লাহ আগের চেয়ে ভাল হবেই । May god bless you. এমন সব ইশ্বর ভক্তির সব বচনগুলোই শুনতাম তাদের মুখে। তবুও  শুনতাম , মানুষটা নাস্তিক । আল্লাহ-খোদা ও ধর্মে বিশ্বাস করে না । কিন্তু আমরা কোনদিন কারো মুখে তাদের ধর্ম বিরোধী কথা বা আচার-আচরণের নজির  দেখি নি । তাহলে লোকটাকে নাস্তিক বলা হতো কেন, তা আমাদের বোধগম্যের বাইরে ছিল ।

 

মৌলবাদ থেকে পরিত্রাণের উপায়
মৌলবাদ থেকে পরিত্রাণের উপায়

ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় ফলাফল ভাল করলে মৌলানা ডেকে তাদের বাসায়ও মিলাদ শরীফ পড়ানো হতো । আমরাও তাতে শরিক হতাম জিলাপি খাওয়ার লোভে । তবে বুঝতে পারতাম না তথাকথিত এই নাস্তিক লোকগুলোর গলদটা কোথায় ?

 

কিন্তু তাদের সম্পর্কে বড় বা অন্য কারো সামনে আমাদের ছোটদের নাস্তিক শব্দটা মুখে উচ্চারণ করাটাও যেন পাপ ছিল ।সম্মান বৈ অসম্মান করার ধৃষ্টতা প্রদর্শনের মনোভাব তখনও সমাজে কারো ভেতর ছিল না । সমাজের আর দশটা মানুষের মতই  সবাই মিলে মিশে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত  ছিল সবাই।

 

তবে তখন এই মানুষগুলোর ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে কোথাও তেমন বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে না উঠলেও আজ এতদুর সামনে একবিংশ শতাব্দীতে এসে পেছনের দিকে তাকালে –  প্রথাবিরোধী লেখক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর দৃষ্টান্ত সামনে এসে যায় । এরা ছিলেন সমাজে তাদের সময়ের চেয়ে অত্যান্ত প্রাগ্রসর চিন্তা- চেতনার মানুষ । ছিলেন অসময়ে কালোত্তীর্ণ সময়ের প্রতিভূ । ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে নজরুল ওয়ালিউল্লাহ কী চাবুক্টাই না মেরেছেন অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার, কুপুমুন্ডুকতা ও ভন্ডামীর বেদীমূলে । তখনও একদল কুপুমুন্ডুক ক্ষেপেছেন । তার ক্রিয়া-বিক্রিয়া হয়নি ততোটা ধ্বংসাত্মক । তার কাছে সত্যের তরবারি ছিল তীক্ষন ও ধারালো । প্রতিক্রিয়াশীলরা পারেনি জয়ী হতে ।

 

 সমাজের তথাকথিত এই নাস্তিক ব্যক্তিরাই ছিলেন ধারালো তরবারির মতই তীক্ষন বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ।   তাই তাদেরকে বলা হতো কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করা মুক্ত চিন্তার মানুষ । সহজ কথায় প্রগতিশীল মানুষ । কখনও শোনা যায়নি এরা ধর্ম দ্রোহী মানুষ। এরা কেউ কেউ হয়তো ছিলেন ধর্মকর্ম নিয়মিত অনুশীলনে বিরত  এবং ধর্মীয় গোড়ামি বিরোধী । মানুষের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগার মত ছিল না এদের পার্থিব বিশ্বাস ও জীবনাচার ।

আমাদের সমাজে তখনও ছিল  মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম ও নেজামে ইসলামের মত মৌলবাদী ধর্মীয় সংগঠণ। ছিল সবারই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ।

 

কিন্তু বর্তমান সময়ের মত  ধর্মান্ধতার বিষবৃক্ষের ছায়া কোথাও ছিল না । নাস্তিক-আস্তিক নিয়ে সমাজে কোন অবাঞ্ছিত প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেনি । বড় জোর কেউ কোথাও হয়তো হতেন মৃদু টিপ্পনীর শিকার । কিন্তু তা গ্রাহ্য করার মত কিছুই ছিল না ।এদেরকে নিয়ে কোথাও কোন বিতর্ক, ফ্যাসাদ ও বিরোধ সৃষ্টির নজির দেখতাম না । কিন্তু এখন ?

এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে , দেশে ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যে রাজনৈতিক  অপশক্তি ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করে মৌলবাদী চেতনার বিস্তার ও শেকড় প্রোথিত করার মধ্য দিয়ে  –  সমাজের প্রগতিশীল মানুষগুলোর অসাম্প্রদায়িক চেতনা্য দেশ গঠণের অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে চায়, তাদেরই মাথায় উদ্দেশ্যমুলকভাবে পশ্চাদপদ মৌলবাদী  ধর্মান্ধ গোষ্ঠী নাস্তিকতার কলংক তিলক পরিয়ে দিয়ে ধর্ম ভীরু মানুষকে বিপথগামী ও নিজেদের অনুকুলে নেয়ার ঘৃণ্য প্রয়াসে তৎপর , তারা চায় সমাজ প্রগতির পথ রুদ্ধ করে দিতে  ।

 

এরা অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে নাস্তিক ও কাফেরের অভিধায় চিহ্নিত করে এদের দোসর হিসেবে প্রগতিবাদী মানুষগুলোকে  এক কাতারে ফেলে সমাজে উন্মাদনা ছড়িয়ে যে ফায়দা হাসিল করতে চায় , সে দিকে নজর দিলেও এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ও কুপমুন্ডকতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না ।  একটি উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হয় ।যে আমেরিকাকে এরা নাস্তিক ও কাফের বলে আখ্যা দেয়, সেই আমেরিকাতেও ধর্ম – কর্মের জন্যে, গির্জা,  সিনাগগ, মসজিদ , মন্দির, প্রভৃতি উপাসনালয় আছে । সেখানকার তথাকথিত নাস্তিকেরাও তাদের ধর্ম কর্ম পালণ করে কিংবা কারো ধর্মীয় মূল্যবোধ  লালন ও অধিকার চর্চায় আঘাত হানার কথা চিন্তাও করে না ।

 

এ ছাড়াও  দৈনন্দিন জীবনে কাজে কর্মে অবচেতন ভাবে ধর্ম – বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মুখ দিয়ে যে মহান সৃষ্টি কর্তার নাম উচ্চারিত হয়, তা থেকে তথাকথিত নাস্তিকও বাদ যায় না । তাহলে এই নাস্তিক খেতাব দেয়ার অধিকার ভোগ করে কিভাবে
কুপমুন্ডুকেরা ।

আমেরিকার টাকা বা ডলারে লেখা থাকে – ইন গড উই ট্রাস্ট ( IN GOD WE TRUST ). এমন একটি ধর্ম বিশ্বাসের  উৎকীর্ণ  নজির কী  আমরা ইসলামিক কোন বি্ষয় আশয়ের মধ্যেও খুঁজে পাই ? ধার্মিক মুসলমান হয়েও বিপদ্গ্রস্থ মুসলমানেরা  পৃথিবীর কোন মুসলিম দেশে আশ্রয় পায় না , তারা ঠিকই ইউরোপ, আমেরিকার মত তথাকথিত নাস্তিক দেশগুলোতেই আশ্রয় নিচ্ছে এবং পাচ্ছে বেশুমার । তাতে তাদের ধর্ম নষ্ট হচ্ছে না । নাস্তিকদের সংস্পর্শে থেকে তারা নাস্তিকও হচ্ছে না । উপরন্তু তারা ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করছে  যে কোন মুসলিম দেশের চেয়েও বেশি ও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিয়ে ।

 

কিন্তু বাংলাদেশে আজ –   স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর রাস্ট্রেরই প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় ও নতজানু আনুগত্যের সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী ও অন্ধকার যুগের ধ্যান ধারণার জীবন্ত প্রতীক চরম এক মৌলবাদী অপশক্তি যারা আমাদের হাজার বছরের লালিত বিশ্বাস, আবহমান কালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের শাসন ও শোষন  ব্যবস্থা,  তারা আজ  প্রবল পরাক্রমে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ।

নারী সম্পর্কে এদের দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই নিকৃষ্ট ও কুরুচিপূর্ণ যে যার নজির এ অঞ্চলের ইতিহাসে কোন তথাকথিত শীর্ষ ধর্মীয় নেতার মুখ থেকে শোনা যায়নি । নারীকে এরা তুলনা করেছে তেঁতুল এর সাথে । নারীকে দেখা মাত্রই  বৃদ্ধ পুরুষেরও কামোদ্দীপনায় মুখ দিয়ে লালা ঝরে। যার লালা নির্গত হয় না, সে পুরুষ নপুংশক অথবা বুঝতে হবে সে ধ্বজভঙ্গ রোগের শিকার । নারী সম্পর্কে এমন কদর্য  ও কুরুচিপূর্ণ মনোভাব এর কথা সভ্য জগতে আজ পর্যন্ত কোন লম্পটের মুখেও কেউ শোনেনি ।

 

আর তাই নারীর জন্যে শিক্ষা ও চাকুরী হারাম । যারা চাকুরী করে তারা বাইরে পর পুরুষের সঙ্গে জেনা করে অর্থ উপার্জন করে । এ হলো তাদের কুরুচিপূর্ণ পঙ্কিল মানসিকতা ও জীবন দর্শনের মাত্র একটি উল্লেখিত দিক। বাকি বিষয়গুলো আলোচনা করার জন্যেও মানুষের অপরিসীম  ধৈর্য , সংযম , সহিষনুতা ও রুচির প্রয়োজন তা আমার মত অনেকেরই নেই  । আমরা ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে পেশ করা তাদের ১৩ দফা ও পাঁচ দফা সম্পর্কে জেনে নিয়েছি । এই উন্মাদ অপশক্তির স্বরূপ বোঝার জন্যে এই দফাগুলো জানাই যথেষ্ট।

এদের চাপে পড়ে  চলমান সভ্যতার সময়, কাল ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ন্যায় বিচারের স্মারক  স্তম্ভ – ভাস্কর্য   অপসারন এবং আমাদের সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্য পুস্তকে ধর্মান্ধ দর্শন প্রতিষ্ঠার ন্যাক্কারজনক নাশকতা চালানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধেও সভ্য সমাজের দাবি  নির্বিকারভাবে  উপেক্ষিত হয়েই আসছে । শাসক গোষ্ঠী স্পষ্টতই ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার বিরল ত্যাগের মহীমা ও চেতনাকে জলাঞ্জলী দিয়ে যেন ধর্মান্ধ সমাজ ও দেশ গঠণের মহান ব্রত নিয়ে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন ।

 

যারা ধর্মের নামে যুগ যুগ ধরে ঘৃণ্য ব্যবসা, ফতোয়াজারি ও পাপাচার চালিয়ে আসছে  নির্বিঘ্নে , সেই অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে যাদেরকে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে বর্বরোচিত পন্থায় হত্যা করা হয়েছে, তাতে তারা অর্থাৎ ঘাতক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী শুধু উল্লসিতই নয় , সরকারের কাছে তারা যে ৮৪ জন  ব্লগার ও মুক্তচিন্তার তথাকথিত নাস্তিক মানুষের তালিকা দিয়েছিল শায়েস্তা করার জন্যে , তাদের মধ্য থেকেই ইতোমধ্যেই দশজন  নির্দয়  হত্যার শিকার হয়ে ধরাধাম, ত্যাগ করেছেন।

বর্বর অপশক্তিকে খুশি রাখার জন্যে কিছু হয়েছেন সরকারের জেল-জুলুমের শিকার । কিছু হয়েছেন দেশত্যাগী। কিছু হয়েছেন নিজ ভুমে পরবাসী ফেরার আসামি । যারা   আত্মগোপন করে কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন ।

 

জীবনের এই নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়ে তথাকথিত নাস্তিকেরা আজ যেন চুপসে গেছে । উপায় নেই তাদের । একটি স্বাধীন রাস্ট্রে স্বাধীনতার সূর্য সন্তান মুক্তমনাদের সদর্প অবস্থান হয়েছে ভয়ংকর রূপে ঝুঁকিপূর্ণ ।  রাস্ট্রীয় মদদে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী উন্মাদ অপশক্তির জন্যে দেশটি হয়ে গেছে আজ অভয়ারণ্য।

কে ভেবেছিল এবং চেয়েছিল অধঃপতিত এই স্বাধীন বাংলাদেশ ? স্বাধীনতার মূলমন্ত্র- বাঙ্গা্লি জাতীয়তাবাদ , ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র , এই চারটি মূল স্তম্ভ নিয়ে বাংলাদেশ নামের যে রাস্ট্রটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, তা আঁতুড় ঘরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে ঘাতক অপশক্তির হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার পর । রাষ্ট্রধর্ম হয়ে গেছে ইসলাম। সংবিধানের মাথার ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে বিসমিল্লাহ ।

 

জাতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বসেছিল আশায় । একদিন অপশক্তির রাহুর হাত থেকে মুক্ত হবে বাংলাদেশ । স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি আসবে ক্ষমতায় । বাস্তবায়িত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপ্নের বাংলাদেশ । সেই বুক ভরা আশা নিয়ে জাতি বার বার ভূমিধ্বস বিজয় মাল্য পরিয়ে দিয়েছে আওয়ামীলীগের গলায় । কিন্তু এ কী দশা দেখছি আমরা ? ফিরে যাওয়া হলো না পুরোপুরি কোনটাতেই ।
ইসলাম ও বিসমিল্লাহ স্বমহীমায় রয়েই গেল সংবিধানে ।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে বর্বর হামলা, মামলা, উচ্ছেদ, জবরদখল মায় অবর্ণনীয় অত্যাচার । অনেকেই হচ্ছেন দেশ ত্যাগী । ভয়াবহ ভঙ্গুর হয়ে গেছে তাদের নিরাপত্তার শৃঙ্খল ।

 

ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন ও জাতির চাওয়া পাওয়া বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জায়গাটা শূন্যই রয়ে গেল । সেই শূন্য  জায়গায় এসে আজ  বসে গেছে ধর্মান্ধ অপশক্তি হেফাজতে ইসলাম । চাওয়া মাত্রই একে একে তাদের দাবি রাজকীয়  মর্যাদার   সাথে পূরণ করা হচ্ছে ।  আর অপরদিকে প্রগতিশীল, মুক্তমনা , মুক্তিযোদ্ধা সূর্য সন্তানের কপালে জুটছে নাস্তিক , দেশদ্রোহী ও ধর্ম বিরোধীর কলংক তিলক।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে বর্বর হামলা
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে বর্বর হামলা

তার সাথে   কেউ সাব্যস্ত হচ্ছেন কাফের, কেউ মুরতাদ, কেউ বা অবাঞ্ছিত । এর বিপক্ষে নেই রাস্ট্র যন্ত্রের কঠোর অবস্থান ।উপরন্তু তাদের ঘায়েল করার জন্যে প্রবর্তন করা হয়েছে ভয়ংকর এক ধারা । যার নাম ৫৭ ধারা । রক্ষা নেই কারো । কার দুঃসাহস আছে, অপ্রিয় সত্যটি উচ্চারণ করে ৫৭ ধারা এড়িয়ে যাবার ?

যে কুপমুন্ডুক মতলববাজ ধর্মান্ধদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সক্রেটিসকে বিপথগামী নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী এর কলংক তিলক মাথায় নিয়ে শাস্তিস্বরূপ হেমলক বিষের পেয়ালা গলাধঃকরণ করে বিদায় নিতে হয়েছিল ধরাধাম থেকে , আজ বাংলাদেশেও ঠিক সেই ধর্মান্ধ প্রেতাত্মারা সক্রেটিসের মহাপ্রয়াণের পর হতে নাস্তিকের সন্ধানে থেকে তার অস্তিত্ব খুজে পেয়েছে শহীদের রক্তাক্ত মাটির বধ্য ভূমিতে । যে বধ্যভূমি পরিণত হয়েছিল আমাদের আত্মত্যাগের তীর্থ স্থানে, সেখানে আজ আবার হায়েনা শকুনেরা এসে জড়ো হয়েছে ধর্মদ্রোহী নাস্তিকের সন্ধানে । তারা উন্মত্ত হয়েছে নাস্তিকের লাশ খুবলে খুবলে খাবার পৈশাচিক নেশায় ।

 

নিজের অকৃত্রিম ধর্মীয় মুল্যবোধকে তুলে ধরে একটি ক্ষুদ্র অপশক্তির কাছে প্রিয় ও আস্থাশীল হয়ে ভোটের রাজনীতিতে ফায়দা লোটার যে ভ্রান্ত কৌশল নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ছক কষছেন ক্ষমতাসীন শাসক দল, তার মূল্য জাতিকে কতটা ভয়াবহ বিপদ ও ক্ষতির  মোকাবেলা করে  পরিশোধ করতে হবে তার সূচনা দেখেও তা না দেখার এবং বোঝার ভান করে যারা দিবা স্বপ্ন দেখছেন , তাদের এ স্বপ্নভঙ্গ দ্রুত সময়ের মধ্যেই ঘটবে । ততক্ষণে দেশটার হয়ে যাবে ব্যাপক ক্ষতি আর নাস্তিকেরা তখন কী করবে ? তালিয়া বাজাবে ?

Delwar Hossain
স্টকহোল্ম, ২০১৭,০৬,১২

আরো পড়ুন….

রাষ্ট্রভাবনা রবীন্দ্রনাথ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।-দুরর্ম

বাংলার আত্মঘাতী সেক‍্যুলার সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির জগতে স্বামী প্রণবানন্দ এক উপেক্ষিত চরিত্র। 

কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কারক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী-দূরর্ম

খাবার স্যালাইনের ফর্মুলা আবিষ্কারক হেমেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জী, কেন বর্ণ-বৈষম্যমূলক ভাবধারা শিখার…

রাজা রামমোহন রায় : ভারতীয় রেনেসাঁর জনক-দূরর্ম