ভাষাতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।।

ভাষাতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ( জন্মঃ- ২৬ নভেম্বর, ১৮৯০ – মৃত্যুঃ- ২৯ মে, ১৯৭৭ )

আফ্রিকার কোনও এক রাস্তার ধারে মাঠের মধ্যে অর্ধনগ্ন প্রান্তীয় মানুষজনদের পাতায় করে কিছু খেতে দেখে ড্রাইভারের দিকে ধেয়ে এসেছিল প্রশ্ন, ‘গোল হয়ে বসে কী খায় ওরা? চাইলে আমাকে চাখতে দেবে?’  ‘দেবে’, শোনামাত্র গাড়ি থেকে নেমে সেই বিচিত্র তেতো ও টক স্বাদের খাদ্যের সঙ্গে মোলাকাত। ‘ভয় করল না, যদি শরীরে না সয়?’— প্রশ্নে অবলীলায় বলেন, ‘সইবে না কেন, মানুষই তো ওটা খাচ্ছিল।’ কবিকে যেমন শুধু তার জীবন-চরিতে পাওয়া যায় না, তেমনই বিশ্ববিশ্রুত ‘ওরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব বেঙ্গলি ল্যাংগোয়েজ’ বা ওডিবিএল-এর সীমার মধ্যে আটকা পড়ে থাকার লোক সুনীতিকুমার নন। আসলে তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল মানবসভ্যতার আবহমান বৈচিত্র। হিউম্যানিটিজ-এর সামগ্রিক চর্চাতেই তিনি পেয়েছিলেন বেঁচে থাকার জ্বালানি। তাঁর অভিযানের রাজপথ ছিল, ভাষা।

সম্মাননা
১৯৩৫ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।
১৯৪৮ সালে হিন্দি ভাষায় বিশেষ অবদানের জন্য সাহিত্য বাচস্পতি উপাধি লাভ করেন।
১৯৫০ সালে লন্ডনের সোসাইটি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯৫২-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের অধ্যক্ষ পদে বহাল ছিলেন।
১৯৫৫ সালে অসলোর নরওয়েজিয়ান অ্যাকাডেমির সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯৬৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৬৬ সালে ভারতের জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা লাভ করেন।
১৯৬৯ সালে সাহিত্য অকাদেমীর সভাপতি নির্বাচিত হন।
এছাড়াও, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাচার্য উপাধি গ্রহণ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে।

‘ভারতবর্ষ পাণিনির দেশ, আজও সেখানে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আছেন, সে দেশের ছেলেমেয়েরা ভাষাতত্ত্ব শিখতে কেন যে বিদেশে আসে তা আমি বুঝতে পারি না’, পাশ্চাত্য পণ্ডিতের এই কথাটি আমাদের ছোঁয়। সুনীতিকুমারের সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র, খ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন সারা জীবনে এক বারও বিদেশে না যাওয়ার কারণ হিসেবে আক্ষরিক অর্থেই সুনীতিবাবুকে ‘পশ্চিমের জানলা’ রূপে পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন, তা-ও আমাদের নজর এড়ায় না। আসলে সুনীতিকুমারের মেধার মহাসাগর অতলান্ত, পাণ্ডিত্যের পর্বত গগনচুম্বী। আর? এই ‘আর’-এর মধ্যেই খোঁজ মিলবে তাঁর সম্পূর্ণতার। গুরুর মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুকুমার সেন তাই বলেন, ‘উচ্চতা অনেক রকমের হয়। অট্টালিকাও উচ্চ, আবার মহীরূহও উচ্চ। একটি নিষ্প্রাণ, অন্যটি জীবনরসে সমৃদ্ধ। সুনীতিবাবুর ছিল সেই বনস্পতির উচ্চতা।’
১৮৯০ থেকে ১৯৭৭— এই ৮৭ বছরের জীবনে, জাতীয় অধ্যাপকের উচ্চতা বা বিশ্বখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানীর গাম্ভীর্য সরিয়ে বার বার বেরিয়ে এসেছে তাঁর সহজ-সরল সত্তাটি। এক বার গ্রাম থেকে এক ভদ্রলোক তাঁর বাড়িতে এসেছেন। কিন্তু সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। সংকোচের সঙ্গে বলছেন, ‘স্যর, খালি পায়ে এসেছি। পায়ে ধুলো ভর্তি।’ সুনীতিকুমার হেসে বললেন, ‘আমরা বাঙালি। আমরা বহু দিন থেকে শুধু বলে আসছি, বাড়িতে পায়ের ধুলো দেবেন। ফলে কুণ্ঠিত হবেন না। ভেতরে চলুন।’ কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের বই বিক্রেতারা তাঁকে জানতেন বিপদে-আপদে কাছের মানুষ হিসেবে। কোনও বই-ফেরিওয়ালা অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করতেন তিনি। কংগ্রেস মন্ত্রিসভা এক সময় ফুটপাতে বই বিক্রি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। বিরোধিতা করে  সুনীতিবাবু প্রতিবাদপত্র পাঠালেন মুখ্যমন্ত্রীকে। বন্ধ হল সেই চেষ্টা।
নিজের সময়ে নিজের দেশের পয়লা নম্বর ভাষাবিজ্ঞানী। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্ত থেকে আমন্ত্রণ। গবেষণা, বক্তৃতা, খ্যাতি, পুরস্কার। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘ভাষাচার্য’, উপন্যাসের নায়কের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন ‘সুনীতি চাটুজ্যের বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব’। কিন্তু এ হেন সুনীতিকুমার সারাটা জীবন শুধু ভাষাবিজ্ঞানী হয়ে থাকলেন না। এ নিয়ে অনেকেরই অভিযোগের অন্ত নেই। তাঁরা ভাষাবিজ্ঞান কতটা বোঝেন জানা নেই, কিন্তু সুনীতিকুমারকে বোঝেননি। ভাষাকে আশ্রয় করে তিনি পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন মানুষের সংস্কৃতি তথা জীবনের বিস্তৃত চৌহদ্দিতে। ১৯৫৯-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া কমলা বক্তৃতায় তাঁর প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ইন্ডিয়ানিজম বা ভারতীয়ত্ব। বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করা ভদ্রলোকটি বেশি করে ভাবতে শুরু করলেন বাঙালিত্ব নিয়ে। ইরান বা আফ্রিকা নিয়ে তাঁর বইগুলো পেল ইরানিয়ানিজম বা আফ্রিকানিজম জাতীয় শিরোনাম। ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে গেল জ্ঞানচর্চা আর উপলব্ধি। ভাষার সঙ্গে গুরুত্ব পেল ইতিহাস, শিল্প, মিথ, ধর্ম এবং অবশ্যই সংস্কৃতি। কালচার-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে কৃষ্টি-র বদলে সংস্কৃতি-র দিকে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনিই। বাংলা ভাষায়   অন্-আর্য অস্ট্রিক দ্রাবিড়দের ভাষার প্রভাব আগেই বিশ্লেষণ করেছিলেন। আর্য-প্রধান ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রোটো অস্ট্রালয়েড অস্ট্রিক দ্রাবিড়দের পাশাপাশি উত্তর-পূর্বের মোঙ্গলয়েড নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভোট-চিনীয় কিরাতদের অবদান সেই প্রথম জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন। লিখে ফেললেন ‘কিরাত-জনকৃতি’ নামের আস্ত একটা বই। আসলে ভারতীয়ত্ব বলতে তিনি শুধু ‘বেদ-ব্রাহ্মণ-সূত্র-পুরাণ-পিটক-তন্ত্র’ চর্চা বুঝতেন না, তার সঙ্গে যে ‘জনসাধারণের বিশ্বাস আর আচার, জঙ্গলী সাঁওতাল ধাঙড় গারোর ধর্মের আচারেরও চর্চা দরকার’ সে কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন আর যুক্তি দিয়ে এর প্রয়োজনীয়তা প্রমাণও করেছিলেন। সারা পৃথিবীর সংস্কৃতির প্রতি তাঁর এই আকর্ষণের ভিত্তিভূমি হয়তো প্রস্তুত হয়েছিল রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে। ১৯২৭-এ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা, তাইল্যান্ড, মালয়, বালি ভ্রমণের আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা তো আমরা পেয়েছি তাঁর ‘রবীন্দ্র-সংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ’ নামক বইটিতে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘জাভাযাত্রীর পত্র’-এ জানাচ্ছেন, ‘আমাদের দলের মধ্যে আছেন সুনীতি। আমি তাঁকে নিছক পণ্ডিত বলেই জানতুম। অর্থাৎ, আস্ত জিনিসকে টুকরো করা ও টুকরো জিনিসকে জোড়া দেওয়ার কাজেই তিনি হাত পাকিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এবার দেখলুম, বিশ্ব বলতে যে ছবির স্রোতকে বোঝায়, যা ভিড় করে ছোটে এবং এক মুহূর্ত স্থির থাকে না, তাকে তিনি তালভঙ্গ না করে মনের মধ্যে দ্রুত এবং সম্পূর্ণ ধরতে পারেন আর কাগজে-কলমে সেটা দ্রুত এবং সম্পূর্ণ তুলে নিতে পারেন। এই শক্তির মূলে আছে বিশ্ব-ব্যাপারের প্রতি তাঁর মনের সজীব আগ্রহ।’
সুনীতিকুমারের ব্যক্তিত্বের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল যুক্তিবোধ। এই যুক্তিবোধ শুধু অদম্য নয়, নৈর্ব্যক্তিকও। অনেকেই সুনীতিকুমারের বিভিন্ন স্ববিরোধিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছেন। বহু সিদ্ধান্তকে হঠকারীও বলেছেন। কিন্তু ভেবে দেখেননি, তাঁর কাছে প্রতি-আক্রমণের সম্ভাবনার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ছিল: আত্মসমীক্ষা। আর, নিজের সিদ্ধান্ত বদলের ক্ষেত্রে কখনওই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি ইগো। একেই তো বলে প্রকৃত যুক্তিবাদী। এক সময় তিনি হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সরব হয়েছিলেন। পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁর আলোচনাও হয়েছিল। পরে উপলব্ধি করলেন, পরিসংখ্যানই শেষ কথা নয়। এতে সাংস্কৃতিক সমন্বয় তো দূর অস্ত্, প্রাদেশিক বিভেদই বৃদ্ধি পাবে। সুনীতিবাবুর মতো মানুষ নিজের ভুল স্বীকার করেছিলেন। এ খুব সহজ ব্যাপার নয়। আবার ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও বেশ পরিবর্তন এসেছিল তাঁর মধ্যে। এক সময় তিনি হিন্দু ব্রাহ্মণ্য আচার-অনুষ্ঠান নিয়ম করে মেনে চলতেন। শিবভক্ত ছিলেন, গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, পৈতে পরা বা পুজোর আগে উপোস করাও ছিল নিত্যকার ব্যাপার। মহালয়ার দিন তর্পণ করতেন। আবার বলতেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে তাঁর প্রদত্ত অন্ন-জল-পিণ্ড তাঁর পূর্বপুরুষেরা খাচ্ছেন। রোজ ঠাকুরঘরে যেতেন, পুজো করতেন। গীতা-উপনিষদ-বাইবেল-কোরান-রামায়ণ-মহাভারত-হোমার-রবীন্দ্রনাথ— সব কিছুই পড়তেন পুজোর ঘরে। তাঁর ধর্মবোধে কোনও অন্ধতা ছিল না, ছিল ঐতিহ্যের অনুসন্ধান। আর তাই একেবারে শেষ জীবনে তাঁর রামায়ণ-ভাবনায় গোঁড়া হিন্দুরা গেল খেপে। দিল্লি ও কলকাতায় আয়োজিত সেমিনারে রামকথার প্রাচীন উৎস হিসেবে বৌদ্ধদের দশরথ-জাতকের ১৩টি পালি গাথার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। রামায়ণ যে একা বাল্মীকির রচনা নয়, তা যে চ্যবনমুনি প্রমুখ অনেকের সম্মিলিত সৃষ্টি সে কথাও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করলেন। রামায়ণের প্রাচীন উৎসে রাম-সীতার সহোদর সম্পর্ক অর্থাৎ ভাই-বোনে বিবাহের কথা উত্থাপন করায় সুনীতিবাবুকে তীব্র গালাগাল শুনতে হয়েছিল, বাড়িতে এসেছিল হুমকি-চিঠি। দেশ জুড়ে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। কিন্তু সুনীতিকুমার আমৃত্যু যুক্তিবাদী। তিনি রামায়ণকে ভারতের মহান ঐতিহ্য বলে মনে করতেন আর তার রূপায়ণে যে ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে তা-ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন। একটা কথা বার বার বলতেন, ভারতীয়রা যে দিন এক হাতে ডিমের অমলেট খেতে খেতে অন্য হাতে বেদ পড়তে পারবে, সে দিনই বেদের যথার্থ মূলায়ন সম্ভব।
মতি শীলের অবৈতনিক ইস্কুল থেকে ভারতের জাতীয় অধ্যাপক— এই আশ্চর্য উড়ান কিন্তু কোনও দিনই ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং’ প্রবাদকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। তাঁর প্রতিভার প্রশংসা করলে তিনি অবলীলায় বলতেন, ইউরোপের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর ঝাঁট দিলে নাকি দশ-বিশটা সুনীতি চাটুজ্যে পাওয়া যাবে। আবার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বই কাউকে দেখাতে হলে তাঁকে উৎসর্গ করা বইগুলো লুকিয়ে রাখতেন, পাছে সেটা আত্মপ্রচার হয়ে দাঁড়ায়। কোনও মানুষের, এমনকী ছাত্রছাত্রীদেরও প্রণাম নিতেন না, উলটে তাদের ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কোনও অজানা বিষয় জানলে অন্য অধ্যাপকদের সামনেই সেই স্বীকৃতি দিতেন। ছাত্রী হিসেবে সুকুমারী ভট্টাচার্য তো এর জন্য লজ্জিত বোধ করার কথাই স্বীকার করেছেন।  জ্ঞানচর্চার চূড়ায় পৌঁছে যাওয়ার পরেও কোনও ভাল বক্তৃতা শুনলে বলতেন, ‘এ সব শুনলে বুঝি কত সামান্য জানি, কত জানবার ছিল।’ বার বার বলতেন রবীন্দ্রনাথের কথা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে শুধু প্রিয় কবি নন, ছিলেন আদর্শ মানুষ। রবীন্দ্রনাথের নায়ক অমিত সুনীতিবাবুর বই নিয়ে শিলং-এ গিয়েছিল। সুনীতিবাবুর মনে হত রবীন্দ্রনাথ যেন এ ভাবেই তাঁকে অমরত্ব দিয়ে গেলেন। তাঁর নিজের সমস্ত কীর্তি ম্লান হয়ে গেলেও বাঙালি যেন শুধু এই রাবীন্দ্রিক রেফারেন্সের জন্যই তাঁকে ভুলতে পারবে না।
বাঙালি ভুলতে পারবে না! বাঙালির বিস্মৃতি-ব্যাকটেরিয়া অত কমজোর নয়। এক বিশ্ববিখ্যাত ভাষাবিদকে তাঁর জন্মের ১২৫তম বর্ষে মনে রাখবার জরুরত কোথায়? তিনি তো আর আম-বাঙালিকে প্রচলিত অর্থে বিনোদন বিলি করেননি। কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি নিশ্চয়ই মনে রেখেছে! — এই বিশ্বাসের ওপর দিয়ে বুলডোজার চলে গেল যখন ‘সুনীতিকুমার কে ছিলেন, জানেন?’ প্রশ্নের উত্তরে স্কুল-শিক্ষক থেকে সরকারি অফিসার, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার থেকে কলেজের অধ্যাপকদেরও একটা বড় অংশ ঘাড়টা দু’দিকে নাড়লেন। শুধুমাত্র ভাষা নিয়ে চর্চা করা ছাত্র, গবেষক এবং অধ্যাপকরা তাঁকে মনে রেখেছে। মনে রাখা মানে তো শুধু স্মরণ। আর মূল্যায়ন? মানে, কী ভাবে মনে রেখেছে? নিঃসন্দেহে অধিকাংশের কাছেই তিনি এখনও অপরিহার্য। তাঁর ওডিবিএল এখনও অনতিক্রম্য। তবুও তাঁকে ভুলিয়ে দেওয়ার, তিলে তিলে বাতিলের তালিকায় পাঠিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত বহু দিন ধরেই শুরু হয়েছে। সেই রবীন্দ্রনাথ-সুনীতিকুমার প্রমুখের দ্বীপময় ভারত ভ্রমণ এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে বৃহত্তর প্রাচ্য সংস্কৃতি গড়ে তোলার সুমহান স্বপ্নেও বামপন্থীদের কেউ কেউ নাকি সাম্রাজ্যবাদের (মার্কিন নয়) গন্ধ পেয়েছিলেন। শুধুমাত্র মার্কিন ভাষাতত্ত্ব চর্চা করেননি বলেই সুনীতিবাবুর ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের পর্বতপ্রমাণ কীর্তিকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ভাবে হেয় করতে আসরে নেমেছিলেন আমেরিকার চার্লস ফার্গুসন থেকে ভারতের প্রবোধ পণ্ডিত। এই সময়ের খ্যাতনামা ভাষাতাত্ত্বিক প্রবাল দাশগুপ্তের লেখা পড়ে জানা যায়, সাক্ষাৎ বাক্যালাপে সুনীতিকুমারের সামনে যুক্তিতে দাঁড়াতেই পারেননি প্রবোধ।
আর এই প্রবোধ পণ্ডিতের স্নেহধন্য তথা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ শ্রীবাস্তব তো সুনীতিকুমার মারা যাওয়ার পর তাঁর শতবর্ষের স্মরণ-অনুষ্ঠানেই বলে দিলেন যে, সুনীতিকুমারকে বড়জোর সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া চলে। ভাষাতত্ত্বের কোনও ধারাতেই নাকি তিনি তেমন রেখাপাত করতে পারেননি।
এ তো গেল অবাঙালিদের অবমূল্যায়ন। আর বাঙালিরা! অবশ্যই এক ধাপ এগিয়ে। ১৯৭৭। সুনীতিবাবু মারা যাওয়ার পরেই সাপ্তাহিক ‘অমৃত’তে সেই দিল্লি থেকেই কলম ধরলেন স্বনামধন্য শিশিরকুমার দাশ। সুনীতিকুমারের নাকি কোনও মৌলিকত্ব ছিল না, তিনি আধুনিক ভাষাতত্ত্ব বুঝতেনই না, বিশ শতকের কোনও শ্রেষ্ঠ ভাষাতাত্ত্বিকের সঙ্গে তুলনা করে ভুলেও যেন আমরা ‘আত্মপ্রসাদ’ লাভ না করি। প্রতিভাকে নানা দিকে চালনা করাই নাকি ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর ব্যর্থতার মূল কারণ।
আরও ক’বছর পর, মানে আশির দশকে, বামফ্রন্ট সরকার যখন সাঁওতালি ভাষা-সংস্কৃতি কেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রকল্প শুরু করেছে, তার অন্যতম পুরোধা তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লব্ধপ্রতিষ্ঠ এক অধ্যাপক ‘সুনীতিকুমার কী জানেন?’ গোছের মনোভাব নিয়ে, চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসেন— বাংলা ভাষা সাঁওতালি ভাষা থেকেই উদ্ভূত— তা প্রমাণ করার। বলা বাহুল্য সুনীতিকুমারকে ভুল প্রমাণ করতে পারেননি। সুনীতিবাবুর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানেও এক বিখ্যাত সাহিত্যিক জানান, বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নয়, বাংলা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর অর্থাৎ আদিবাসী ভাষা। সুনীতিবাবু নাকি এই সত্য বোঝেননি বা বুঝেও বলেননি। ভাষাতত্ত্বকে শিকেয় তুলে শুধুমাত্র আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাংলার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে বলার বিপদ যতটা, সেই একই উদ্দেশ্যে বাংলার উৎপত্তি সাঁওতালি থেকে বললেও যে সে বিপদ কমে না, তা আর কে বোঝে?
রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ গ্রন্থে পদার্থবিজ্ঞানী বা জীববিজ্ঞানীর মতোই ভাষাবিজ্ঞানীরও ঘৃণা বা পক্ষপাত থাকা অবাঞ্ছনীয় মনে করেছিলেন। সুনীতিকুমার সত্যসন্ধানী। ভাষার উৎস সন্ধানে অযৌক্তিক ঘৃণা বা জবরদস্তি পক্ষপাত তাঁর ছিল না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ উৎসর্গ করেছিলেন এই সুনীতিকুমারকেই। 
(আনন্দবাজার থেকে)

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সুনীতিকুমার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজদের সদাগরি অফিসের কেরানি। তিনি মতিলাল শীল ফ্রি স্কুল থেকে ১৯০৭ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করে কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯০৯ সালে ৩য় স্থান অধিকার করে এফ.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। অতঃপর প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ১৯১১ সালে ইংরেজিতে সম্মানসহ বি.এ শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করেন।
১৯১৮ সালে সংস্কৃতের শেষ পরীক্ষায় পাস করেন এবং প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি এবং জুবিলি গবেষণা পুরস্কার অর্জন করেন।

কর্মজীবন
কৃতিত্বের সাথে এম.এ ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯১৪ – ১৯১৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় লন্ডনে যান এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধ্বনিবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯২১ সালে ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের বিষয়বস্তু ছিল ‘ইন্দো-আরিয়ান ফিললিজ’। লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে তিনি ধ্বনিতত্ত্ব ও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাতত্ত্ব ছাড়াও প্রাকৃত ভাষা, ফার্সি ভাষা, প্রাচীন আইরিশ ভাষা, পুরনো ইংরেজি ও গোথিক ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। অতঃপর লন্ডন থেকে তিনি প্যারিসে গমন করেন। সেখানে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লাভ ও ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাতত্ত্ব, প্রাচীন সগডিয়ান ও প্রাচীন খোতানী ভাষা, গ্রীক ও লাতিন ভাষার ইতিহাস এবং অস্ট্রো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়াটিক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ সালে দেশে ফিরে আসার পর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক ভারতীয় ভাষাতত্ত্বের ‘খয়রা’ অধ্যাপক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুণরায় কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে দীর্ঘ ৩০ বছর কাজ করার পর ১৯৫২ সালে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে পুণঃনিযুক্ত হন।

রচনাসমগ্র
অধ্যাপক তারাপুরওয়ালা’র কাছে আবেস্তা অধ্যয়ন করেন। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ৩ খণ্ডের দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপম্যান্ট অব দ্য বেঙ্গলী ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রন্থখানি রচনা করে অসাধারণ বিদ্যাবত্তার পরিচয় প্রদান করেন।
অন্যান্য রচনাবলী হল – বেঙ্গলী ফোনেটিক রিডার, কিরাত জনকৃতি, ভারত-সংস্কৃতি, বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, পশ্চিমের যাত্রী, ইউরোপ ভ্রমণ, জাতি সংস্কৃতি সাহিত্য, ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা, সংস্কৃতি কী, দ্বীপময় ভারত, রবীন্দ্র সঙ্গমে, শ্যামদেশ ইত্যাদি।

রবীন্দ্র সান্নিধ্য
১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারজন ভ্রমণসঙ্গীর একজন হয়ে সুনীতিকুমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে যান। এই সময় তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। “যাত্রী” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ এই ভ্রমণের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। এসব দেশে তিনি রবীন্দ্রনাথের আদর্শ এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও শিল্প সম্বন্ধে বক্তৃতা প্রদান করেন।
………………………………………..