রুক্মিণী

রুক্মিণী : রুক্মিণী মরে নি, শুকনো ফুলগুলোর ওপরে হাত বুলালে এখনো রুক্মিণী স্পর্শ টের পাই।

রুক্মিণী : রুক্মিণী মরে নি, শুকনো ফুলগুলোর ওপরে হাত বুলালে এখনো রুক্মিণী স্পর্শ টের পাই। এটিও আমার সৈন্যবাহিনীর সাথে জড়িত থাকার সময়ের ঘটনা। আর এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে রয়েছে এমন কিছু স্মৃতি যা আমি চিরকাল মনে রাখবো। যেহেতু জায়গাটি অসম্ভব সেনসিটিভ আর গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে, তাই অনেক কিছুই উহ্য রাখছি।

চন্ডীগড় পর্ব: চন্ডীগড়ে ফেব্রুয়ারি মাসের মনোরম সকাল। খুব সুন্দর রোদ উঠেছে। মন ভালো করে দেওয়া রোদ্দুর। মন আরো ভালো এইজন্য যে আমি বাড়ি ফিরছি। দীর্ঘ দুই মাস পরে। সৈন্যবাহিনীর এই ডিসিপ্লিন্ড লাইফ থেকে কয়েক দিনের ছুটি। আবার মা বাবার স্নেহের ছায়ায়। আবার আমার বেহিসেবি জীবনে।

এইসব ভাবতে ভাবতে আর্মি মেস থেকে হেঁটে চলেছি কয়েক সেক্টর পরে এরিয়া কমান্ডারের অফিসের দিকে। চন্ডীগড় আমার অন্যতম প্রিয় শহর। ১৯৯১ সালে প্রথম এসেছিলাম এখানে। তখন আমার মেজমামা সদ্য এখানে পোস্টিং পেয়েছেন। মেজমামা বায়ু সেনায় কর্মরত ছিলেন। মাস্টার অফ ওয়ারেন্ট অফিসার (মিসাইল)। সেই প্রথম আমার সৈন্যবাহিনীর জীবনের সাথে পরিচয়।

এখানে বায়ু সেনার এয়ার বেস আছে। আর সৈন্যবাহিনীর কমান্ডোদের ট্রেনিংও দেওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে অনেক শিক্ষা পেয়েছিলাম। খালি হাতে সাপ ধরা, খালি হাতে নিজের থেকে সাইজে তিন-চার গুন বলশালী মানুষকে কেবলমাত্র শরীরের কয়েক জায়গায় আঘাত করে ধরাশায়ী করে দেওয়া, বিভিন্ন অস্ত্র ও নিজের এবং পরের জীবন রক্ষার শিক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছবির মতন সাজানো শহর। ঝকঝকে। সেই প্রথম চন্ডীগড়ের প্রেমে পড়া। তারপরে এসেছি আরো বার তিনেক। আর আজ নিজেই সৈন্যবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে আমি নিজেই এখানে। “সাহাব আপকো কম্যান্ডার সাহাব বুলা রাহে হে”। অফিসে ঢুকতে গিয়ে ডাকটা শুনে থেমে গেলাম। কথাটা আমায় লক্ষ্য করে বলছেন হাবিলদার থাপা। অফিসের দরজা সামলানোর দায়িত্ব তাঁর।

অগত্যা অফিসে না ঢুকে, নব্বই ডিগ্রি বাঁ দিকে ঘুরে হাঁটা লাগলাম এরিয়া কমান্ডরের অফিসের দিকে। কমান্ডার ধরমজিত কৌরের অফিস আলাদা। চারপাশে সাজানো সুন্দর বাগানের মধ্যে। বাইরে সক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রক্ষীরা ঘুরছেন। দরজায় নক করে অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়লাম। বড় টেবিলের অপর পাশে বসে রয়েছেন কৌর স্যার। পিছনে ভারতের ম্যাপ।

সামনের টেবিলে জাতীয় পতাকা। আর টেবিল জুড়ে বিভিন্ন ফাইল আর কম্পিউটার, গোটা তিনেক ফোন ইত্যাদি। সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পরে তিনি আমাকে বসতে বললেন। তাঁর টেবিলের সামনে থাকা তিনটে চেয়ারের মধ্যে থেকে একটা টেনে নিয়ে বসলাম।

ইংরেজিতে গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বললেন, “আপনার জন্য একটা অর্ডার আছে মিস্টার চক্রবর্তী”। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি অর্ডার স্যার”? পাশের ফাইল থেকে একটা কাগজ টেনে বের করতে করতে তিনি বললেন, “আমার নয়। সেন্ট্রাল থেকে অর্ডার আছে।

আপনাকে বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে, অন্য একজনের বদলি হিসাবে রাজস্থান যেতে হবে”। বলতে বলতে তিনি কাগজখানা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। কাগজ হাতে নিয়ে পড়লাম। পরিষ্কার লেখা আছে যে, রাজস্থানে পাকিস্তান লাগোয়া সীমান্তে এক আর্মি ক্যাম্পে আমায় অমুক ব্যাক্তির বদলি হিসাবে কাজ করতে যেতে হবে, উক্ত ব্যাক্তির অসুস্থতার জন্য। আমার সঙ্গী হবেন কে এক জনৈক পি.আর.রেড্ডি।

অর্ডারটি পাওয়া মাত্রই আমায় সেখানে যাবার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে এবং পরের দিনের মধ্যে আমায় সেখানে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। বাড়ি যাব বলে মনের মধ্যে এতক্ষণ যে প্রজাপতিগুলো উড়ছিল, সেগুলো হঠাৎ উধাও হল।

দূর!! এইসব অর্ডার এখনই আসার ছিল?!!! বাড়ি গিয়ে কত কি করব বলে প্ল্যান করে রেখেছিলাম। সব মাটি হয়ে গেল। তারপরেই নিজেকে সংযত করলাম। এটা তো হতেই পারে। এইসব ভেবেই তো এই কাজে যোগ দিয়েছিলাম। সবাই পইপই করে না করেছিল। এমনকি মেজমামা পর্যন্ত। এখন পিছু সরে যাবার কোন মানে হয় না। আর এখন আমার কোন আপত্তি চলবে না।

এখানে অর্ডার মনে অর্ডার। বাঁচবে কি মরবে সেটা পরের ব্যাপার। সেটা পালন করতেই হবে। তাছাড়া রুক্ষ বালি আর বীরের দেশ। আমার খুব পছন্দের জায়গা। অনেক দিন ধরেই দেখার ইচ্ছা। অনেকেই হয়ত বলবেন বালি কি ভাবে পছন্দের হয়।

তাদের বলি, রুক্ষতার মধ্যেও একটা সৌন্দর্য্য থাকে। আর পাহাড় ও সমুদ্রের মতোই, মরুভূমিও রহস্যময়। অনেক কিছুকে নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। নিস্তব্ধতা ভেঙে কৌর আবার মুখ খুললেন, “আপনাকে বিশেষ ভাবে সতর্ক করাটা দরকার। যেখানে যাচ্ছেন সেটা পাকিস্তান লাগোয়া।

রুটিন মাফিক সিজ ফায়ার ভায়োলেট হয়। পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হারলেও শেলিং হয় আবার জিতলেও শেলিং হয়। ঈদের খুশিতেও শেল পড়ে আর দীপাবলিতেও শেল ছোঁড়ে। গুলি চালাচালি তো লেগেই আছে। সাবধানে থাকবেন। যারা ওখানে আছেন তাদের ফলো করবেন।

অকারণে হিরো হবার চেষ্টা করবেন না। সবার প্রানের দাম আছে। আর আপনি তো ছবি তুলতে আর ইতিহাসে আগ্রহী। ভুলেও ক্যাম্প বা সীমান্ত অঞ্চলের ছবি তুলতে যাবেন না। ওখানে অনেক পরিত্যক্ত কেল্লার ধ্বংসাবশেষ পাবেন।

কিন্তু কোথাও যাবার আগে অবশ্যই ব্যাটেলিয়ন ইনচার্জ কে আগাম জানিয়ে আর খোঁজ নিয়ে যাবেন। ১০৭ নং রাজপুতনা রাইফেলস এর একটা ব্যাটেলিয়ন ওখানে আছে। সাথে রয়েছে বিএসএফ। অসতর্ক হয়ে কোন ভুল করলেই কিন্তু পাকিস্তানের রেঞ্জার্সদের হাতে পড়বেন”। “কিন্তু স্যার আমি এত তাড়াতাড়ি পৌঁছাবো কি ভাবে”। কৌর জানালেন, “চিন্তার কারণ নেই।

বায়ু সেনার হেলিকপ্টার আপনাকে যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। যান। বাড়িতে খবর দিয়ে দিন”। আর কিছুই বলার নেই। তাই কিছু না বলে স্যালুট ঠুকে চলে এলাম। বাড়িতে ফোন করে জানানোর পরেই ফোনের অপর পাশে মায়ের উদ্বিগ্ন গলাটা পেলাম। হঠাৎ কি হল? কোথায় যেতে হচ্ছে? ইত্যাদি ইত্যাদি হরেক প্রশ্ন।

পিছনে বাবার গলাও পাচ্ছিলাম। মা বাবার জেরা সামলে ফোন কাটলাম। এবারে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু যাত্রার শুরুটাই ঠিক মতন হল না। খারাপ আবহাওয়ার জন্য বেস থেকে নির্ধারিত সময়ে MI-24 ওড়ানো সম্ভব হল না। আকাশ জুড়ে তখন কালো মেঘ। নির্ধারিত সময়ের তিন ঘন্টা পরে যাত্রা শুরু হল। আমায় নিয়ে মাটি থেকে ওপরে উঠল MI-24।

রাজস্থান পর্ব- পৌঁছানোর কথা ছিল পরের দিন সকাল এগারোটার মধ্যে। পৌঁছালাম দুপুর দুটোর পরে। সুরক্ষার জন্য এই জায়গাটার নাম নিচ্ছি না। পুরানো একটা দুর্গ আছে। কে বানিয়েছিল কে জানে। বেশি বড় নয়। মাঝারি মাপের। সারা রাজস্থান জুড়েই এই রকম কেল্লা ছড়িয়ে রয়েছে। জাঠ, গুজ্যর, রাজপুত বা শিসোদিয়া দের তৈরি। এগুলো ছোট ছোট রাজত্ব ছিল।

এখন রাজ্যপাট নেই। কিন্তু কেল্লাগুলো রয়েছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এই ধরনের অনেক কেল্লাই সৈন্যবাহিনী ব্যাবহার করে। সেগুলো বর্তমানে সৈন্যবাহিনীর হাতে। ব্যাক আপ রাখা হয়। যাতে অকস্মাৎ কিছু হলে পত্রপাঠ সীমান্তে রিসোর্স আর রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানো যায়। রেড্ডি পৌঁছে গিয়েছিলেন আরোও আগে। অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। পি.আর.রেড্ডি।

দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাক্ষ্মন। চেন্নাইয়ের বাসিন্দা। উচ্চতায় আমার থেকে একটু খাটো। ফর্সা রং। সাউদার্ন কমান্ডের লোক। কেমন যেন চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি বলেন। অবশ্য গড়পড়তা দক্ষিণ ভারতীয়দের ইংরেজি উচ্চারণ আলাদা হয়। ভদ্রলোক কথা খুব কম বলেন আর ঠোঁট হাসলেও চোখ হাসে না। কাজ ছাড়া অন্য কিছুতে আগ্রহ আছে বলে মনে হল না।

এখান থেকে আমাদের যেতে হবে আরো ৪০ কিমি উত্তর পূর্বে গঙ্গানগর। সেখান থেকে আরো সাত কিমি দক্ষিণে করণপুর। সীমান্তবর্তী একটা গ্রাম। সেটা ছাড়িয়ে আরও দুই কিমি গেলে ভারত পাকিস্তান সীমান্ত। গাড়ি ক্যাম্প থেকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মহিন্দ্রার একটা জিপ। ড্রাইভার, একজন সশস্ত্র রক্ষী ও আমরা দুই জন, যাত্রা শুরু হল।

পথে রেড্ডির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। বড়ই নিরস। মেপে কথা বলে। তাই রেড্ডির উপরে সময় নষ্ট না করে, চারপাশের দৃশ্যের উপরে নজর দিতে শুরু করলাম। রাস্তাটা নতুন। খুব সম্ভবত বছর খানেক আগে তৈরি করা হয়েছে। এখানে পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার বলে মনে হয় নি। কেল্লায় রাজপুতনা রাইফেলস ছাড়াও শিখ রেজিমেন্ট কে দেখেছি।

কিছু একটা হতে পারে এটা চিন্তা করেই এদের এখানে রাখা হয়েছে। যাতে দরকারে ব্যাবহার করা যায়। চন্ডীগড়ে থাকার সময় শুনেছিলাম বায়ুসেনাও প্রস্তুত রয়েছে। কে জানে কি আছে কপালে। পথের চারপাশে রুক্ষ প্রকৃতি। বাবলা গাছ আর ক্যাকটাসের ঝাড়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। উটে টানা গাড়ি করে লোকজন, বাড়ির উঠানে বাঁধা উট আর ছাগল।

এগুলো দেখতে দেখতে আমার স্বাধীনতা সংগ্রামী ঠাকুরদার ডাইরির কিছু লাইন মনে পড়ছিল। লাইনগুলো আমার মাথায় আট বছর বয়স থেকে ছাপা হয়ে গেছে – ‘দেশ অনেক বড়। দেশ শুধু তুমি আমি নিয়ে নয়। দেশ সবাই কে নিয়ে। দেশকে জান বোঝো। দেশের মানুষকে জানো বোঝো’।

আর ‘Be a child when you are with children. Be a child when you are with aged people and parents. Be an evil when you are facing evil. Only evil can terminate evil. Even God turned into evil when he faces evil. বিনাশায় চতুষকৃতং”। এই সব ভাবতে ভাবতে করণপুর পৌঁছে গেছি। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছেন। করণপুর ছোট্ট একটা গ্রাম।

গোটা ষাট বাড়ি। গ্রামের মানুষ জোয়ার বাজরা মিলেট চাষ করে। আর উটের দুধ বিক্রি করে। গ্রামের কাছ দিয়েই রয়েছে ইন্দিরা গান্ধী ক্যানাল। করণপুর ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। এবারে চারপাশের ভূপ্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। রুক্ষ্ম মাটির সাথে দেখা মিলছে বালিয়াড়ির, বালির টিলার। সূর্য বালির পিছনে ডুব মারার পরে যখন আকাশে লাল গোলাপি রঙের খেলা, আমাদের নিয়ে গাড়ি এসে থামল ক্যাম্পের গেটের সামনে। কাগজপত্র দেখানোর পরে বিশাল গেট খুলে গেল।

গেটের দুই ধারে রাখা সক্রিয় এল.এম.জি এর উদ্ধত নলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি আমাদের নিয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করল। সন্ধ্যার স্তিমিত আলোয় বুঝলাম ক্যাম্পটা খুব একটা বড় জায়গা নিয়ে নয়। উচ্চ বৈদ্যুতিক আলোর বন্যায় গোটা ক্যাম্প উদ্ভাসিত। কিন্তু এখানে তো বিদ্যুৎ নেই। গোটা রাস্তায় কোথাও বিদ্যুতের পোস্ট দেখিনি। বুঝলাম তাহলে জেনারেটর।

গাড়ি থেকে নামার পরে একজন এগিয়ে এলেন। ‘আপলোগ কৃপায়া মেরে সাথ আইয়ে’। পিঠের ব্যাগটা নিয়ে তাঁর পিছুপিছু দুই জন হাঁটা লাগলাম। যেতে যেতে চারপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম। অনেকগুলো আলাদা আলাদা ঘর। খুব সম্ভবত পাথরের। নিচু ধরণের। বোধহয় গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘরগুলোর বেশিরভাগ অংশ মাটির নিচে। যাত্রায় শরীর ক্লান্ত।

এখন অন্ধকারে কিছু ভালো করে দেখাও যাবে না। কাল সকালে দেখব। ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে এসে থামলেন ঐ রকমের একটা বাড়ির সামনে। এটা অনেক ছোট। বাঙ্কার। ইশারায় ভিতরে যেতে বললেন। মাথা নিচু করে ঢুকতে হল। ভিতরে ঢুকে বুঝলাম, ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম যে এটা বাঙ্কার। তিনজন সৈন্য সামনের চৌক চৌখুপি দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

একটু বাঁ দিকে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর একজন। আমার নিজের উচ্চতা ছয় ফুট। এনার ছয় ফুট চারের কম হবে না। “ওয়েলকাম জেন্টেলমেন”। প্রায় মেঘের গর্জনের মতন গম্ভীর আওয়াজটা এল তাঁর দিক থেকে। এবারে তিনি বাইনোকুলার চোখ থেকে সরিয়ে আমাদের দিকে ঘুরলেন। মেজর বীরভদ্র চৌহান। কমান্ডার এন্ড বর্ডার পোস্ট ইনচার্জ।

১০৭ রাজপুতনা রাইফেলস। নামটা জানতাম কারণ এটা কাগজে লেখা ছিল। চার পা এগিয়ে এসে তিনি ঘরের মাঝে জ্বলতে থাকা বাল্বটার কাছে এসে দাঁড়ালেন। নামের সাথে চেহারার সাদৃশ্য রয়েছে। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। যেন ঝকঝকে এক ফালি ইস্পাতের তলোয়ার। আমরাও এক কদম এগিয়ে গেলাম। “ওয়েলকাম টু রাজপুতনা রাইফেলস”, বলে তিনি ডান হাতটা প্রথমে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।

আমিও হাত বাড়িয়ে তাঁর সাথে হাত মেলাতে গিয়ে তাঁর হাতের ওজন টা বুঝলাম। আমার হাত অসম্ভব শক্ত ও ভারী বলে দুর্নাম আছে। কিন্তু এনার হাতের চাপটা আমি ভালোই টের পেলাম। রেড্ডির সাথে যখন হাত মেলালেন তখন রেড্ডির মুখটা দর্শনীয় হয়েছিল। আমরা যার যার কাগজ বাড়িয়ে দিলাম। সেগুলো এক ঝলক দেখে নিয়ে তিনি হিন্দিতে বললেন, “আজ আপনারা ক্লান্ত।

অনেক দূরের পথ পেরিয়েছেন। আজ নাহিয়ে, খেয়ে রেস্ট নিন। কাল কথা হবে আর কাজও শুরু করবেন। চলুন আমি আপনাদের পৌঁছে দিচ্ছি।” বাইনোকুলারটা একজনের হাতে দিয়ে তিনি হাঁটা শুরু করলেন। বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে সোজা উল্টো দিকে। তার পিছনে পিছনে রেড্ডি আর আমি। এখানে চারিদিকে বলি। দুটো ওয়াচ টাওয়ার দেখতে পেলাম। ওপাশে কি আছে ঠিক বোঝা গেল না।

দুই তিনটে জোরালো আলো নির্ধারিত দূরত্বে একটা ফাঁকা জায়গার ওপরে ঘুরে চলেছে। প্রায় শ মিটার হাঁটার পরে দুই পাশে সার সার ঘর পড়লো। কোনটা কি কে জানে। চৌহান আমাদের নিয়ে যেখানে ঢুকলেন সেটা বেশ বড় ঘর। সার সার ক্যাম্প খাট আর বিছানা পাতা। কয়েক জন ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চৌহান কে আচমকা দেখে তাঁরা উঠে দাঁড়ালেন। চৌহান একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন “হায়দার, ইধার আইয়ে”।

ছয় ফুট উচ্চতার এক ছিপছিপে চেহারার তরুণ এগিয়ে এসে স্যালুট করে দাঁড়ালেন। ইমতিয়াজ আলী হায়দার। হায়দ্রাবাদ রেজিমেন্ট। লক্ষ্নৌ এর ছেলে। আর্টিলারি বিভাগে দক্ষ। পরিস্থিতি বিচার করে তাকে বিশেষ ভাবে এখানে ডেকে আনা হয়েছে। নিজের সন্তান সম্ভবা স্ত্রী কে ছেড়ে ছুটি কাটছাঁট করে চলে এসেছেন। হায়দার আমাদের দুটো বিছানার দিকে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করলেন।

ঘরটা দেখতে অনেকটা ডোরমেটোরি ধরনের। এই রকম তিনটে ঘর আছে এখানে। রাউন্ড দ্যা ক্লক ডিউটি চলে। নির্ধারিত সময়ে সবাই আসে, বিশ্রাম নেয় আবার ডিউটি তে বেরিয়ে যায়। আমাদের যে রুমটা দেওয়া হয়েছে, তার সিংহ ভাগ বিছানা খালি কারণ তাঁরা সকলে পেট্রোলিং এ বেড়িয়েছেন। ফিরবেন রাত্রে। এখন যারা রয়েছেন তারা আর্টিলারি বিভাগের সাথে জড়িত।

স্নান করে টের পেলাম, সারা দিনের ক্লান্তি কেটেছে এটা ঠিক। কিন্তু এবারে ভীষণ খিদে পাচ্ছে। হায়দার আমাদের পৌঁছে দিলেন খাবার জায়গায়। আর একটা বড় ঘর আর তার ওপাশে বড় একটা রান্না ঘর। রাঁধুনিরা রেঁধে চলেছেন। এরা সৈন্যবাহিনীর পাচক।

কিন্তু দরকারে এরাও যুদ্ধ করতে পারেন। গোটা দুই চাপাটি আর একটা আলুর তরকারি ছাড়া কিছু খেতে পারলাম না। শরীর বড্ড ক্লান্ত লাগছে। একটু ঘুমানো দরকার। খেয়ে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। আমাদের প্রত্যেকের মাথার মধ্যে একটা এলার্ম ঘড়ি আছে। সেটাকে সবাই সক্রিয় করতে পারে না। যারা পারেন তাদের বাইরের কোন এলার্ম লাগে না। আমি এর আগেও দেখেছি, যত রাতেই ঘুমাই না কেন, ঠিক ভোর পাঁচটার মধ্যে আমার ঘুম ভেঙে যায়।

দরকারে আমি রাতের পর রাত জাগতে পারি। কিন্তু যদি তার পরেও ঘুমাই, তাহলেও ঠিক সেই ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যায়। এই অভ্যাসটা আমার এখনো আছে। কেবলমাত্র ছুটির দিনে (বিশেষত শনিবার ও রবিবার) আমার ঘুম ভাঙে সাতটায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। রাজস্থানের আবহাওয়ার একটা বৈশিষ্ট আছে। রাতে আর ভোরে ঠান্ডা। দিনে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

এর কারণ হল সূর্য যত আকাশে চড়তে থাকে, বালি ততই গরম হতে থাকে। বালি আর পাথর যত তাড়াতাড়ি গরম হয়, তত তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডাও হয়। তাই সূর্য ডুবলেই এখানে তাপমাত্রা নীচে নামতে শুরু করে। বিছানা ছেড়ে দেখলাম রেড্ডি তখনও গভীর ঘুমে। বাকি খালি বিছানাগুলোও ভর্তি। বুঝলাম রাতের পেট্রোলিং পার্টি ডিউটি সেরে ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে।

হায়দার কে দেখলাম না। সকালে দৌড়ানোর অভ্যাস আর একটু ব্যায়াম এবং শ্যাডো প্র্যাকটিস করাটা আমার পুরনো অভ্যাস। চন্ডীগড়ে থাকতে, সকালবেলা কমান্ডোদের সাথে দৌড়াতাম। ব্যাগে একজোড়া আলাদা জুতো সব সময় থাকে সেটা পরে, ট্র্যাকসুট আর টি শার্ট পরে নিলাম। গায়ে চড়ালাম একটা হালকা উইন্ডশিটার। বাইরের হালকা কুয়াশা আর ভোরের ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য। ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ভোরের আলোয় এবারে গোটা বর্ডার পোস্ট দেখা যাচ্ছে।

আমি দাঁড়িয়ে আছি পূর্ব দিকে মুখ করে। এদিকে সৈন্যবাহিনীর থাকার ঘর, খাবার রুম আর আরো কিছু ঘর। ওগুলো খুব সম্ভবত অফিস রুম, ওয়ারল্যেস রুম ইত্যাদি। দেখলাম দুটো ১৫৪ মিমি কামানবাহি গাড়ি। বাঁ দিকে গাছের নিচে গোটা আটেক উট জাবর কাটছে দাঁড়িয়ে বা বসে। ওগুলো পেট্রোলিং এর কাজে লাগে। বালির সাগরে মরুভূমির জাহাজই ভরসা।

দরকারে বালির ওপরে জিপের মতন গতিতে ছুটতে পারে। পশ্চিমদিকে এই মাঝে প্রায় ২০০ মিটার মতন ফাঁকা জায়গা। বালি। তারপরে বাঙ্কার আর ট্রেঞ্চ। পশ্চিমের দুই কোনায় দুটি ওয়াচ টাওয়ার। ট্রেঞ্চের ঠিক সামনেই তারকাটার ফেন্স বা বেড়া। প্রায় ২০ ফুট উঁচু। এটা দিয়ে গোটা পোস্টটাই ঘেরা। এবারে ধীর পায়ে হাঁটা লাগলাম পোস্টের মূল দরজার দিকে। দুইজন প্রহরী দুই পাশে লাইট মেশিন গান নিয়ে বসে আছে। ডান দিকের ছোট্ট দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলাম, বাইরে আরো তিনজন প্রহরী।

হাতে সক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। এবারে গত দিন যে রাস্তা দিয়ে এখানে এসে ছিলাম, সেটা দিয়েই দৌড় শুরু করলাম। চারপাশে মাঝেমাঝে বাবলা গাছ আর সেই ক্যাকটাসের ঝোপ। সকালের শান্ত পরিবেশ। একটু কুয়াশা রয়েছে। রাস্তা ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা জায়গায় দেখলাম বেশ কিছু পরিত্যক্ত মাটির ঘরবাড়ি। আগে সম্ভবত গ্রাম ছিল। কোনো কারণে এখন এখানে কেউ থাকে না। দূর থেকে অন্য কেউ জগিং করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।

আরে এত হায়দার। তাহলে ইনিও সকালে দৌঁড়ান। হায়দার আমায় দেখে থামলেন। কপালে হাত ঠেকিয়ে স্যালুট করে বললেন, “সালাম সাহাব, গুড মর্নিং”। আমিও প্রত্যুত্তরে স্যালুট করে মর্নিং জানালাম। হায়দার হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন “রাত ক্যায়সা বিতা সাহাব? আপ ভি সুবাহ জগিং করতে হে”? আমি তাকে জানালাম রাত ভালোই কেটেছে আর জগিং করা আমার পুরনো অভ্যেস। হায়দার আমাকে জানিয়ে দিলেন যে, এই রাস্তা ধরে আমি নিশ্চিন্তে জগিং করতে পারি।

পাশের পরিত্যক্ত গ্রামের কথা জিগ্যেস করাতে বললেন, “বহুত পেহেলে যাহা লোগ রেহতে থে সাহাব। শায়াদ শেলিং কে ডর সে ভাগ গ্যায়ে। ম্যায় তো আকে আইস্যা হি দিখ রাহা হু”। তারপরে এটাও জানিয়ে দিলেন যে এখন থেকে আরো কিমি খানেক দূরে আরোও একটা পরিত্যক্ত গ্রাম আছে। আর তার ঠিক কাছেই আছে রানী কি কিলা। ওটা একটা পুরানো কেল্লার ধ্বংসাবশেষ। আমায় জানিয়ে হায়দার আবার ফিরতি দৌড় শুরু করলেন পোস্টের দিকে।

আর আমি রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করলাম। জগিং করে আরো কিলোমিটার দুয়েক যাবার পরে পুরানো কেল্লার অবশেষ নজরে পড়ল। লাগোয়া পরিত্যক্ত গ্রামটি। ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি। রুক্ষ্ম বালির জমিতে আগাছার জঙ্গল। এটাই তাহলে রানী কি কিলা।

কাল আসার সময় এখানে কিছু একটা দেখেছিলাম বটে। অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। আমি বালির ঢিপি ভেবেছিলাম। কেল্লাটা প্রায় ধসে গেছে। ভিতরে ঢোকা যাবে কিনা জানিনা। মূলত এই সব জায়গায় অনেক প্রাচীন আর্ট এফেক্টস থাকে। পুরানো কোন কাজ, দেওয়ালে খোদিত কোন কাজ ইত্যাদি। আমার নজর থাকে সেগুলোর উপরে। আর প্রতিটা প্রাচীন জায়গার সাথে প্রাচীন অনেক মিথ বা গল্প বা ইতিহাস জড়িয়ে থাকে। স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে সেগুলো জানার চেষ্টা করি।

যাক। পরে দেখতে আসব। এবারে পোস্টের দিকে ফেরার পালা। সূর্য যত ওপরে উঠছে, তাপ ধীরে ধীরে তত বাড়ছে। পোস্টে ফিরে দেখলাম রেড্ডি উঠে পড়েছেন। ফ্রেস হয়ে চা নিয়ে ব্যাস্ত। এবারে আমাকেও তৈরি হতে হবে। কাজ শুরু করতে হবে। সারাদিন কাজের ব্যাস্ততার মধ্যে কাটলো। দুপুরের দিকে চৌহান আমাকে একা ডাকলেন। এক সাথে লাঞ্চ করার জন্য।

রেড্ডি লাঞ্চ করতে চলে গেলেন। আমি চলে এলাম চৌহানের অফিস রুমে। আজ আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে শুরু করলেন। কথায় কথায় তিনি বললেন, “আমার স্ত্রী বাঙালি আছেন”। বেশ চমকেই তার দিকে তাকালাম। তিনি হেসে বললেন, “আপনাদের কলকাতারই মেয়ে। আমার ফোর্ট উইলিয়ামে পোস্টিং হয়েছিল। সেখানেই প্রেম আর তারপরে শাদী।

বাংলা আমি দীপান্বিতার কাছেই শিখেছি”। বুঝলাম তাঁর স্ত্রী নাম দীপান্বিতা। ধন্য সেই বাঙালি রমণী যিনি রাজপুত কে ভালোবাসা দিয়ে জয় করেছেন। চৌহান বলে চললেন, “I just love Bengal and it’s culture. দেশকে আপনারা কত কি দিয়েছেন। টেগোর, নেতাজি, স্বামীজী, বঙ্কিম চন্দ্র, ক্ষুদিরাম। Non ending list। এই দেশের জন্য পাঞ্জাব, রাজস্থান, বাঙ্গাল আর মহারাষ্ট্রের অবদান সবচেয়ে বেশি”।ৎ

চৌহান খেতে ভালোবাসেন। বাঙালি খাবার খুব প্রিয় সেটা গোপন করলেন না। জানলাম ছুটি পেলে স্ত্রী কে নিয়ে কলকাতায় যাবার জন্য মুখিয়ে থাকেন। আমার বাড়ির টুকিটাকি খবর নিয়ে বাড়িতে ফোন করেছি কিনা জানিয়ে যখন উঠছি, তখন চৌহান আমায় বসতে বললেন। তারপরে বললেন, “মিস্টার চক্রবর্তী, আপনার হবিগুলো আমায় কৌর স্যার জানিয়েছেন।

রুক্মিণী
ভারতীয় সেনা

অনেক কথাই জানিয়েছেন। আপনি বীর, নির্ভীক, কালচার্ড লোক তা নিয়ে কোন ডাউট আমার নেই। কিন্তু life is precious। এটা মরুভূমি। Desert can be decisive। কখন কি রূপ দেখায় তা কেউ জানে না। তার ওপরে ঘাড়ের কাছেই শত্রু বসে আছে। কখন কি হবে কেউ জানে না। এখানে মাইলের পর মাইল ফাঁকা বালির ময়দান। কোন ফেন্স নেই। খালি লিমিটেড ডিস্টেন্স এ পিলার লাগানো। এক দিকে হিন্দুস্তান আর অন্যদিকে পাকিস্তান। মাঝে নো ম্যানস ল্যান্ড।

 গল্পের বাকি এবং গুরুত্বপূণ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন……