মহাকাব্য মহাভারত: পৃথিবীর চারটি মহাকাব্যের মধ্যে দুইটি আমাদের পূর্ব পুরুষের দেওয়া মহাভারত ও রাময়ণ। যার মধ্যে মহাভারত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সুবৃহৎ মহাকাব্য হলেও বাংলাদেশে এটি সাধারণ পাঠ্যক্রমে কখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি!
কেন হয় নি? যদিও এই মহাকাব্য ইলিয়াড-অডিসির মতোই মহান ও প্রাচীনতম; বলা হয়ে থাকে এই মহাকাব্য ভারতীয় চিৎপ্রকর্ষ তথা ধীশক্তির ইতিহাস। কিন্তু কেন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি হয় তার কোন সঠিক উত্তর জানা নেই।
‘মহাভারতের রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ অংশটি মূল্যবান তথ্যে ভরা। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত বইটির সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ যেসব উক্তি করেছেন, তা সে-সময় আলোড়ন তুলেছিল। প্রাচীন সাহিত্য আলোচনায় বারবার এসেছে মহাভারত। মহাভারত বিষয়ে ক্রমে ক্রমে দার্শনিকতার একটি স্তরে পৌঁছে যান আধুনিক বাংলা ভাষার সাহিত্য নির্মাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আমরা যখন অসহিষ্ণুতা, অন্ধত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার দিকে দিনদিন ধাবিত হচ্ছি ঠিক তখন পৃথিবীর সবচে ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরব জোর কদমে এগিয়ে চলছে সহিষ্ণুতা,অসাম্প্রদায়িকতা আর আলোর পথে! সৌদি আরব বুঝতে পেরেছে আগামী পৃথিবীটা হবে সহযোগিতার, বহু সংস্কৃতির, গণতান্ত্রিক এবং বৈশ্বিক। তাই তারা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করছে। সৌদি আরব রামায়ণ এবং মহাভারত আরবি ভাষাতে অনুবাদ করে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
মহাকাব্য মহাভারত
মহাভারত আকারে ও মাহাত্ম্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মহাকাব্য। চারটি জাত মহাকাব্যের একটিও বটে। মূলগ্রন্থ সংস্কৃতে রচিত হলেও বিভিন্ন ভাষার অনুবাদগুলোও মূল পাণ্ডুলিপি থেকে কম জনপ্রিয়তা পায়নি।
পণ্ডিতদের মতে মহাভারত এমন একটি গ্রন্থ যা মানব সভ্যতার প্রতিটি যুগে প্রতিটি সমাজে কিছু না কিছু দিতে পারে। জগতের তাবৎ শ্রেষ্ঠ বস্তুর সঙ্গে একে তুলনা চলে। তাই একে বলা হয়েছে: “মহত্ত্বাদ্ ভারতবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে”।
মহাভারতের মূল উপজীব্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। হস্তিনাপুরের সিংহাসন দখল নিয়ে যে টানাপোড়েন কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে শুরু হয়, তার পরিণাম আঠারো দিনব্যাপী প্রলয়ঙ্কর সংঘর্ষ। প্রথমে কেবল চাচাতো ভাইদের মধ্যে থাকলেও শীঘ্রই তাতে যোগ দেয় সারা ভারতের নৃপতিগণ। জড়িত হয় অঙ্গ, চেরি, গান্ধার, কলিঙ্গ, কুশল, মদ্র, মগধ, নিষাদ এবং পাঞ্চালের মতো অনেক রাজ্য। পাণ্ডবপক্ষে যুধিষ্ঠিরেরা পাঁচ ভাই, ধৃষ্টদুম্ন এবং কৃষ্ণ। কৌরবপক্ষে দুর্যোধন ভ্রাতৃবর্গ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, অশ্বত্থামা এবং শকুনি। পাণ্ডবপক্ষে ৭ অক্ষৌহিনী সেনা।
প্রাচীন পুঁথি থেকে যা জানা যায়, মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল তখনকার জনসংখ্যার আশি শতাংশ পুরুষ।
মহাকাব্য মহাভারত:
যুদ্ধ শেষ হলে সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে, সত্যিই কি এখানকার মাটি মহাপ্রতাপশালী পান্ডব এবং কৌরবদের রক্তে শুষে নিয়েছে। এক কম্পিত কন্ঠ তিনি শুনতে পান,
” সত্য কী, তা তুমি কখনোই জানতে পারবে না বৎস..!!”
সঞ্জয় গেরুয়া পোশাকধারী এক বৃদ্ধকে ধুলোর স্তম্ভ থেকে উঠে আসতে দেখেন।
– কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তোমার বোধগম্য হবে না, যতক্ষণ না তুমি বাস্তবে বুঝবে যুদ্ধটা কি বস্তু। মহাভারত একটি দৃষ্টান্ত, একটি মহাকাব্য, হয়ত বাস্তব, হয়ত বা দর্শন।
স্মিত হেসে বৃদ্ধ সঞ্জয়ের দিকে তাকান।
– অনুগ্রহ করে যদি বলেন ওই দর্শন বস্তুটি কি..??
-নিশ্চয়, পঞ্চপান্ডব হলো আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় ছাড়া কিছু না। দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ ও ধ্বনি।
– আর কৌরবরা কী.??
– কৌরব আমাদের একশতদোষ যারা প্রতিনিয়ত আমাদের ওই পাঁচ ইন্দ্রিয়কে আক্রমণ করছে। জান কখন..??
সঞ্জয় আবার মাথা নাড়েন।
-বিশ্বাস যখন তোমার সাথে থাকে, তখন..!!
বৃদ্ধ ঝকঝকে হাসি হাসেন এবং সঞ্জয় এই অন্তর্নিহিত জ্ঞান প্রাপ্তিযোগে অবাক চোখে বৃদ্ধকে দেখেন।
-বিশ্বাস তোমার অন্তর ধ্বনি, তোমার আত্মা, তোমার পথপ্রদর্শনকারী আলোকস্তম্ভ। তুমি যদি তাঁর হাতে নিজেকে সমর্পিত করে দাও, তুমি চিন্তামুক্ত থাকবে আজীবন।
মহাকাব্য মহাভারত:
সঞ্জয় কিছুক্ষণ বোকার মত বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আবার সামলে নিয়ে প্রশ্ন করেন,
– তাহলে দ্রোণাচার্য, ভীষ্মপিতামহ কেন কৌরবের হয়ে লড়াই করলেন, যদি কৌরবরা দোষী হয়..??
ধীরে মাথা নেড়ে বৃদ্ধ বলেন,– যখন কেউ বড় হয়, তার ধারণা বয়স্ক মানুষদের প্রতি বদল হতে থাকে। ছেলেবেলায় যে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের মনে হত তারা সঠিক, বড় হয়ে বুঝতে পারে, ততটা ঠিক নন তারা। তাদেরও দোষ আছে। একটা দিন আসে যখন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাদের সঙ্গ তোমার জন্যে ভাল কি মন্দ।
বাকরূদ্ধ হয়ে সঞ্জয় হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়েন।
– তাহলে কর্ণকে কী বলবেন..??
-আহ্, তুমি তোমার সর্বোত্তম প্রশ্ন সবার শেষে করেছ। কর্ণ তোমার ইন্দ্রিয়গণের ভ্রাতা। সে বাসনা। সে তোমারই এক অংশ কিন্তু সে সঙ্গ দেয় দোষের। যদিও সে দোষীর সঙ্গ দিয়ে মনে মনে পীড়া অনুভব করে কিন্তু নিজেকে ঠিক সাব্যস্ত করার জন্যে নানান যুক্তি দেয়, ঠিক যেমন তোমার বাসনা সর্বক্ষণ তোমায় যুক্তি যুগিয়ে চলে। তোমার বাসনা তোমায় মিথ্যে যুক্তি দিয়ে মন ভোলানোর চেষ্টা করেনা কি সর্বদা..??
সঞ্জয় ওপর থেকে নিচে মাথা নাড়ান। তারপর ভূমির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মনে তাঁর লক্ষ-কোটি প্রশ্ন তোলপাড় করে। খানিকবাদে যখন তিনি মাথা তোলেন, বৃদ্ধ তখন সেখান থেকে প্রস্থান করেছেন। পেছনে ফেলে রেখে গেছেন, এক চিলতে জীবনদর্শন মহাকাব্য মহাভারত।