রুক্মিণী

রুক্মিণী : রুক্মিণী মরে নি, শুকনো ফুলগুলোর ওপরে হাত বুলালে এখনো রুক্মিণী স্পর্শ টের পাই।

আগে প্রথম অংশ পড়ে আসুন…..

আপনি যেখানে খুশি ঘুরুন। কিন্তু বর্ডার এরিয়া থেকে সাবধান। কড়া পেট্রোলিং সত্বেও মাঝে মাঝেই ওপার থেকে ছদ্মবেশে লোকজন ঢুকে পড়ে। আপনি এখানকার লোকজন চেনেন না। তাই কারো সাথে মেশার আগে সতর্ক হবেন। এন্ড অলওয়েজ কিপ ইয়োর গান উইথ ইউ। আশা করি আপনারা এখানে থাকার সময় খারাপ কিছু হবে না। মা ভবানী আপনাদের রক্ষা করুন”। বুঝলাম পরিস্থিতি জটিল। তার মানে অনুপ্রবেশ এখন দিয়েও হয়। কিছু না বলে একটু হাসি দিয়ে স্যালুট করে বিদায় নিলাম।

সীমান্ত: বিকেলের দিকে একটা পেট্রোলিং পার্টির সাথে গেলাম সীমান্ত দেখতে। আমি কাশ্মীর সীমান্ত দেখেছি। ভারত-চীন সীমান্ত দেখেছি। এই প্রথম মরুভূমির মধ্যে ভারত-পাক সীমান্ত দেখা। বালির খোলা ময়দান আর বালির ঢিপির (ইংরেজি তে ভূগোলের ভাষায় একে বলে স্যান্ড ডিউন্স) মাঝে নির্ধারিত দূরত্বে কোন ধরণের পিলার বসানো।

একদিকে লেখা ইন্ডিয়া। অপর দিকে লেখা পাকিস্তান। মাঝে ফাঁকা নো ম্যান্স ল্যান্ড। ওপাশে পাকিস্তানি বর্ডার পোস্ট। পাকিস্তানি রেঞ্জার্সদের উপস্থিতি দেখলাম দূরবীন চোখে। গিয়েছিলাম উটের পিঠে চেপে। এই জীবের পিঠে চড়া বড়ই কষ্টকর। এরা কি ভাবে চড়ে কে জানে।

আমার মনে হয়েছিল, আমি একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে পড়েছি। এই উঠছি তো এই পড়ছি। কোমর ধরে যায়। এই বালির মধ্যে দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে সহজেই এদিক ওদিক যাওয়া যায়। তার ওপরে কোন ফেন্স নেই। দুই দিকের মানুষের পোশাক একরকম। ফলে বোঝা মুশকিল। চৌহান ঠিকই বলেছেন। আমায় সতর্ক থাকতে হবে।

রুক্মিণী :

একদিন ভোরে জগিং করে রানী কি কিলার কাছে একটা পাথরের ওপরে ভর দিয়ে পুশ আপ করছি। চৌহানের সতর্ক বাণী মেনে এখন নিজের সার্ভিস গান নিজের সাথে রাখি। জুতোর কাছে একটা স্ট্রাপে সেটা বাঁধা থাকে। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। আমার কিছু দূরে এক পাল ছাগল চড়ছে। হঠাৎ কেন জানি মনে হল কেউ আমায় দেখছে। পুশ আপ থামিয়ে চার দিকে সতর্ক নজর করতে কিছু দূরে একটা বাবলা গাছ আর আগাছার ঝোপের মধ্যে একটা কাপড়ের অংশ দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হল।

কৌন হে ওয়াহা? বলে ডাক দিলাম। সব ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠেছে। বেকায়দা কিছু দেখলেই অস্ত্র হাতে নেব। আবার ডাক দিলাম “কৌন হে? বাহার আও”। এবারে একটা মাথার অংশ আর বড় বড় দুটি চোখ আমার দিকে উঁকি দিল। এ আবার কে?! এখানে কি করছে? আবার হাঁক দিলাম, “জো ভি হো বাহার আও”। এবারে শরীরটা বেরোল। একটা ১৪-১৫ বছর বয়সী বালিকা। পরনে মলিন কামিজ। রুক্ষ্ম চুল টান করে বাঁধা। ঈশ্বরেরও হৃদয় গলিয়ে দেওয়া মিষ্টি একটি মুখ আর বড় বড় দুটি চোখ।

সেই চোখে ভয় আর বিস্ময় মিশ্রিত। শিশুদের প্রতি আমার দুর্বলতা সর্বজন বিদিত। মুহূর্তের মধ্যে আমার কাঠিন্য, যেটা আমার ঢাল সেটা আমার মধ্যে অন্তর্হিত হল। হাত তুলে বালিকা কে ডাকলাম। ধীর পায়ে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে কি করছ বেটি?” দেহাতি হিন্দিতে উত্তর এল “বকরিও কো পাত্তা খিলানে আয়া হু সাব”। আমি তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলাম। বেশ উচ্চ স্বরে উত্তর এল, “রুক্মিণী”। উত্তর দেবার তেজিয়াল ভঙ্গিটা আমায় অবাক করল।

রুক্মিণী ছোট গল্প
রুক্মিণী ছোট গল্প

 

জানতে পারলাম করণপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। বাড়ি নয়, মাতুলালয়। মা জন্ম দিয়েই গত। বাবা নিরুদ্দেশ। তখন নিজের গ্রামের স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ত। অনাথ মেয়ের দায়িত্ব কে নেবে। গ্রামের লোকেরা তাকে মামা বাড়িতে ছেড়ে যায়। এখানে তার ওপরে ছাগল চড়ানোর দায়িত্ব পড়েছে। মামা বাড়িতে মামা মামীর গঞ্জনা সহ্য করে থাকে। যা জোটে তাই খায়। মাঝে মাঝে প্রহারও জোটে। এক বুড়ি দাদি ছাড়া আর কেউ তার সাথে ভালো করে কথাও বলে না। খোঁজও নেয় না। ভালোবাসে না।

মামা তাঁর জন্য পাত্রের খোঁজ করছেন। তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করবেন। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ১৪-১৫ বছর বয়সে বিয়ে!!! হে ভগবান। কিন্তু এখানে এটাই দস্তুর। হরিয়ানা আর রাজস্থানে মেয়েদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। বেঁচে আছে এই ঢের। অনেক জায়গায় তো মেয়ে জন্মালে আঁতুড়েই মেরে ফেলা হয়। আমার পকেটে সব সময় লজেন্স থাকে (আজও)।

গলা শুকিয়ে গেলে কাজে দেয়। তার হাতে গোটা তিনেক লজেন্স ধরিয়ে দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু মেয়েটার নিষ্পাপ কচি মুখ, হৃদয়ে ছাপা হয়ে গেল। সেই বন্ধুত্বের শুরু। আমার মা আমায় বলেছিলেন, “জানবে যদি তুমি কোন শিশুর হৃদয় জয় করতে পেরেছো, তাহলে তুমি ঈশ্বরের হৃদয় জয় করেছ। যদি শিশুদের বন্ধু হতে পেরেছো, তাহলে ঈশ্বরের সাথে বন্ধুত্ব করেছ”। এই কথাগুলো আমি অক্ষরে অক্ষরে মানি। এরপরে প্রায়ই রুক্মিণীর সাথে দেখা হত।

ক্লাস সিক্সের বিদ্যা, কিন্তু সে বেঙ্গল, নেতাজি, রবি ঠাকুরের নাম জানে। অনেক প্রশ্ন তাঁর। উত্তর দিতে ক্লান্ত হতাম না। সে আমায় বলেছিল তাঁর মা কে দেখতে খুব ইচ্ছা করে। সে কোনদিন মা কে দেখেনি। দাদি বলে তাঁর মা চাঁদে গিয়েছেন। সে চাঁদে যেতে চায়।

নিজের মা কে দেখতে চায়। জোৎস্না রাতে সে ঘরের বাইরে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে মা কে ডাকে। এই সহজ সরল স্বীকারোক্তি কে কাউন্টার করার কোন উত্তর আমার কাছে ছিল না। কি বা বলব এই অসহায় বালিকা কে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে লজেন্স দিতাম। বেশ কয়েকদিন শান্তিতে কাটল। ডিসিপ্লিন্ড জীবনের চড়া রোডের মধ্যে আমার ছায়া ওই বালিকা রুক্মিণী।

কি অসম্ভব টান বালিকার। ওর সাথে মন খুলে কথা না বলে শান্তি হত না। মাঝে ফোনে মা কে আমার নতুন বান্ধবীর কথা জানিয়েছি। এখন থেকে বাড়িতে ফোন করা বেশ ঝামেলার। পোস্ট থেকে বেস ক্যাম্পে ফোন করে আগে জানাতে হয়। তারপরে সেখান থেকে বাড়িতে সংযোগ দেন অপারেটর। সব সময় লাইন পাওয়াও যায় না। বুঝতেই পারি সুরক্ষার জন্য কথোপকথনের প্রতিটা শব্দ শোনা হচ্ছে আর রেকর্ড হচ্ছে।

মাঝে একদিন রুক্মিণী আমায় রানী কা কিলা পুরো ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। বেশ কিছু ছবি তুলেছি। ঠিক করেছি মাঝে একদিন শহরে গিয়ে রুক্মিণীর জন্য কিছু নতুন জামা কিনে আনব। তারপরে ওর কিছু ছবি তুলব। কিন্তু মানুষ যা চায় তা ঘটে না। আমরা সবাই ঈশ্বরের হাতের পুতুল। সবার অলক্ষ্যে আকাশে মেঘ জমছে সেটা বুঝিনি। সেদিন হায়দারও জগিং এ আমার সঙ্গী।

রানী কা কিলার কাছে পৌঁছে দেখি রুক্মিণী আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। কিন্তু তার সাথে আজ ছাগলের পাল নেই। চেহারাটা কেমন যেন লাগছে। হায়দার রুক্মিণী কে চেনেন না। রুক্মিণী তাকে দেখে ভয় পেল, কিন্তু সেটা ভাঙল না। সে আমায় জানাল যে গতদিন রাতে সে তাঁর গ্রামে কিছু অপরিচিত লোক কে দেখেছে। তারা সংখ্যায় চার জন। তাদের সাথে আরো একজন ছিল।

সে স্থানীয় ভাষায় কথা বলছিল। লোকগুলোর হাতে যে জিনিসগুলোর বর্ণনা সে দিল, সেগুলো কি তা আমার আর হায়দারের বুঝতে দেরি হল না। হায়দার বিড়বিড় করে বললেন, হায় আল্লাহ! একে ফর্টি সেভেন আর ওয়ারল্যেস!! গতদিন পূর্ণিমা ছিল। তার মানে রুক্মিণী চাঁদে মা কে দেখার জন্য বাড়ির বাইরে ছিল। রুক্মিণী কারো চেহারা দেখতে পায় নি। কিন্তু গলার শব্দ শুনেছে।

সে জোর দিয়ে জানালো যে, যিনি স্থানীয় ভাষায় কথা বলছিল তাঁর গলা সে আবার শুনলে চিহ্নিত করতে পারবে। সব শুনে আমরা আর দেরি করলাম না। রুক্মিণী কে বাড়িতে পাঠিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে পোস্টে ফেরত এলাম। চৌহান স্যার কে সব জানানোর পরে তিনি ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেলেন। রেডিও অফিসার সব পেট্রোলিং পার্টিকে সতর্ক করলেন। শুরু হল চিরুনি তল্লাশি।

বেস ক্যাম্পে খবর দেওয়া হল। তাদের প্রস্তুত থাকতে বলা হল। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। রুক্মিণী কে ভালো ভাবে চিনেছি। সে মিথ্যা বলতে পারে না। তাহলে কি ঘরের মধ্যেই শত্রু?!!! চৌহান স্যার কি বুঝেছিলেন কে জানে। খালি বললেন, “মা ভবানী আমাদের রক্ষা করুন”।

মৃত্যুর মুখোমুখি: মা ভবানী সম্ভবত অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন আমাদের জন্য। সেদিন অফিসের কাজ শেষ করতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি আর রেড্ডি রাতের খাবার এক সাথে খেলাম। তারপরে রেড্ডি গেলেন বাড়িতে ফোন করতে। আমি বাঙ্কার থেকে একটু ওপারটা দেখবো বলে ঠিক করে ট্রেঞ্চের দিকে হাঁটা লাগালাম। রাতের মরুভূমির একটা সুন্দর নিস্তব্ধতা থাকে। সেটা যে কোন মানুষকেই মোহিত করবে। ট্রেঞ্চ থেকে যখন প্রায় দেড়শ মিটার দূরত্বে, তখন হঠাৎ একটা তীক্ষ্ন শীষের মতন শব্দ।

যেন বাতাস চিরে কিছু উড়ে আসছে। শব্দটাকে ফলো করে পিছনে ঘুরলাম। তার পরেই একটা চোখ ধাঁধানো আলো আর তীব্র বিস্ফোরণ। একটা ভীষণ গরমের হওয়া। পায়ের নিচে বালি দুলে উঠল। একটা ধাক্কা আমায় উড়িয়ে নিয়ে ফেললো তিন হাত দূরে। শেলিং। ওপার থেকে শেল ছোড়া হচ্ছে। বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা ধরে গিয়েছিল। স্নায়ুগুলো যেন অবশ হয়ে গিয়েছিল।

ঠিক অনেকটা ইলেকট্রিক শক খাবার পরের অনুভূতি। আমার স্নায়ুতন্ত্র আর সেন্স আবার নিজের জায়গায় ফিরতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। অনেকটা কম্পিউটার হ্যাং হয়ে যাবার পরে যে রকম রিস্টার্ট নেয়, সেই রকম। এটা আমার বরাবরের ম্যাটার। হয়ত ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা। ধাক্কা সামলে শরীর নিজের জায়গায় ফিরতে আর মস্তিষ্ক পুনরায় সজাগ হতে বেশি সময় লাগে না। তখন পরপর শেলিং শুরু হয়েছে। বালি থেকে মাথা তুলে দেখলাম যে সীমান্তের ওপারে আলো চমকে উঠছে।

কিছু জ্বলন্ত আগুনের ফুলকি এদিকে ছুটে আসছে। ওগুলো বুলেট। পাকিস্তানের হেভি মেশিনগান থেকে ব্রাশ ফায়ার চলছে। ব্রাশ ফায়ার মানে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য বস্তুকে লক্ষ্য না করে এলোপাতাড়ি গুলি। ট্রেঞ্চে থাকা ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সৈনিকদের বন্দুকও জবাব দিতে শুরু করেছে। এদিকের হেভি মেশিনগানও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পিছনের বাড়িগুলোতে হৈচৈ শুনতে পাচ্ছিলাম।

দেখতে পেলাম চৌহান স্যার বুলেটের গতিতে ট্রেঞ্চের দিকে ছুটে চলেছেন। তাঁর লক্ষ্য বাঁ দিকে থাকা হেভি মেশিনগান। এক লহমায় উঠে দাঁড়িয়ে আমিও স্প্রিন্ট টানলাম। স্প্রিন্ট হল সংক্ষিপ্ত দূরত্বে দ্রুততম দৌড়। আমি মফস্বলের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই দৌঁড়ঝাঁপ করে অভ্যস্ত।

তাছাড়া আমি আমার উচ্চতার সম্পুর্ন ব্যাবহার করতে জানি। হওয়া কাটিয়ে শীষের শব্দ তুলে চারপাশ দিয়ে বুলেট ছুটে চলেছে। বুলেটের আঘাতে উড়ছে বালি। হওয়া তখন আমাদের দিক থেকে পাকিস্তানের দিকে বইছিল। সম্ভবত এটাই বুলেটের গতি আর অভিঘাত কমিয়ে দিয়েছিল।

না হলে কি হত তা জানা নেই। লাফিয়ে ট্রেঞ্চে নেমে পায়ের থেকে আমেরিকান ব্যারিস্টা খুলে নিলাম। তারপরে সেটার গোটা একটা ম্যাগাজিন খালি করে দিলাম অন্ধকারে অজ্ঞাত শত্রুদের লক্ষ্য করে। রাগে সর্ব শরীর জ্বলছিল। এই রকম আক্রমণ কাপুরুষতার লক্ষণ।  একটা ম্যাগাজিন খালি হবার পরেই মাথায় এল, আরে এর গুলি তো ওদিকে গিয়ে পৌছাবেই না।

আমার ঠিক পাশেই আর এক সৈন্য হাত চেপে বসে পড়েছেন। উর্দির ওপর দিয়ে বেরিয়ে আসছে উষ্ণ রক্তের ধারা। তাঁর ছাড়া এসল্ট রাইফেলটা তুলে ট্রিগার টিপে দিলাম। গর্জন করে উঠলো বন্দুক। ইতিমধ্যে পিছনের ঘরে থাকা সৈন্যরাও ট্রেঞ্চে নেমে এসেছেন। যে যে রকম অবস্থায় ছিলেন সে ভাবেই। মাঝে মাঝেই গর্জন উঠছে “জয় মা ভবানী”। রেড্ডি কোথায় কে জানে।

হায়দারই বা কোথায়। শেলিং তখনো অব্যাহত। এর মধ্যেই আমাদের ঠিক পিছন থেকে পাল্টা গর্জন পাওয়া গেল। হায়দার আর তার আর্টিলারি পাল্টা গোলা ছোড়া শুরু করেছে। ১৫৪ মিমি কামান সমেত গাড়ি দুটো গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ট্রেঞ্চের কাছে আসছে। তারা অদ্ভুত ভাবে স্থান পরিবর্তন করে শত্রুর দিকে গোলা ছুড়ে চলেছে। কোন একটা গোলা সম্ভবত ওপাশে কিছু একটার ওপরে পড়ায় একটা তীব্র বিস্ফোরণ আর আলোর ঝলকানি দেখলাম।

সেই আলোয় এটাও দেখলাম যে কামানের মতন কি যেন একটা আমাদের ট্রেঞ্চের বাঙ্কারে থাকা হেভি মেশিন গানের দিকে ঘুরছে। এবারে হায়দার একটা অবিশ্বাস্য কান্ড করলেন গাড়িটাকে ট্রেন্ঞ্চের একদম কাছে এনে, কামানের নল প্রায় সমতলে নিয়ে এলেন। স্পষ্ট শুনলাম, হায়দার বলছেন, “বিসমিল্লাহ রহমান এ রহিম”, আর “জয় হিন্দ”। তার পরেই কান ফাটানো বাজের মতন শব্দ আর আগুনের হল্কা।

ওপারে তুমুল একটা বিস্ফোরণ। বুঝলাম হায়দারের গোলা লক্ষ্য তে আঘাত হেনেছে। ওপার থেকে হঠাৎ সব কিছু থেমে গেল। এপার থেকেও গুলিগোলা বন্ধ হল। চারিদিকে শ্মশানের শান্তি। চৌহানের গলা পেলাম, “কই ভি আপনি পজিশন নেহি ছোড়েগা”। রেডিও অফিসার পেট্রোলিং পার্টিকে সতর্ক করছেন। এই আক্রমণের অর্থ অন্য দিকে কিছু একটা হচ্ছে।

বেসে খবর পাঠানো হল। সেখান থেকে জানানো হল যে সকালের মধ্যে রিইনফোর্সমেন্ট পৌঁছে যাবে। সেই রাতটা ট্রেঞ্চেই কাটলো। যুদ্ধক্ষেত্রে খুব সাধারণ একটা নিয়ম কাজ করে। হয় মারো, না হয় মরো। তুমি না মারলে, তোমার বিপরীতে যে অস্ত্র হাতে আছে, সেই তোমায় মেরে দেবে। সেদিন সেটাই দেখেছিলাম। ভোর রাত্রে ৮নং পেট্রোলিং পার্টির কাছ থেকে খবর এল ওয়ারল্যেসে।

কিছু লোক ৩১ নং পিলারের কাছ থেকে এই দেশে ঢোকার চেষ্টা করছিল। পেট্রোলিং পার্টি তাদের চ্যালেঞ্জ করলে তারা গুলি ছোড়ে। পাল্টা গুলিতে দুই জন অনুপ্রবেশকারী মারা গেছে। দুইজন পালিয়েছে। কিন্তু পেট্রোলিং পার্টি বালির ওপরে কিছু পায়ের দাগ দেখেছে।

যেগুলো সীমান্ত পেরিয়েছে। তাদের ধারণা কিছু লোক সীমান্ত পেরিয়ে আশেপাশে গা ঢাকা দিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে তিনটে ট্রাক করে শিখ রেজিমেন্ট আর রাজপুত রাইফেলস এর ট্রুপ এসে হাজির হল। সাথে মেডিক্যাল টিম আর বেসের কিছু উচ্চ পদস্থ অফিসার। আমাদের দিকের কমপক্ষে গোটা দশেক সৈন্য আহত। অফিস ঘর আর খাবার ঘরের একটা অংশ গলায় গুঁড়িয়ে গেছে।

রেড্ডিরও চোট লেগেছে পায়ে। হায়দারও অল্প বিস্তর আহত। আমার কপাল আর কুনুই কেটেছে। এটা সম্ভবত শেলিং এর ধাক্কায় ছিটকে পড়ার ফলে। ডাক্তার কপালের বাঁ দিকে পট্টি লাগিয়ে দেবার কিছু পরেই আমার আর হায়দারের ডাক পড়ল চৌহান স্যারের কাছে। একটা ছোট্ট ঘরে চৌহান স্যার এর বেস থেকে আসা আরো তিন আধিকারিক বসে আছেন। চৌহান স্যার আমায় রুক্মিণীর কথা জিজ্ঞেস করলেন। সে ঠিক কি বলেছিল আমাদের জানতে চাইলেন।

জানালাম। ঠিক হল রুক্মিণী কে এখানে ডেকে আনা হবে। সেই একমাত্র আমাদের শত্রু চিনাতে সাহায্য করতে পারে। পত্রপাঠ দুইজন সৈন্য করণপুরের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আগের দিনের হামলায় উটগুলো রক্ষা পেয়েছে। ওগুলোর কিছু হলে বিপত্তি ছিল। আমি হায়দার কে নিয়ে বাঙ্কারের দিকে চললাম। আজ এখানে গত দিনের থেকে তিন গুণ বেশি সৈন্য। ওপার আজ একদম শান্ত। যেন কাল কিছুই হয় নি। বাঙ্কারে গিয়ে হায়দার বাইনোকুলার চোখে দিলেন।

আবার শুনলাম বিড়বিড় করছেন। তবে পাকিস্তানের বাপান্ত করছেন গালি দিয়ে সেটা বুঝলাম। হায়দার কে জিজ্ঞেস করলাম যে কি হয়েছে। উত্তরে তিনি আমায় বাইনোকুলারটা এগিয়ে দিলেন। চোখে লাগিয়ে দেখি সীমান্তের ওপারে একটা লম্বা লাঠির মাথায় সাদা পতাকা উড়ছে। শান্তির চিহ্ন। জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী কেউ সাদা পতাকা দেখানোর পরে তার ওপরে আর আক্রমণ চালানো যায় না।

সেটা যুদ্ধ অপরাধ আর মানবধিকার লঙ্ঘন। যুদ্ধের নিয়মের অপব্যবহার পাকিস্তান ভালোই জানে। ঘন্টা খানেক পরে আবার ডাক পড়ল। রুক্মিণী কে নিয়ে আসা হয়েছে। সে খুব ভয় পেয়েছে। কথা বলছে না। প্রায় দৌড়ে পৌছালাম। একটা চেয়ারে রুক্মিণী বসে আছে। তাকে ঘিরে চৌহান ও অন্যান্য আধিকারিকরা। রুক্মিণীর চোখে মুখে ভয়ের চাপ। মিষ্টি মুখখানা শুকিয়ে গেছে। চোখের কোনে জল।

আমি ঘরে ঢুকতেই সে দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। “সাব, মুঝে ইয়ে সব কিউ পকর কে লায়ে? মুঝে ডর লগ রাহা হে সাব।” রুক্মিণীর চোখ মুছিয়ে তাঁর হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। সামনে নতজানু হয়ে বসলাম আমি। বললাম ভয় পেয়োনা বন্ধু। আমি আছি তো। তুমি সেদিন আমায় যা যা বলেছিলে তা এদের বলে দাও। আমায় পেয়ে রুক্মিণী এবারে অনেকটা সহজ হয়েছে।

সে গড়গড় করে সব বলে গেল। সবার মুখে চিন্তার ছাপ। হায়দারও দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঠিক হল রুক্মিণী কে সাথে নিয়েই গ্রামে সার্চ পার্টি পাঠানো হবে। শার্প শুটার এখানে অনেক আছেন। তাদের নিয়ে একটা টিম বানিয়ে বেরোনো হবে। বীরভদ্র চৌহান নিজে যাবেন। আমি যেতে চাইলাম কিন্তু চৌহান নিষেধ করলেন। রুক্মিণীর এই সবে আর নজর ছিল না।

সে নিজের কামিজের পকেট থেকে আমার জন্য বার করে এনেছে কিছু বুনো ফুল। রুক্মিণীর ফুল খুব পছন্দ ছিল। আমি তাকে রোজ লজেন্স দিতাম। আর বিনিময়ে সে আমায় দিত বিভিন্ন বুনো ফুল। আজও তাকে লজেন্স এগিয়ে দিলাম। হাসিতে তার মুখ ভরে উঠল।

ঠিক যেন ভোরের আলোয় গোলাপ। হায়দারেরও রুক্মিণীর ওপরে মায়া পড়ে গিয়েছিল। সেও এগিয়ে এসে রুক্মিণীর কাছে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বলল, “মুজসে দোস্তি করোগী বেটি”। ঘন্টা খানেকের মধ্যে জনা দশেকের টিম বানিয়ে রুক্মিণী কে নিয়ে চৌহান বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর আগে আমি আর হায়দার রুক্মিণী কে খাইয়ে দিয়েছি। সকলেই প্রায় একবার করে উঁকি দিয়ে তাঁকে দেখে গেছে। চাকরিটা খুব কঠিন। মাঝে মাঝে জল্লাদ হতে হয়। কিন্তু একটা নরম হৃদয় আমাদের সকলের কাছেই আছে।

আমি জীবনে কোনদিন মা বাবা ছাড়া আর কারো সামনে নতজানু হই নি। কিন্তু সেদিন হয়েছিলাম ওই বালিকার সরলতার আর ভালোবাসার সামনে। সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম এই দুটো জিনিষের সামনে আমার বর্ম আর অস্ত্র অচল। রুক্মিণী কে নিয়ে গোটা টিম বেরিয়ে পড়ল। আমি আর হায়দার গেটে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় গাড়িটাকে দেখলাম। তারপরে কি হয় কি হয় অপেক্ষা।

দুপুরে খেতে পারলাম না। অস্বস্তি হচ্ছে। ক্যাম্পে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ। বাইরে গিয়ে প্রায় দেড় প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলেছি। হায়দারও দেখলাম ছটফট করছেন। বিকেল ৪টের সময় ট্রুপ ফেরত এল। গাড়ি ছাড়া হেঁটে। বীরভদ্র চৌহান তাতে নেই। জানলাম করণপুরে ছোটখাটো একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা গিয়েছিল। একজন স্থানীয় লোক নিয়ে তারা পাঁচ জন ছিল। তাঁরা গুলি চালায়। শেষ পর্যন্ত সকলেই নিকেশ হয়েছে।

গুলিতে কয়েকজন গ্রামবাসী আহত হয়েছেন আর আহত হয়েছে রুক্মিণী। তাকে গাড়িতে নিয়ে চৌহান স্থানীয় হাসপাতালে ছুটছেন। শুনে চোখের সামনে পৃথিবী দুলে উঠল। হায়দার, “হে আল্লাহ!” বলে হাঁটু গেড়ে বালির উপরে বসে পড়লেন। আমি ঠিক করলাম হাসপাতালে যাব। হায়দার একটা জিপ নিয়ে আসলেন। তাতে বসে দুইজনেই ছুটলাম হাসপাতালের দিকে। হায়দার এখানে আমার অনেক আগে থেকে আছেন, তাই সবই চেনেন। গ্রামীন হাসপাতাল। এমন কিছুই ব্যবস্থা নেই।

হাসপাতালের সামনে কিছু লোকের ভীড়। চৌহান স্যারের গাড়ি দেখতে পেলাম। কোন মতে আমাদের গাড়ি পার্কিং করে দুইজনে ছুটে ভিতরে ঢুকলাম। এক নার্স কে জিজ্ঞেস করতে তিনি পিছনের দিকটা দেখিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখি একটা বেঞ্চের উপরে মাথা নিচু করে বসে আছেন চৌহান। “স্যার, রুক্মিণী কোথায়?” প্রশ্নটা করলাম আমি। চৌহানের চোখ লাল।

রুক্মিণী মৃত্যু
রুক্মিণী মৃত্যু

 

বোধহয় কেঁদেছেন। বললেন, “মুঝে মাফ কিজিয়ে চক্রবর্তী। ম্যায় রুক্মিণী কো বাঁচা নেহি পায়া।” কথাটা যেন মাথার মধ্যে ইকো হল। আমার মনে হল আমার ভিতর আর কিছু নেই। আমি এক্ষুনি ধ্বসে পড়ে যাব। হায়দার পাগলের মতন পাশের খোলা দরজাটার দিকে দৌড়ালেন। এবং দরজার সামনে গিয়ে দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি প্রায় টলতে টলতে দরজার সামনে গেলাম। টেবিলের ওপরে শোয়ানো রয়েছে রুক্মিণীর ফুলের মতন শরীর। মুখে কোথাও কষ্টের ছাপ নেই। যেন ঘুমাচ্ছে। কামিজের বাঁ দিকে, বুকের ওপরে একটা ক্ষত। রক্তে কামিজ ভেসে গেছে।

গুলি তার ফুলের মতন হৃদয় ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। চৌহান আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর গলা কাঁপছে। কাঁপা গলায় তিনি বলে চললেন, রুক্মিণী লোকটার গলা শুনে চিনে ফেলেছিল। লোকটা লড়াইয়ের সুযোগ নিয়ে পিছন দিয়ে পালাচ্ছিল।

রুক্মিণী তার দিকে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করে ওঠে, “সাব ইয়ে হে ওহ”। লোকটা ঘুরেই পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে দেয়। হায়দারের গলা পেলাম। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন ইমতিয়াজ আলী হায়দার। আমার ভিতর থেকে কি যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে।

কানে বাজছে রুক্মিণীর সেই কথা, “সাব, মেরি মা চাঁদ পে হে। মুঝে মেরি মা সে মিলনা হে। উসে দেখনা হে। মুঝে ওহা লে যাওগে সাব।” চোখের সামনে ভাসছে আজকে তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত। তাঁর আমার ওপরে অগাধ ভরসা আর ভালোবাসা। আমার জামার পকেটে এখনো রয়েছে তাঁর দেওয়া ফুল।

চিরবিদায়: করণপুর আজ লোকে লোকারণ্য। আশেপাশের গ্রামের লোক ছুটে এসেছেন রুক্মিণী কে দেখতে। যে বীর মেয়েটা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। ফুলের মতন রুক্মিণী আজ জাতীয় পতাকার আর ফুলে ঢাকা। যে ফুল তার খুব প্রিয় ছিল। কম্যান্ড রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্নের অনুমতি দিয়েছে।

সে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। যে পতাকার মর্যাদার জন্য সৈন্যবাহিনী লড়ে, যার সামনে আমরা সবাই মাথা নত করি, সেই পতাকা দিয়ে আজ এই সাধারণ বালিকার দেহ ঢাকা। পৃথিবীতে কেউ সাধারণ নয়। সবাই অসাধারণ। রুক্মিণী কে একদিন কথায় কথায় আমার ঠাকুরদার সেই কথাটা বলেছিলাম, “দেশ অনেক বড়”। রুক্মিণী হেসে বলেছিল, “দেশ তো বাড়াই হে সাব।

নেহি তো হাম সব ইস মে ক্যায় সে রেহতে।” আজ সবার চোখে জল। রুক্মিণীর বুড়ি দাদির ক্রন্দনে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। বড় ভালোবাসতেন তিনি মা মারা, বাপে ত্যাগ করা মেয়েটাকে। রুক্মিণীর মামা উচ্চস্বরে কাঁদছিল। চৌহান তার গালে একটা বিরাশি শিক্কার চড় কষিয়ে বললেন, “নৌটঙ্কি বন্ধ কর। যাব জিন্দা থি তব পানি ভি নেহি পুছা। অব আগার ফিরসে নৌটঙ্কি কিয়া তো তুঝে যেহি পে ঠোক দুঙ্গা”।

হায়দার আর আমি রুক্মিণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম। সব শেষ করে যখন ফিরলাম তখন বেশ রাত। হায়দারের বাড়ি থেকে একটা টেলিগ্রাম এসেছে। তাঁর স্ত্রী আজ এক সুস্থ কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সবাই হায়দার কে মুবারক দিচ্ছে।

হায়দার উঠে একটা কাগজ নিলেন। তাতে কি যেন লিখে অফিসে গিয়ে টেলিগ্রাম করতে বলে এলেন। জিজ্ঞেস করলাম কি লিখলেন হায়দার ভাই। উত্তর এল, “বিটিয়ার নাম ঠিক করে ফেলেছি সাহাব। এই নামটাই যেন রাখা হয় সেটা টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিতে বললাম”। আমি জিজ্ঞেস করলাম “কি নাম?” হায়দার একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, “রুক্মিণী”।

রুক্মিণী মরে নি। সে আজও বেঁচে আছে আমাদের সবার মাঝে। হায়দারের মেয়ের মধ্যে। আমার ডাইরির পাতায় আজও আঠা দিয়ে আটকানো রয়েছে তাঁর দেওয়া বুনো ফুল। আজও যখন জোৎস্না রাতে চাঁদ দেখি, তখন আমি রুক্মিণী কে দেখতে পাই। চাঁদে। তাঁর মায়ের সাথে। শুকনো ফুলগুলোর ওপরে হাত বুলালে এখনো রুক্মিণী স্পর্শ টের পাই।

লেখক- অভিমুন্য চক্রবর্তী 

আর পড়ুন……