রাঢ়ী ব্রাহ্মণ: ‘রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের ছাপ্পান্ন গাঞী’, কোলঞ্চ থেকে আগত পঞ্চব্রাহ্মণ রাঢ়ের কৃষ্টিজীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে লোকান্তর গমন করবার পরে তাঁদের পুত্রদের উপরে সেই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল।
কিন্তু আলোর নীচেই ছিল অন্ধকার; সেই ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের মত বিদ্যা- বুদ্ধি অধিকাংশ ব্রাহ্মণ কুমারের মধ্যেই ছিল না। পৈতৃক বিষয় থেকে তাদের স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা নির্বাহ হত এবং তাতেই তাঁরা খুশি ছিলেন। পিতার ঐতিহ্য রক্ষা করবার মত আকাঙ্খা বা সামর্থ্য তাদের অনেকের মধ্যেই দেখা যায় নি।
কোলঞ্চের ওই পঞ্চ ব্রাহ্মণের সেই তেইশজন পুত্রের নাম ছিল -(১) ক্ষিতীশ: ভট্টনারায়ণ, দামোদর, শৌরী, বিশ্বেশ্বর, শঙ্কর।(২) বীতরাগ: দক্ষ, সুষেণ, ভানু, কৃপানিধি। (৩) সুধানিধি: ছান্দড়া, ধরাধর। (৪) মেধাতিথি: শ্রীহর্ষ, গৌতম, শ্রীধর, কৃষ্ণ, শিব, দুর্গা, রবি, শশী। (৫) সৌভরির: বেদগর্ভ, রত্নগর্ভ, পরাশর, মহেশ্বর।বরেন্দ্রজয়ের পরে ‘ভূশূর’ সেই ব্রাহ্মণ কুমারদের মধ্যে ‘দামোদর’, ‘সুসেন’, ‘ধরাধর’, ‘শ্রীধর’ ও ‘পরাশর’কে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
তাঁরাই হলেন সব বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের আদিপুরুষ। বাকি আঠারোজন রাঢ়ে থেকে গিয়েছিলেন। পৈতৃক ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি দিয়ে তাঁদের দিন কেটে যেত, মোটা ভাত মোটা কাপড়ের অভাব তাঁদের কোনদিনই হয়নি। ধনবান ‘সপ্তশতী’দের ঘরে বিবাহ করে তাঁদের মধ্যে দু’-চারজন বেশ বিত্তশালীও হয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু তাঁদের পুত্রদের সময়ে সংসারে অনটন দেখা দিয়েছিল। কলসির জল গড়িয়ে খেলে আর কত দিন চলে? তাঁদের পিতামহরা ছিলেন পাঁচজন, তাঁরা হয়েছিলেন ছাপ্পান্ন জন। সংখ্যা আরো বাড়ছিল। অন্ততঃ তিনজন ব্রাহ্মণ-স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন।
মাত্র পাঁচটি গ্রামের আয় দিয়ে অতগুলি পরিবারের ভরণপোষণ চলত কি করে? তাই তারা নিজেদের অসুবিধার কথা জানিয়ে রাজদরবারে আবেদন পেশ করেছিলেন। ভূশূর ততদিনে গত হয়েছিলেন, তাঁর পুত্র ‘ক্ষিতীশূর’ তখন রাঢ়াধীশ ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের আবেদন নিয়ে নিজের মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন।
যাঁরা বিদ্বান ও জ্ঞানবান তাঁদের প্রতি তাঁর পূর্ণ সহানুভূতি ছিল; কিন্তু মূর্খদের রাজানুগ্রহ দেওয়ার কোন প্রশ্ন ছিল না। কারণ, তাঁদের সাহায্য করবার অর্থ ছিল অজ্ঞতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। রাঢ়াধীশের সেই অভিমত ওই ব্রাহ্মণদের কাছে পৌঁছানোর পরে তাঁরা নিজেদের প্রতি গোত্র থেকে একজন করে সুপণ্ডিতকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে আবার রাজদরবারে পাঠিয়েছিলেন।
সেবার ক্ষিতীশূর তাঁদের উপরে প্রসন্ন হয়েছিলেন, এবং সেই পঞ্চ মুখপাত্রের অনুরোধ রক্ষা করে তাঁদের ৫৬ জন পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্রকে ৫৬টি গ্রাম দান করবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেবারে ঠিক করা হয়েছিল যে, গ্রামের দানপত্রগুলি আগের মত পৃথকভাবে লেখা হবে না, সমাগত ব্রাহ্মণেরা সব ব্রাহ্মণের পক্ষ থেকে ওই গ্রামগুলি গ্রহণ করবেন।
তাঁদের পরিচয় হবে সবার পরিচয়। সবাই তাঁদেরই সন্তান বলে গণ্য হবেন। বিভিন্ন কুলজী গ্রন্থ ওই দান গ্রহণকারী সেই ৫৬ জন ব্রাহ্মণের নাম যে ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ -(১) ভট্টনারায়ণ এর বংশে – বরাহ, গুরি, নান, রাম, গণ, সাতেশ্বর, মহামতী, মধুসূদন, ব্যূঢ়, বিকর্তন, নীপ, বাটু, নীল, কোয়র, সোম, দীন। (২) শ্রীহর্ষের বংশে – জন্ম, ধুরন্ধর, নান, রাম। (৩) দক্ষের বংশে – সুলোচন, ধীর, শ্রীহরি, রাম, কাক, কৃষ্ণ, শুম্ভ, জট, নীল, শুভ, পালু, কেশব, বনমালী, কৌতুক।(৪) ছান্দড়া বংশে – শঙ্কর, বিশ্বম্ভর, সুরভী, ধীর, মহাদশা, মন, গুণাকর, নারায়ণ, শ্রীধর, রবি, কবি।(৫) বেদগর্ভ বংশে – হল, যোগী, মধুসূদন, কুমার, রাজ্যের, বিশ্বরূপ, বশিষ্ঠ, দক্ষ, মদন, গুণাকর, রাম।
এই ভাগ্যবান ব্রাহ্মণদের তালিকা ও তাঁদের শাসন গ্রামগুলির নাম কুলাচাৰ্য্যদের লেখা একাধিক প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই বিষয়ে বিশদ গবেষণা করে ‘নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যার্ণব’ ওই গ্রামগুলির অবস্থান ও উদ্ভূত গাঞীগুলির যে তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন, এখানে সেই তালিকা থেকে গাঞীর নামগুলি উল্লেখ করা হল:(১) ভট্টনারায়ণ বংশে প্রদত্ত (গোত্র: শান্ডিল্য) – বন্দ্য, কুলভী, কুসুমকুলি, গড়গড়ি, ঘোষলি, সেউড়ি, দীর্ঘাঙ্গী, কড়্যাল, মাসচটক, বড়াল বা বটব্যাল, কেশরকোনি, পারি বা পরিহাল, বসুয়াড়ী, কুশারী, ঝিকরাল বা ঝিকরাড়ী, বোকট্টাল।
(২) শ্রীহর্ষ বংশে প্রদত্ত (গোত্র: ভরদ্বাজ) – ডিংসাই, মুখো বা মুখৈটি, সাহড়ী’ বা সাহড়িয়ান, রায়ী।(৩) দক্ষ বংশে প্রদত্ত (গোত্র: কাশ্যপ) – চট্ট, গুড়ী, সিমলাই, পালধী, (কাক-এর কোন গাঞী নেই বা সন্ধান পাওয়া যায় নি), পোড়ারী বা দগ্ধবাটিক, পোষলী, তিলাড়ী, অম্বুলী বা আমরুলী, ভুরি বা ভুরিশ্রেষ্ঠিক, পলসায়ী, পাকড়াশী, মুলী, পীতমুণ্ডী। (৪) ছান্দড় বংশে প্রদত্ত (গোত্র: বাৎস্য): পিপলাই, ঘোষাল, পূর্বগ্রামী, পুতিতুণ্ডী, বাপুলি, হিজ্জল, কাঞ্জিয়াড়ী, চতুৰ্থী, কাঞ্জিলাল, মহিস্তা, শিম্বুলী বা শিমুলায়ী। (৫) বেদগর্ভ বংশে প্রদত্ত (গোত্র: সাবর্ণ): গাঙ্গুলী, ঘণ্টেশ্বরী, পালি বা পালিয়ান, বালিগামি, কুন্দলাল, নন্দী বা নন্দীয়াল, সিদ্ধল, সাণ্ডিশ্বরী, দায়ী, শিয়াড়ী বা সিহারী, নায়ী বা নায়াড়ী।ক্ষিতীশূর পঞ্চব্রাহ্মণের ৫৬ জন বংশধরকে যে ৫৬টি গ্রাম দান করেছিলেন, সেগুলো সবই রাঢ়ে অবস্থিত ছিল (নামের পরিবর্তন ঘটে সেগুলো এখনো রাঢ়েই অবস্থিত)।
নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যার্ণবের হিসাব অনুসারে ব্রাহ্মণদের জন্য দান করা সমস্ত অঞ্চলটি ২২°৫০’ থেকে ২৪°২৮’ ৪৫” উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৬°৪১’ থেকে ৮৮°২৩’৪” পূর্ব দ্রাঘিমান্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অঞ্চলটির উত্তর সীমানা ছিল ‘পাকুড়’, এবং দক্ষিণ সীমানা ছিল হুগলী জেলার ‘ভূরশূট পরগণা’। গোটা অঞ্চলটির সামগ্রিক আয়তন অল্পাধিক দশ হাজার বর্গ মাইল ছিল। ওই স্বল্পপরিসর ভূভাগে বসতি স্থাপন করবার ফলে সেই ব্রাহ্মণেরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও একেবারে সংযোগহীন হয়ে পড়েন নি। উৎসব অনুষ্ঠানে তারা মিলিত হতেন; মাঝে মাঝে আত্মীয় স্বজনের কাছে তত্ত্বতালাশ পাঠাতেন।
তাদের মধ্যে বৈবাহিক আদান প্রদানে কোন অসুবিধা হত না; কারো মৃত্যু হলে পরবর্তী সাত পুরুষ পর্যন্ত তার স্বগোত্রীয় যথারীতি অশৌচ পালন করতেন।এভাবে কয়েক পুরুষ ধরে কাটবার পরে ‘আনন্দভট্ট’ তাঁর ‘বল্লাল-চরিত’ গ্রন্থের (প্রকাশ কাল – ১৪৩২ শকাব্দ, ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ) সর্বপ্রথম গাঞী মালা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বাংলায় রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের সংখ্যা তখন বহু সহস্রে গিয়ে পৌঁছেছিল।
তাঁদের মধ্যে অনেকেই গ্রামান্তরে চলে গিয়েছিলেন, যথেষ্ট সামাজিক অদল বদলও হয়েছিল। তারপরে ‘হরিমিশ্র’, ‘এডুমিশ্র’ (চব্বিশ পরগণা জেলার ‘এড়িয়াদহ’ নিবাসী কুলাচার্য্য ‘কুন্দলালের’ পৌত্র, নানা কারণে তৎকালীন সমাজপতিদের কাছে তিনি বিরাগভাজন হলেও তাঁর লিখিত সমাজকাহিনী শেষ পর্য্যন্ত অভ্রান্ত বলে প্রতিপন্ন হয়েছিল, তাঁর আসল নাম আজও অজ্ঞাত, তিনি গ্রাম নামেই ইতিহাসে পরিচিত) প্রভৃতি বিভিন্ন কুলাচার্য্য সে সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করেছিলেন। সেই বিষয়ে কয়েকটি গ্রন্থও রচিত হয়েছিল। সেগুলি পড়ে রাঢ়ের সর্বত্র জনসাধারণ বলতে শুরু করেছিলেন, “পঞ্চ গোত্র ছাপ্পান্ন গাঞী, তা ছাড়া বামুন নাই”।
ঐতিহাসিকদের মতে উক্ত প্রবাদটি ভ্রান্তিহীন নয়। কারণ, রাজার কাছ থেকে কোন শাসন গ্রাম লাভ না করলেও সপ্তশতী এর মধ্যে তাদের বাস গ্রামের নাম অনুসারে কয়টি গাঞী ততদিনে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তাঁরা ছিলেন হীন ব্রাহ্মণ, তাই কেউ তাঁদের আমল দিতেন না! হরিমিশ্রের আড়াইশো’ বছর পরে ‘বাচস্পতিমিশ্র’ রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যে – ‘বোকট্টাল’, ‘ঝিকুরাল’ ও ‘হিজ্জল’ – এই তিন গাঞী ততদিনে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
প্রাচীন পুঁথির পৃষ্ঠায় সেগুলোর তখনও অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে তিনি সেগুলোর সাথে সম্পর্কিত ব্রাহ্মণদের কোন সন্ধান পান নি। পক্ষান্তরে ততদিনে – ‘কুলিকুলি’, ‘কেয়ারী’, ‘ভট্ট’, ‘পুংসীক’, ‘দীঘল’ ও ‘আকাশ’ – এই ছয়টি নতুন গাঞীর উদ্ভব হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের মধ্যে এইভাবে একদিকে ভাঙন ও অন্যদিকে গড়নের কোন কারণ তিনি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন নি। নগেন্দ্রনাথ বসু – ‘কয়ড়া’, ‘ভট্ট’, ‘পুংস’ ও ‘দীঘল’ – এই চারটি গ্রামের অবস্থান যথাক্রমে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, হুগলী ও বাঁকুড়া জেলায় নির্দ্ধারিত করেছিলেন। কুলিকুলি ও আকাশ গ্রামের সন্ধান তিনি পান নি। বাচস্পতি মিশ্রের উপরোক্ত মত গ্রহণ করলে রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের মোট গাঞী সংখ্যা দাঁড়ায় – ৫৯।
অতীতের ব্রাহ্মণ-ইতিহাস রচয়িতারা তাঁর মতকে সমর্থন করে বলেছিলেন যে, ক্ষিতীশূরের গ্রামদানের সময়ে তিনজন ব্রাহ্মণ-স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন; তাঁদের তিনটি করে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবার জন্য রাঢ়াধীশকে পরে নতুন করে তিনটি গ্রামদান করতে হয়েছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা তাঁদের সেই যুক্তিকে সমর্থন করেন নি।
আজও ছাপ্পান্ন গাঞীর প্রতিই ব্রাহ্মণদের আস্থা অটল। মাঝে যুবসয় এমন কথাও মধ্যে উঠেছিল যে, তিনটি সপ্তশতী গ্রাম ভুল করে রাঢ়ীদের গাঞীমালায় সন্নিবেশিত করে ফেলবার ফলে ওই গাঞী ব্যত্যয় ঘটেছিল, আসলে ছাপ্পান্নটির বেশী গাঞী রাঢ়ীদের মধ্যে নেই। সহস্রাধিক বছর আগে রাঢ়াধীশ ক্ষিতীশূর রাঢ়ী ব্রাহ্মণদেরকে যে গ্রামগুলি দান করেছিলেন, আজও সেগুলির অস্তিত্ব থাকলেও বহু জায়গায় সেখানকার আদি ব্রাহ্মণদের বংশধররা অন্যত্র চলে গিয়েছেন।
কোন কোন গ্রামে আবার ভিন্ন গাঞী ব্রাহ্মণেরা গিয়ে নিজেদের বসতি গড়েছেন। আবার সম্পূর্ণভাবে ব্রাহ্মণশূন্য হয়ে গিয়েছে, অতীতের এমন শাসন-গ্রামও বর্তমানে বিরল নয়। তবুও সেই রাঢ়াধীশের স্মৃতি আজও ব্রাহ্মণ সমাজের পদবীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।অতীতে ব্রাহ্মণদের গোত্র ছিল, কিন্তু তাঁদের কোন পদবী ছিল না।
ক্ষিতীশূর প্রদত্ত গ্রামগুলি লাভ করবার পরে ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে পদবী গড়ে উঠেছিল। প্রথম গাঞী সৃষ্টির সময়ে তিনটি গোত্রে ‘রাম’ নামীয় তিনজন ব্যক্তি ছিলেন। ওই তিন জনের মধ্যেকার পার্থক্য নিরূপণ করবার জন্য তাঁদের নামের শেষে গ্রামের নাম যুক্ত করা ছাড়া অন্য কোন গত্যন্তর ছিল না। ‘রাম পালধি’ থেকে ‘রাম গড়গড়ি’র পার্থক্যকে বোঝাবার জন্য দ্বিতীয় কোন উপায়ও ছিল না। এইভাবে ব্রাহ্মণদের মধ্যে পদবীর সূত্রপাত হলেও, তাঁদের গাঞী পূর্ণাঙ্গ পদবীতে পরিণত হতে বেশ কয়েক পুরুষ সময় লেগে গিয়েছিল।
ইতিহাস বলে যে, পৃথিবীর সর্ব দেশে দেশে সর্বকালে এই একইভাবে পদবীর উদ্ভব ঘটেছিল। কাশ্মীরাগত এক ব্রাহ্মণ পরিবার উত্তরপ্রদেশের কোন নহরের তীরে বাস করবার ফলে ‘নেহেরু’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। পার্শীদের মধ্যে ‘আক্লেসারিয়া’, ‘বিলিমোরিয়া’ প্রভৃতি পদবীগুলির মূলে বিশেষ কোনও নগর বা গ্রামের নাম পাওয়া যায়। বর্তমানে বৃত্তিভিত্তিক পদবীও যথেষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। উকিলের পৌত্র চিকিৎসা বা ব্যবসায়ী হয়েও নিজের পিতামহের পেশাকে নিজের বংশ পরিচয়রূপে ব্যবহার করেন।
ম্যাকমিলান প্রভৃতি ‘স্কচ’ বা ও’কোনার প্রভৃতি ‘আইরিশদের’ পদবীগুলির উদ্ভবও অনুরূপভাবে হয়েছে। ‘মকরন্দ’ প্রভৃতি কায়স্থদের বংশধরেরাও এই একইভাবে গ্রামভিত্তিক পদবী লাভ করেছিলেন কিনা সেটা বলা সম্ভব নয়। যে ‘ঘোষ’ বা ‘বসুয়া’ গ্রাম থেকে রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের ‘ঘোষাল’ বা ‘বসুয়াড়ী’ পদবীর উদ্ভব হয়েছে, কায়স্থদের ‘ঘোষ’ ও ‘বসু’রাও যে সেই গ্রামগুলি থেকে উদ্ভুত পদবী ব্যবহার করেন না এমন কথা কেই বা বলতে পারেন? আবার বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে একই পদবী দেখে মনে হয় যে, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা হয় তো একই বৃত্তিভোগী বা একই গ্রামের অধিবাসী ছিলেন; পরে তারা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিলেন।সপ্তশতী ব্রাহ্মণদের মধ্যে ঠিক এমনিভাবেই ধীরে ধীরে গ্রামভিত্তিক পদবীর উদ্ভব ঘটেছিল।
‘বাচস্পতি মিশ্র’ ও ‘দেবীবর ঘটকের’ হিসাব অনুসারে এই শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের গোত্র ছিল আটটি ও গাঞী ছিল আঠাশটি। ‘সম্বন্ধ-নির্ণয়’ গ্রন্থ প্রণেতা সেই গাঞীগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে নির্দ্ধারিত করেছিলেন -(১) কৌণ্ডিন্য গোত্রে: পিখুড়ী, বাল খুবি, নানকশাহী, নালসী, জগাই, ভাগাই, সাগাই, আখর ইত্যাদি।(২) গৌতম গোত্রে: গোস্বামী, যবগাঁই।(৩) পরাশর গোত্রে: রায়, নালগিগাঁই, নিখুড়ী।(৪) কাশ্যপ গোত্রে: রায়, কাশ্যপ-কাঞ্জাড়ি।সপ্তশতী ব্রাহ্মণদের আরো গোত্র ও গাঞী রয়েছে। শুনক, বশিষ্ট, হারীত ও কৌৎস গোত্রে কালাই, হেলাই, দাই, বানসি, বাল্টরি, ফরফর, বড়ল, যাস, কাটানি প্রভৃতি গাঞী প্ৰসিদ্ধ।
নদীয়া জেলার শান্তিপুর, ফুলিয়া, বেলগড়; বর্ধমান জেলার সিংয়েরকোন, পালশীট, নবগ্রাম, ময়নানড়; হুগলী জেলার সিমলাগড়ী, নালসী, চুঁচুড়া, ফরাসডাঙ্গা, শ্রীরামপুর; চব্বিশ পরগণা জেলার কলকাতা, জয়নগর, পলাবাড়ী, বিষ্ণুপুর প্রভৃতি জায়গায় এই সব গাঞীর সপ্তশতী ব্রাহ্মণ আজও যথেষ্টই রয়েছেন। তবে তাঁদের অনেকে এখন নিজেদের গাঞীর পরিবর্তে ‘গোস্বামী’, ‘চক্রবর্তী’, ‘ভট্টাচাৰ্য’ প্রভৃতি উপাধি ব্যবহার করেন। অতীতে রাঢ়ী ও বারেন্দ্রদের আচরণে তাঁরা বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন; আজও তাঁদের হীনাবস্থা থেকে উন্নয়নের ক্ষীণ দাবীও মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যায়। তাঁদের পদবী পরিবর্তন সেটারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
এইভাবে পদবী পরিবর্তন রাঢ়ীদের মধ্যেও খুব একটা কম হয় নি। দশম শতাব্দীতে ‘ধরাশূর’ যখন ব্রাহ্মণদেরকে নতুন কুলমর্য্যাদা দিয়েছিলেন, সম্ভবতঃ তখন বা তারপরে কোন একটা সময়ে ‘বন্দ্য’ বংশীয় ‘মহেশ’, ‘মুখো’ বংশীয় ‘উৎসাহ’, ‘চট্ট’ বংশীয় ‘অরবিন্দ’ এবং ‘গাঙ্গুল’ বংশীয় ‘শিশু’ তাঁদের পাণ্ডিত্যের জন্য রাজার কাছ থেকে বিশেষ উপাধি পেয়েছিলেন। সেই থেকে উক্ত চার বংশীয় সব ব্রাহ্মণের নিজেদের গ্রামীন পদবীর শেষে সম্মানসূচক ‘উপাধ্যায়’ কথাটি যোগ করবার রীতি প্রচলিত হয়েছিল। সেই উপাধ্যায়যুক্ত গাঞী কালক্রমে তাঁদের স্থায়ী পদবীতে পরিণত হয়েছিল।
বন্দ্যোপাধ্যায় বা চট্টোপাধ্যায়রা স্বমর্য্যাদায় চারিদিকে ঘোরাফেরা করবার ফলে অন্য গ্রামীন ব্রাহ্মণেরা ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিলেন। উপাধ্যায়দের তুলনায় নিজেদের ছোট করে রাখাটা তাঁদের মনঃপূত হয়নি। সেই কারণে তাঁদের অনেকে নিজস্ব গাঞী ত্যাগ করে স্বগোত্রীয় উপাধ্যায় ব্রাহ্মণদের পদবী গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন।
যদিও ঐভাবে পদবী পরিবর্তন কিছু দোষণীয় নয়, কারণ সেক্ষেত্রেও গোত্র অপরিবর্তিত থেকে যায়। এইভাবে স্ফীতিলাভ করবার ফলে বন্দ্য, মুখো, চট্ট ও গাঙ্গুল গাঞীর সংখ্যা বর্তমানে গড়গড়ি, পূতিতুণ্ডি, পাকড়াসী, পিপলাই, বাপুলি, রাই প্রভৃতি গাঞীর তুলনায় বেশী হয়ে গিয়েছে। ওই সব গাঞির অনেকে উপাধ্যায় এর মধ্যে অনুপ্রবেশ না করলে তাদের সংখ্যা এমন ভাবে স্ফীত হতে পারত না। অতীতের ব্রাহ্মণ ইতিহাস রচয়িতারা সেই প্রথাকে ‘উপাধির ব্যভিচার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে সেই ব্যভিচার আজও চলছে।
তথ্যসূত্র:১- বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কাণ্ড, নগেন্দ্রনাথ বসু।
২- বল্লাল চরিত, আনন্দভট্ট।
৩- ব্রাহ্মণ ইতিহাস, হরিলাল চট্টোপাধ্যায়।
৪- সাগর প্রকাশ, বনমালী ভট্টাচার্য্য।
লেখক- ©️রানা চক্রবর্তী©️