হিন্দু সমাজের বিদ্যমান বহুল আলোচিত বর্ণভেদ তথা শ্রেণী বৈষম্য।!!!

(হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ নয়, আছে শাস্ত্রবিধি মোতাবেক বর্ণাশ্রম বা শ্রেনী বিন্যাস ব্যবস্হা। একই সাথে আছে শ্রেণী বৈষম্য, যা পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যায়। শ্রেণী বিন্যাসহীন সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। তবে শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ গঠন সম্ভব।)
আমাদের সমাজে বর্ণবাদ, বর্ণপ্রথা বা কৌলিণ্য প্রথা তথা জাত-পাতের ঝামেলা এক সময় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। সামাজিক বিবর্তণের ফলে এর প্রভাব একটু কমেছে বটৈ কিন্তু এখনো জাত-পাতের ঝামেলা হিন্দু সমাজে বহাল আছে। তবে বর্তমানে চরম কৌলিণ্য প্রথা এখন নেই বললেই চলে। চরম কৌলিণ্য প্রথা মানে উচ্চ বংশীয় মান মর্যাদা। চরম কৌলিণ্য প্রথার সময় বিদ্যাহীন, বিত্তহীন হয়েও কোন মানুষ কিংবা পরিবার শুধুমাত্র উচ্চ কৌলিণ বংশীয় মর্যাদায় সমাজের উচ্চাশনে বসে প্রভাব খাটাতে পারতেন। সামাজিক বিবর্তনের সুবাদে বর্তমান সমাজে সে সুযোগ নেই। তবে আমাদের সমাজে বর্তমান বর্ণভেদ প্রথার যে রুপটি এখন দেখা যায়, এটি মূলতঃ অর্থনৈতিক অসাম্যতা নির্ভর একটি প্রথা, যা মোটেই উচ্চ বংশীয় কৌলিণ নির্ভর নয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় পারিবারিক বৈবাহিক সম্বন্ধ স্হাপনের ক্ষেত্রে পাত্রীপক্ষ পাত্রপক্ষের বিশেষ করে পাত্রের আর্থিক অবস্হা ও বিবাহ পরবর্তী পাত্রীর ভবিষ্যত সম্ভাবনার বিষয়টি খতিয়ে দেখে। যে ছেলেটির বিবাহ দেয়া হবে ঐপারিবারের আগের অবস্হা কি ছিল সেটিতো চিন্তায় আনেই না, বরং ছেলেটির পরিবারে ঘনিষ্ট অন্য সব সদস্য/সদস্যার সামাজিক ও আর্থিক অবস্হান কী সেটাও বিবেচনার ক্ষেত্রে গৌণ। এতো গেল পারিবারিক ভাবে বিবাহ সংগঠনের ক্ষেত্রে। ছেলে ও পেয়ের পছন্দের বিবাহ অর্থাৎ লাভ ম্যারেজের ক্ষেত্রেও কিছু ব্যতীক্রম ব্যতীত যে কোন মেয়েই আর্থিক সামর্থ্য ও সম্ভাবনাহীন ছেলের প্রস্তাবে রাজী হন না। এ ব্যাপারে আজকের প্রণয়প্রার্থী যুবক/যুবতীরাই ভাল বলতে পারবেন।
সনাতন ধর্মের এই তথা জাত-পাতের ঝামেলা /প্রথা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে এটিতে ধর্মাবরন থাকলেও প্রাগৈতিহাসিক কাল হতে পুরোপুরি আর্থিক নির্ভর একথা অনেকই পরোক্ষ ভাবে মানতে বাধ্য। এজন্যে স্বামীজি বিবেকানন্দ /শ্রী রামকৃষ্ণ (সঠিক মনে পড়ছে না) বলেছেন “জাত ডুকেছে ভাতের হাঁড়ির ভিতর” । সনাতন ধর্ম এই প্রথা নিয়ে কি বলে সেটা না দেখে অনেকেই ধর্মকেই আক্রমন করে বসেন। আমি ধর্ম নিয়ে বেশি কিছু বলবো না- শুধু বলবো শাস্ত্রে বর্ণিত এই প্রথার বিকৃত রূপই সমাজে প্রচলিত ছিল এবং আছে।
জাত-পাত আর কৌলিন্যে সমস্যাঃ
জাত-পাতের জামেলা আমাদের ধারাবাহিক অজ্ঞতার ফসল। বামুন-কায়েত-মাহিষ্য-কৈবর্ত্ত্য-মুচি-হাঁড়ি-ডোম-চন্ডাল-নাপিত-সদগোপ-অসদগোপ-কলু-তেলি ইত্যাদি ইত্যাদি সব বিভেদের মূলে হলো শিক্ষা আর অর্থনৈতিক স্বক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। একটু ভেবে দেখুন, নিজের কায়িক শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য কাপড় কাছলে বলে ধোঁপা। আর একই উদ্দ্যেশে অটোমেটিক প্ল্যান্ট বসিয়ে বড় পরিসরে কাজ করালে হয় কারখানার মালিক। দিনে এনে দিনে খাওয়া চুল দাঁড়ি কাঁটার লোকটিকে তাচ্ছিলের ভাষায় বলা হল নাপিত, আর তার দোকানটিকে বলা হয় নাপিতের দোকান। কিন্তু হোটলে সোনার গাঁ, রেডিসন ওয়াটার গার্ডেনের দোকান গুলিকে বলা হয় পারলার সপ, কর্মীদের বলা হয় হেয়ার এক্সপার্ট/টেকনিশিয়ান/ড্রেসারার। একই ভাবে যারা কায়িক পরিশ্রম সরিষা ভাঙ্গিয়ে তেল তৈরী করতো তাদেরকে এবং উত্তরসূরীদের বলা হয় কলু, কিন্তু বড় পরিসরে বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈল উৎপাদনকারীকে বলা মিল মালিক-ব্যবসায়ী।
জীবন ও জীবিকার তাগিদে পেশা সৃষ্টি হয় এবং যে সকল মানুষ এর সাথে জড়িয়ে পড়ে তাদের নামের শেষে পেশা ভিত্তিক পদবীর তকমা লাগিয়ে যায়। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি একটি বিষয় সুস্পষ্ঠ হয়েছে যে, যে কোন পেশায় কম কায়িক শ্রম করে ও বুদ্ধি/জ্ঞান খাটিয়ে অধিক উপার্জন করাটা সম্মানের হয়েছে। অন্য দিকে অধিক কায়িক শ্রম করে অল্প উপার্জনকারী ও কোনমতে দিনাতিপাত করা মানুষ সমাজে অবজ্ঞার শিকার হয়েছে।
সুতরাং জাত-পাত সমস্যাটা শুধু পেশা ভিত্তিক নয়। বরং বলা যায় পেশা ভিত্তিক অর্থ উপার্জনের বৈষম্যের উপর নির্ভরশীল। একই সাথে মনস্ত্বাত্বিক বৈষম্যতো আছেই। আর এটা দূর করা যায় প্রকৃত শিক্ষার আলো দিয়ে। কেননা শাস্ত্র বলে “বিদ্যা ধদ্ধাত্বি বিনয়” – যা আমাদের আর্য ঋষিগনের বাণী। সুতরাং প্রকৃত শিক্ষা আর পেশার সাথে প্রযুক্তি ও মননশীলতার মিশ্রণ কমাতে পারে জাত-পাতের ঝমেলা।
সনাতন ধর্মে শাস্ত্র বর্ণিত যে বর্ণাশ্রম এসেছে তা হলো গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে যা গীতায় বলা হয়েছে। কর্ম ও গুণে সমাজে যে শ্রেণীবিভাগ আছে, এটি ছিল, বর্তমান সমাজেও আছে, ঈশ্বরের সৃষ্টি যতদিন আছে ততদিনই থাকবে। সমাজে রয়েছে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক প্রভৃতি শ্রেণীর লোক। আর এই শ্রেণীবিভাগটা গুণ ও কর্মের অনুসারেই হয়েছে। গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে গীতায় বর্ণভেদের কথা বলা হলে ত্ত পেশা ভিত্তিক বর্ণ বৈষম্যের কথা বলা হয়নি। এমন কোন মানব সমাজ হতে পারে না বা পারবে না যেখানে শ্রেণী বিন্যাস থাকবে না। আমরা কি বলতে পারবো বর্ণপ্রথাকে গালি দেওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের মাঝে শ্রেণী নেই? আমরা কি বলতে পারবো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেণী নেই? রাজতন্ত্রের কথা নাই বা বললাম- সেখানে তো শ্রেণী স্বীকার্য হয়ে আছে। কিন্তু শ্রেণী বিন্যাসের সাথে আমাদের আমরা যোগ করলাম শ্রেণী বৈষম্য, যা পুরোপুরি অর্থ ও সামর্থ্য নির্ভর এবং এটি সমাজের বিশেষতঃ হিন্দু সমাজের অগ্রগতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে সামর্থ্য নির্ভর শ্রেণী বৈষম্য। এগুলো তো দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই- আপনার আমার চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে। আপনি- আমিই বৈষম্যগুলো করে যাচ্ছি বা এর শিকার হচ্ছি ( যদিও পণ্ডিতদের আলোচনায় দোষ শুধু সনাতন ধর্মের)।
প্রচলিত বৈষম্যহীন সমাজ গঠন করা যাবে- যদি মানুষ তার মানসিকতা পরিবর্তন করে। কিন্তু শ্রেণীহীন করা সম্ভব নয়, কখনই সম্ভব নয়। কাউকে না কাউকে তো শিক্ষার ভার নিতে হবে। কাউকে না কাউকে তো চিকিৎসক হতে হবে। কাউকে না কাউকে তো আবর্জনা পরিস্কার করতে হবে। কাউকে না কাউকে হতে হবে রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী। কাউকে হতে হবে সৈনিক। কাউকে হতে হবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী। তাহলে কি হলো? শ্রেণী তো রয়ে গেল। তবে এরা যাতে কেউ কাউকে ঈর্ষা না করে, এদের মধ্যে কেউ যাতে কারও অধিকার না হরণ করে- এইসব ব্যাপার গুলো সমাজে নিশ্চিত করা যেতে পারে যা গড়ে তুলবে বৈষম্যহীন সমাজ।
হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ নয়, আছে শাস্ত্রবিধি মোতাবেক বর্ণাশ্রম বা শ্রেনী বিন্যাস আছে। একই সাথে আছে শ্রেণী বৈষম্য প্রথা, যা পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যায়। শ্রেণী বিন্যাষহীন সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। তবে শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ গঠন সম্ভব। কেউ যদি জোর বলে- আমরা শ্রেণীহীন সমাজ বির্ণিমান করব, তবে তাকে বোকা, মূর্খ, অজ্ঞানী-অন্ধ আর কেউ হবেন কিনা আমার জানা নেই।কারণ তিনি শুধু বলতে পারে আমরা বৈষম্যহীন সমাজ গঠন করব, এর বাইরে সে যেতে পারবে না। স্বয়ং ভগবানও তা করতে পারবেন না, কারণ ‘স্রষ্টার আর সৃষ্টির’-শুরু থেকেই শ্রেণী বিভাগ হয়ে গেছে।
বহুল সমালোচিত জাতপাতের প্রথা ভাঙ্গলে কী হবে?
হিন্দু সমাজে প্রচলিত বর্ণ তথা জাতপাত বা বৈষম্য মূলত একটি প্রথা মাত্র। এটি বেদ কিংবা অন্যান্য ধর্মাশাস্ত্রানুযায়ী বিধান নয়। এখানে বলে রাখা ভাল, আইনের ভাষায় প্রথা আইন বা বিধি নয়, এটি কেহ সৃষ্টি করে না নানা পরিবেশগত কারণে এমনিতে সৃষ্টি হয়ে, সমাজে গ্রহনযোগ্যতা পায়, আবার বিলুপ্তও হয়। প্রথা ভাঙ্গলে ভঙ্গকারীকে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়া হয় না। কেননা এটি বিধিবদ্ধ আইন নয়। তবে যে সমাজের যে প্রথা প্রচালিত, তা ভঙ্গ করলে সমাজের প্রথা ভঙ্গকারীর চারপাশের মানুষ গুলো ক্ষনকালের জন্য ধিক্কার দেয় মাত্র।
উপসংহারঃ
ভগবান সমাজের মানুষের শ্রেণী বিন্যাস করেছেন, এমনকি প্রকৃতিতেও শ্রেণী বিন্যাস করেছেন। এসব শ্রেণী বিন্যাস সৃষ্টি রক্ষার স্বার্থে হয়তো করা হয়েছে। হতে পারে সনাতনী ধারণা জীবের জন্মান্তর কর্ম ফল বাদের জন্য। কিন্তু তিনি শ্রেণী বৈষম্য করেননি। একটু লক্ষ্য করলে বুঝা যায় এক এক শ্রেণী গুণ ও কর্ম ভেদে এক এক দিয়ে সমৃদ্ধ। কিন্তু মানুষ এটিকে পূঁজি করে যা করেছে, তা হল বৈষম্য। আর এই শ্রেণী বৈষম্যটাই প্রথাই হলো সভ্যতার কাল। আমরা ইচ্ছে করলেও গুণ ও কর্ম ভেদে শ্রেণী বিন্যাস মুছাতে পারব না, কিন্তু আমরা সকলে যদি একটু সচেতন হই, তাহলে আমাদের সৃষ্ট শ্রেণী বৈষম্য কমাতে পারি প্রকৃত শিক্ষার আলো দিয়ে। …অরুন চন্দ্র মজুমদার