বেদ এ গরু মহিষের মাংস !
মুসলমানদের বহুল অপপ্রচারের একটি হলো বেদ এ গরুর মাংস খাওয়ার কথা বলা আছে। এজন্য তারা কিছু রেফারেন্স দেয়, কিন্তু যেহেতু হিন্দু সমাজে বেদ তেমন সহজলভ্য বা প্রচলিত নয়, তাই ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ হিন্দুরা এ সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে পারে না। এই পোস্টে আমি শুধু দুটি রেফারেন্স এর জবার দেবো; কারণ, প্রতিটা রেফারেন্স এর জন্য একটি করে ফটো যুক্ত করতে হবে, যাতে বেদ এর মূল শ্লোকে আসলে কী বলা আছে, তা বোঝা যায়। এজন্য এক সঙ্গে অনেকগুলো রেফারেন্স এর জবাব দিতে গেলে তা ওভারলোড হয়ে যাবে। আমি সাধারণ একটি পোস্টে একটি বিষয়ের আলোচনা করি, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে বেদ এ গরু বা অন্যান্য পশুর মাংস সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে অনেকগুলো পর্বে বিভক্ত করতে বাধ্য হলাম।
মুসলমানদের অনেকগুলো রেফারেন্স এর মধ্যে দুটি হলো বেদ এর ১/১৬৪/৪৩ এ গরুর মাংসএবং ৫/২৯/৮ এ মহিষের মাংসখাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আমি যে কমেন্ট থেকে এই রেফারেন্সটি নিয়েছি, তার আসল রূপ হলো,
“হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে গরুর মাংস খাওয়ার প্রমান _______________ ______________________ হিন্দুদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থগুলি বলছে, ”বৃষের মাংশ [বেদ:১/১৬৪/৪৩], মহিষের মাংস [বেদ:৫/২৯/৮], অজের মাংস [বেদ:১/১৬২/৩] খাওয়া হতো।- আরও বলা হয়েছে পরস্বিনী গাভী মানুষের ভজনীয় [ বেদ:৪/১/৬]।- গো হত্যা স্থানে গাভীগণ হত্যা হতো [বেদ:১০/৮৯/১৪]। ইন্দ্রের জন্য গোবৎস উৎসর্গ করা হয়েছে। [ঋকবেদ:১০:৮৬:১৪]।”
খেয়াল করুন, সব ক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে [বেদ:১/১৬৪/৪৩], এই ভাবে। যে এই কমেন্টটা লিখেছে সে হয়তো জানেই না যে, বেদ চারটি; তাই রেফারেন্স বেদ এর নাম উল্লেখ করতে পারে নি। আর পারবেই বা কিভাবে, বেদ কি কখনো চোখে দেখেছে ? জাকির নায়েক এর কোনো বক্তৃতার বই থেকে এটা কপি করে তুলে দিয়েছে, সেখানে যা লিখা ছিলো তাই দিয়েছে, ফলে যা হবার তাই হয়েছে, কোনো রেফারেন্স দিতে হলেও যে সঠিক রূপে দিতে হয়, এই মূর্খরা কি সেটাও জানে ?
যা হোক, রেফারেন্স নিয়ে পোস্টমর্টেম শুরু করি। রেফারেন্সে এটা কোন বেদ থেকে নেওয়া, সেটা উল্লেখ না করলেও, এই রেফারেন্সটা খুঁজে পেলাম ঋগ্বেদে, শ্লোকটি হলো-
শকময়ং ধূমমারাদপশ্যং বিষূবতা পর এনাবরেণ।
উক্ষাণং পশ্মিমপচন্ত বীরাস্তানি ধর্মাণি প্রথমান্যাসন্।। (ঋগ্বেদ, ১/১৬৪/৪৩)
এই রেফারেন্স এর মানে হলো ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৬৪ নং সূক্তের ৪৩ নং ঋক বা শ্লোক।
এই শ্লোকের অর্থ হিসেবে- কোলকাতার হরফ প্রকাশনী, যার মালিক একজন মুসলিম, সেই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বেদ এ বলা হয়েছে,
“আমি নাতিদূরে শুষ্ক গোময়সম্ভূত ধূম দেখলাম। চতুর্দিকে ব্যাপ্ত নিকৃষ্ট ধূমের পর অগ্নিকে দেখলাম। বীরগণ শুক্লবর্ণ বৃষকে পাক করছেন, তাদের এ অনুষ্ঠানই প্রথম।”
সরল মনে এটা পড়ার পর মনে হবে, ঠিকই তো আছে, “বীরগণ শুক্লবর্ণ বৃষকে পাক করছেন” এর মানে হলো বীরগন, বৃষ বা গরুর মাংস যখন পাক বা রান্না করছে, তখন তো তা খাওয়ার জন্যই করছে, সুতরাং বেদ এ গরুর মাংস খাওয়ার কথা তো বলাই আছে।
কিন্তু এটা নদীর উপরের জল, তার মানে এই নয় যে নদীর তলা পর্যন্ত এইরকম জলই আছে। নদীর তলায় কী আছে, সেটা একটু পরেই বুঝতে পারবেন।
কোলকাতা থেকে বেদ প্রকাশ করেছে একজন মুসলমান প্রকাশক, ভারতে আগমনের পর থেকে যে মুসলমানদের ধ্যান জ্ঞানই হলো হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা, এখন বেদ প্রকাশের উদ্দেশ্যটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন; তবু এই মুসলমান প্রকাশককে ধন্যবাদ এই জন্য যে, তার এই উদ্যোগের ফলে, বিকৃতভাবে হলেও, কিছু হিন্দু বেদ এর সংস্পর্শে আসতে পেরেছে বা পারছে। কোলকাতায় অনেক হিন্দু প্রকাশক আছে, কিন্তু তাদের কাছে ব্যবসা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, আমার তো মনে হয়, উপযুক্ত মূল্য পেলে এরা নিজের মা বোন বউকে নিয়েও ব্যবসা করবে; কারণ এদের কাছে ধর্ম সমাজ গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা, টাকা! এদেরকে শায়েস্তা করার জন্য অবশ্য মুসলমান নামক একটি লুটেরা জাতির উৎপত্তি পারিপার্শ্বিক দিক থেকে একদম ঠিক; কারণ, এরা সমাজ ধর্ম ভুলে যে টাকা কামাই করে বা করবে, সেই টাকাকে লুট করে অতীতে (১৯৪৬) নিয়ে গেছে এবং আবার যাবে মুসলমানরা, বোনাস হিসেবে খাবে মার, দেবে জান; যেমন কর্ম, একদম তেমন ফল।
যা হোক, হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ঋগ্বেদ এর অনুবাদক হিসেবে যদিও তারা রমেশচন্দ্র দত্তের নামকে ব্যবহার করেছে, তবু অসৎ উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য দু একটি শ্লোকের অর্থ পাল্টিয়ে দেওয়া এমন কিছু কঠিন নয়, আবার এ নিয়ে অনুবাদকের সাথে আপোষ করাও কঠিন নয়; কারণ, পশ্চিম বঙ্গের কিছু কিছু হিন্দু টাকার জন্য সব করতে পারে, টাকার জন্য এরা নিজের মা বোন মেয়ের ধর্ষকের সাথেও আপোষ করে। (মমতার আগের টার্মে এরকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিলো, যেখানে ধর্ষক তৃণমূলের হওয়ায় ধর্ষিতার পরিবারকে চাকরি দিয়ে ম্যানেজ করা হয়েছিলো।)
যা হোক, ফিরে যাই শ্লোকের ব্যাখ্যায়, এই শ্লোকের ব্যাখ্যা হিসেবে অগ্নিবীর থেকে প্রকাশিত বেদ এর ইংরেজি ভার্সন, যার একটি স্ন্যাপশট ফটো আকারে এই পোস্টের সাথে যুক্ত করে দিয়েছি, তাতে বলা হয়েছে,
“I have seen from close quarters the clouds of smoke and vapour laden with power. From this close by, I perceive the powerful catalytic agents of nature far off busy heating and creating the clouds of soma replete with vitality. These processes are the firstoperations of natural evolution and behaviour higher up in space.
(আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি, শক্তিসম্পন্ন ধোঁয়ার মেঘ এবং বাষ্প। আরও কাছে থেকে আমি বুঝতে পারলাম প্রকৃতির শক্তিশালী অনুঘটক, জীবনী শক্তিতে পূর্ণ হয়ে তাপ দিতে এবং মেঘ সৃষ্টি করতে ব্যস্ত। এই পদ্ধতিটা প্রাকৃতিক ক্রিয়া কলাপের প্রথম স্তর এবং মহাশূন্যের উচ্চ স্তরের আচরণ।)
এখানে সূর্যের তাপে জলের বাষ্প হয়ে ধোঁয়ার আকারে মেঘের আকার ধারণ এবং এটা যে বৃষ্টিচক্রের প্রথম ধাপ, সে ব্যাপারে বলা হয়েছে।
কিন্তু কোলকাতার হরফ প্রকাশনীর বেদ এ বলা হয়েছে, “আমি নাতিদূরে শুষ্ক গোময়সম্ভূত ধূম দেখলাম।”
ধুলাময় বলে একটা কথা প্রচলিত আছে, এর মানে হচ্ছে ধুলা দিয় ভরা। তাহলে উপরের বাক্যে গোময় দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে ? গো মানে তো গরু, তাহলে গোময় মানে কি গরুময় ? গরুময় যদি হয়, তা থেকে ধূম উঠবে কিভাবে ? মূল সংস্কৃত শ্লোকে ধূম এর একটি ব্যাপার আছে, কিন্তু সেখানে অগ্নির কোনো ব্যাপার নেই। অথচ হরফ এর বেদ বলছে, “চতুর্দিকে ব্যাপ্ত নিকৃষ্ট ধূমের পর অগ্নিকে দেখলাম।”
এরপর হরফের বেদ বলছে,
“বীরগণ শুক্লবর্ণ বৃষকে পাক করছেন, তাদের এ অনুষ্ঠানই প্রথম।”
কিন্তু মূল শ্লোকে খেয়াল করুন, বৃষ বা ষাঁড়ের কোনো কথার উল্লেখই নাই। আবার খেয়াল করুন, এই বাক্যে ‘পাক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, রান্না করা অর্থে পাক শব্দটি ব্যবহার করে বাঙ্গালি মুসলমানরা, বাঙ্গালি হিন্দুরা নয়। এই বাক্যে “পাক” শব্দের ব্যবহারই প্রমান করে যে, এটি একটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনগড়া মুসলিম অনুবাদ। এই শ্লোকের কথাগুলো কেউ একজন দেখে বর্ণনা করছে, তাহলে সে কিভাবে বলে যে, “বীরগণ শুক্লবর্ণ বৃষকে পাক করছেন ?” হয় সে শুক্লবর্ণ বৃষকে দেখবে, না হয় বৃষের মাংস রান্না করা দেখবে। যে এটা বর্ণনা করেছে, সে কি সারাদিন ধরে ওখানে দাঁড়িয়েছিলো ?
তারপর আবার বলা হয়েছে, “তাদের এ অনুষ্ঠানই প্রথম।” এটা প্রথম অনুষ্ঠান হতে যাবে কেনো ? গরুর মাংস যদি তারা খায় ই, তাহলে তা তারা রেগুলার খাবে না কেনো ?
পৃথিবীর সকল মানুষই শুরুতে মাংসভোজী ছিলো, পরবর্তীতে ক্ষতিকারক বিবেচনা করে কোনো কোনো জাতি কোনো কোনো মাংসকে ত্যাগ করেছে, তাহলে বেদ এর যুগে প্রথম মাংস খাওয়ার উৎসব হয় কিভাবে ?
এই পুরো বিষয়টি মাথায় রাখুন, আর ইংরেজি অনুবাদ এবং তার বাংলা অনুবাদটি বোঝার চেষ্টা করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন বেদকে কিভাবে বিকৃত করে, তার মধ্যে গরুর মাংসকে ঢোকানো হয়েছে।
এরপর আসি, মহিষের মাংসের [বেদ:৫/২৯/৮] এই রেফারেন্সে; মূল সংস্কৃত শ্লোকটি হলো-
“ত্রী যচ্ছতা মহিষানামঘো মাস্ত্রী সরাংসি মঘবা সোম্যাপাঃ।
কারং ন বিশ্বে অহ্বন্ত দেবা ভরমিন্দ্রায় যগহিং জঘান।।”
এর অনুবাদ হিসেবে হরফের বেদ এ লিখা আছে,
“হে ইন্দ্র, যখন তুমি তিনশত মহিষের মাংস ভক্ষণ করেছিলে, যখন ঐশ্বর্যসম্পন্ন তিন পাত্র সোমরস পান করেছিলে, তখন তিনি বৃত্ত সংহার করছিলেন, তখন সমস্ত দেবতা সোমপানকারী ইন্দ্রকে ভৃত্যবত যুদ্ধস্থলে আহ্বান করেছিলেন।”
এই অনুবাদের অসামঞ্জস্যটা খেয়াল করুন, ইন্দ্র নাকি ৩০০ মহিষের মাংস ভক্ষণ করেছে ! তিনি আবার নাকি মাত্র ৩ পাত্র সোমরস পান করেছে ! এখানে আবার বলা হয়েছে, “তখন তিনি বৃত্ত সংহার করছিলেন,” এই তিনিটা কে ? সেই সময় আবার সমস্ত দেবতা নাকি সোমপানকারী ইন্দ্রকে চাকরের মতো যুদ্ধস্থলে আহবান করেছিলো!
এই অনুবাদকারী হয়তো ভুলে গেছে যে, ইন্দ্র দেবতাদের রাজা, তার সাথে চাকরের মতো ব্যবহার কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়, আর তাকে যুদ্ধেও আহ্বান করা সম্ভব নয়। ইন্দ্রের সাথে একবার কৃষ্ণের যুদ্ধ হয়েছিলো গোবর্ধন পর্বত নিয়ে, সেটা মহাভারতের যুগে, বেদ এর যুগে নয়।
যা হোক, এই শ্লোকের অনুবাদ সম্পর্কে অগ্নিবীর কর্তৃক প্রকাশিত বেদ কী বলছে দেখুন,
“Indra, inviolable lord, commanding honour,
power and excellence, when you ripen and mature three
hundred great fields and forests and create and protect
three great lakes of soma, all the divinities of the world
invoke Indra like a great hero and offer homage since
he breaks the cloud of serpentine hoards of showers.”
(ইন্দ্র- শক্তি, শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রভুত্বের সম্মানে অনতিক্রমনীয় দেবতা, যখন আপনি পরিণত করলেন এবং পাকালেন তিনশত বড় বড় মাঠের (শস্য) এবং রক্ষা ও সৃষ্টি করলেন বন এবং তিনটি বড় হ্রদ, তখন সব দেবতা আপনাকে সম্মানিত করলেন একজন মহান বীর হিসেবে, যেহেতু আপনি মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টিপাত বর্ষণ করিয়েছেন।)
এই শ্লোকের মূল কথা হলো ইন্দ্রের দ্বারা বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে ফসল উৎপন্ন এবং বন ও হ্রদ রক্ষা। কিন্তু মুল শ্লোকের মধ্যে শুধু মাত্র ‘মহিষানামঘো’ একটি শব্দ দেখেই এটাকে মহিষের মাংস খাওয়া্র শ্লোক বানিয়ে দিয়েছে!
এই ভাবে বাংলায় প্রকাশিত হিন্দুধর্মের সকল গ্রন্থ কোনো না কোনোভাবে বিকৃত, তাই ধর্মগ্রন্থে লিখা থাকলেই যে তা সত্য, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। একটা কথা মনে রাখবেন, হিন্দু ধর্মের কোথাও কোনো কালিমা নেই, যেখানেই দেখবেন যে, কোনো গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে কেউ হিন্দুধর্মের গায়ে কালি লাগানোর চেষ্টা করছে, বুঝে নেবেন, সেখানেই কোনো না কোনো বিকৃতি আছে বা আছে কোনো মিথ্যা, যার প্রকৃত রহস্য হয়তো আপনি জানেন না।
লেখকঃ শ্রী উত্তম কুমার দাস।