আসুন দেখি বর্তমান সময়ে সংস্কৃতি ভাষার প্রযোজন আমাদের জীব থেকে ফুরিয়ে গিয়েছে কি? পশ্চিম বাংলার বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষদের আচার, আচরণ এবং কর্মকাণ্ড দেখলে অনেকটাই হতাশ হতে হয়। আসলে সেই সকল মানুষদের সাথে দূর থেকেই মেলামেশা করা ভাল; গভীরভাবে মিশতে গেলে হতাশা আরো গভীরতম হয়ে যায়।
কিছুদিন আগে পশ্চিমবাংলার একজন নামকরা সংস্কৃতের অধ্যাপকের সাথে সংস্কৃতের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা হচ্ছিলো, তো তিনি কথাপ্রসঙ্গে যা বললেন তাতে হতভম্ব হওয়া ছাড়া আমার কোন উপায় ছিলো না।
তিনি বল্লেন- কুশল সংস্কৃত কে পড়বে বা কেনই পড়বে! কেই বা চায় তার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাক। এবং এর পরে ছেলেমেয়ে যে কথিতো ভালভাল পর্যায়ে আছে তার ফিরিস্তি দিলেন। আমি ভাবলাম এর লেখা বই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি এবং পড়াচ্ছি, তার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে এতদূর থেকে দেখা করতে এসেছি।
অথচ এই মানুষটাই কিনা সংস্কৃতকে নিয়েছেন শুধুমাত্র একটা পেশা হিসেবে, আর পেশার খাতিরেই যতটুকুন লোকদেখানো ভালবাসা প্রয়োজন ততটুকুনই আছে ; এর বেশী নয়। অথচ ভারতের জনজীবনে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক প্রায় সকল ক্ষেত্রেই জানা বা অজানাভাবে ছেয়ে আছে সংস্কৃতের ব্যবহার।
ভারতের সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের লোগোতে উজ্জ্বলিত হয়ে আছে সংস্কৃতের ব্যবহার। তার সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি –
১. ভারতের জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় স্তুতি “জনগণমন ‘এবং “বন্দে মাতরম্” এর উপরে সংস্কৃতের প্রভাব অসীম। এ সংগীত দু’টি নামে বাংলা হলেও প্রায় সংস্কৃতই বলা চলে।
২. ভারতের সুপ্রীম কোর্টের মাথার উপরে মহাভারতের ভীষ্মপর্ব থেকে নেয়া, “যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ” এই অসাধারণ সংস্কৃত বাক্যটি খোদিত আছে। যার সরল অর্থ হলো যেখানেই ধর্ম, সেখানেই জয়।
৩. ভারতের লোকসভার আদর্শ স্থির করা হয়েছে মহাভারতের – ” ধর্মচক্র-প্রবর্তনায়।” বাক্যটি। অর্থাৎ লোককল্যাণে ধর্মচক্র প্রবর্তিত হয়েছে।
৪. ভারতের কেন্দ্রীয় লোকসভা এবং পশ্চিম বাংলার বিধান সভা ভবনের দ্বারদেশে আছে মহাভারতের আরো একটি বিখ্যাত শ্লোক-
” ন সা সভা যত্র ন সন্তি বৃদ্ধাঃ
ন তে বৃদ্ধা যে ন বদন্তি ধর্মম্।”
৫. অথর্ববেদের শৌনকীয় শাখার অঅন্তর্গত মুণ্ডক উপনিষদ (০৩. ০১. ০৬) থেকে নেওয়া ভারত প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীকের সাথে যুক্ত হিরন্ময় বাক্যটি-
” সত্যমেব জয়তে”
অর্থাৎ একমাত্র সত্যই জয়লাভ করে, মিথ্যা নয়। যদিও এ বেদবাক্যটি থাকা উচিৎ ছিলো অশোক স্তম্ভের সিংহের মাথার উপরে ; কিন্তু দুঃখজনকভাবে আছে সিংহের পায়ের নিচে। বেদমন্ত্র পশুদের পায়ের নিচে, এটা বেদমন্ত্রের, বেদমাতার অপমান।
৬. আকাশবাণীর আদর্শ গৃহীত হয়েছে- ” বহুজনসুখায় বহুজনহিতায়” এ অনন্য সর্বজনীন সংস্কৃত বাক্যটি।
৭. শিব স্তোত্র থেকে নেওয়া দূরদর্শনের -এর motto বা আদর্শ হলো- “সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্ “।
৮.শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা থেকে নেয়া ভারতীয় জীবনবীমার এলআইসি (Life Insurance Corporation of India) এর motto এর আদর্শ হলো- “যোগক্ষেমং বহাম্যহম্”।
যে অনন্য চিত্তে আমার স্মরণ নেয়, তার যোগ( সে যা পেতে চায়) এবং ক্ষেম ( যা পেয়েছে, তার সংরক্ষণ) আমি নিজে বহন করি।
৯. ভারতীয় নৌসেনা Indian Navy – র আদর্শ হলো কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় উপনিষদ থেকে নেওয়া motto ” শং নো বরুণঃ”। হে জলের অধীশ্বর ভগবান বরুণ আমাদের শান্তি দিন।
১০. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায় বিশ্বরূপদর্শন যোগের চব্বিশতম শ্লোক থেকে নেয়া হয়েছে IAF (indian Air Force) -এর motto বা আদর্শ ” নভঃ স্পৃশং দীপ্তম্ “। হে ভগবান, আকাশ স্পর্শী তেজোময় আপনার রূপ।
১১. মহাভারত থেকে নেয়া হয়েছে- Research and Analysis Wing বা RAW এর আদর্শ ” ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ” । একমাত্র ধর্মকে রক্ষা করলেই তুমি রক্ষা পাবে, নচেৎ নয়।
১২. ভারতীয় ডাক বিভাগের আদর্শ স্থির করা হয়েছে অসাধারণ এক সর্বজনীন বাক্য দিয়ে- “অহর্নিশং সেবামহে”। দিবারাত্রি সেবা দিয়ে যাবো নিরন্তর।
১৩. ঋগ্বেদ থেকে নেয়া Intelligence Bureau এর motto বা আদর্শ হলো ” জাগৃতং অহর্নিশং “। দিবারাত্রি সদা জাগ্রত।
১৪. Indian Coast Guard -এর motto বা আদর্শ হলো- ” বয়ং রক্ষামঃ”। আমরা রক্ষা করবো।
১৫. Defense Research and Development Organisation: -এর motto বা আদর্শ হলো- ” বলস্য মূলং বিজ্ঞানম্। সকল বলের উৎস বিজ্ঞান।
নাসার একজন বিজ্ঞানী রিক ব্রিগস একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন যেখানে তিনি নিখুঁতভাবে দেখিয়েছেন মহাজাগতিক যোগাযোগের ভাষা হিসেবে সংস্কৃত হল একমাত্র উপযোগী ভাষা। এছাড়া সংস্কৃত হল একমাত্র ভাষা যেটি মহাজাগতিক যোগাযোগের উদ্দেশ্য সংকেত সৃষ্টি করতে পারে। এই অনন্য গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছে “অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা এডভান্সমেন্ট অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স” নামক গবেষণা সংস্থা (সূত্র: aaai.org, 1985 Spring issue)
অনেক সংস্কৃত বিদ্বেষীরা বলে বেড়ান, সংস্কৃত হলো মৃতভাষা, এর বর্তমানে কোন প্রয়োজন নেই ভারতবর্ষে বা বাংলায়। পশ্চিম বাংলায় হিন্দু নামধারী কিছু বাংলার শিক্ষক, বাংলা থেকে সংস্কৃতকে বিদায় করার জন্যে আদাজল খেয়ে নেমে আছেন।
এদের অনেকেই আবার বাংলাদেশে এসে পদ্মার ইলিশ খেয়ে, পদ্মার ইলিশের বিভিন্ন লোভনীয় ফাঁদে স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় পরে দিনশেষে সংস্কৃত এবং ভারতবর্ষীয় স্বাভিমানের অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছেন শুধুমাত্র নিজের ধান্ধার জন্যে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন তাদের সুবুদ্ধি দান করেন।
লেখক-শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
(আমি অনেকদিন থেকেই আমার ডায়রিতে টুকে রাখছি, এই তথ্যগুচ্ছগুলি, আজ আপনাদের জ্ঞাতার্থে এই সংগৃহীত তথ্যগুলির শেয়ার দিলাম। যদি তথ্যগুলিতে কোন ভুল থাকে এবং আপনাদের কাছে আরো নতুন তথ্য থাকে তবে নিচে কমেন্টে দিবেন আশাকরি)
আরো পড়ুন….