“অর্ধেক ডিম দিলাম, পুরো খেতে হবে কিন্তু। দুপুরে খেয়ে এসেছেন না বাড়ি গিয়ে খাবেন? দরজা খুলুন, খেয়ে এসেছি।”
ফেসবুকে আসার পরে এমন অনেক মন্তব্য বা স্ট্যাটাস দেখতাম, প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝলাম এগুলো আমাদের মানে ভারতীয় বাঙালীদের উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গ করে বলা। আমরা নাকি বেজায় কিপটে, বাড়িতে অতিথি এলে আপ্যায়ন করতে জানি না। অভিযোগ যদি মেনেও নেই তার পরেও কিন্তু কিছু কথা থাকে। একই সাথে থাকা এক জনগোষ্ঠী হঠাৎ আলাদা হয়ে যাবার পরে মাত্র ৭০ বছরে কি এই পরিবর্তন সম্ভব, নাকি অন্য কোন কারন আছে এর পিছনে।
ছোটবেলায় বাড়িতে কোনদিন গোটা ডিম জোটে নি, চুনো মাছ হত বড়জোর সপ্তাহে দুতিন দিন; আর মাংস হত কালেভদ্রে। অতিথি এলে মা মাসি পিসীদের দেখেছি নিজের থালা এগিয়ে দিতে। যতদিন সেলাই করে পরা যায় ততদিন নতুন জামাকাপড়ের মুখ দেখতে পেতাম না আমরা। স্কুলে টিফিন নিয়ে যাওয়া ছিল বিরাট বিলাসিতা। দুপুরে টিফিন হলে বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে আবার দৌড় স্কুলের উদ্দেশ্যে। নতুন বছরে আমরা স্কুলের দাদাদের আগের বছরের বইগুলি সংগ্রহ করতাম অর্ধেক দামে। পুজোয় আমাদের নতুন জামা হলেও বাবার জন্য নতুন কাপড় হতে দেখিনি কখনো। তবে মাথার ওপর একটা ছাদ আর ভবিষ্যৎ জীবনে লড়ার রসদ তাঁরা রেখে গেছেন আমাদের জন্য। নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই জীবনভর লড়াই আপাত দৃষ্টিতে চোখে পড়ে না, কিন্তু আমাদের জীবনের প্রকৃত হিরো আমাদের বাপদাদারাই।
দেশ ভাগের পরে আমাদের বাপদাদারা আশ্রয় নেন এই দেশে সম্পূর্ণ সহায় সম্বলহীন অবস্থায়; এক কাপড়ে, শুধু জান বাঁচানোর তাগিদায়। মাথার ছাদ তো দূর অস্ত, পরনের কাপড় বা মুখে তোলার খাবার সংস্থানটুকুও ছিলনা তাদের। নিজেরা আধপেটা খেয়ে বা না খেয়েও আমাদের মুখে খাবার তুলে দেন। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে কিন্তু কোন কার্পণ্য করেন নি তাঁরা। একটা প্রায় অসম্ভব লড়াই, নিজেদের সবটুকু বাজি রেখে পরের প্রজন্মকে একটা সুস্থ জায়গা করে দেবার লড়াই; সম্পূর্ণ শূন্য থেকে শুরু করে প্রচণ্ড জীবনসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করার লড়াই। তার পরেও আপনাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেদের ভাতের থালা ভাগাভাগিতে কার্পণ্য করেন নি তাঁরা, নাহয় অর্ধেক ডিমই সই। আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি তাদের আত্মত্যাগের ওপরে।
আমার এক বন্ধুর বাবা ছিলেন পেশায় রিকশা চালক। ক্লাস ১১এ পড়া বড় ছেলের বন্ধু না জেনে একবার তারই রিক্সায় আসেন তাদের বাড়িতে। না, এতটুকু হীনমন্যতা দেখিনি সেই বন্ধুর পরিবারের। কাকু আজ নেই, কিন্তু আমার বন্ধু ও তার দুই ভাই আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে এপার বাংলার অলিতে গলিতে।
দাদা/ ভাই/ বন্ধুরা, এই কৌতুকটা করার আগে ইতিহাসটা একটু তলিয়ে দেখবেন। এটা কিন্তু আমাদের কাছে মোটেই ঠাট্টা নয়, বরং ভীষণ গর্বের; আমাদের বাপদাদাদের আত্মত্যাগের। আর কে জানে, এই কৌতুকটা নিয়ে আরও একটু তলিয়ে ভাবলে হয়তো আপনারা ভারী লজ্জাও পেতে পারেন।
G C