আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত নতুন বন্ধুরা, বিশেষত যারা বয়েসে তরুণ, তাদের কাছ থেকে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি আসছে- ইসলাম যখন আরবে আসল তখন সেটা ছিলো সবচেয়ে আধুনিক একটা মতবাদ, আরবে চরম অন্ধকাচ্ছন্ন একটা যুগ অতিবাহিত হচ্ছি তখন ইসলামের আগমণ ঘটেছে… ইত্যাদি। আপনাদের এরকম ধারণা এসেছে অতি কথিত একটি মিথ্যা কথার সত্য হয়ে উঠার জন্য। বহু লিবারাল, বামপন্থিরা ধর্ম বিশ্বাস না করেও ইসলামের এই প্রশংসাটা করে ফেলেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হচ্ছে আইয়ামে জাহেলিয়া। অর্থ্যাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ। ইসলাম এই তকমাটা দিয়েছে তার আগমনের পূর্বের সময়কে। ইসলামের বিভিন্ন সোর্স থেকেই এখন দেখাবো ইসলামের আগে আরব ছিলো শিক্ষিত ও লিবারাল একটা সমাজ।
>>১৪০০ বছর আগে আরবের লোকজনের ভ্রুণ, মানুষের জন্ম রহস্য, মহাকাশ বিদ্যা, সূর্য, চাঁদ, পৃথিবী সম্পর্কে তখনকার বৈজ্ঞানিক ধারণা সম্পর্কে জ্ঞান ছিলো।
>>চিকিৎসা বিজ্ঞানের গেলেনে লিখিত ২৬টি বই আরবীতে অনুবাদ হয়েছিলো যা আরবের লোকজন অধ্যায়ন করে ডাক্তার হতেন।
>>এরকম একজন ডাক্তার ছিলো হযরত মুহাম্মদের চাচাতো ভাই হারিস ইবন কালাদা। উনার চিকিৎসাবিদ্যা এতই সুখ্যাতি হয়েছিল যে পারস্য সম্রাট খসরু তাকে রাজ দরবারে ডেকে নিয়ে যান। হারিস কোনদিন ইসলাম গ্রহণ করেননি এবং ইসলাম অবমাননার কারণে তাকে মক্কা দখলের পর হত্যা করা হয়। হারিস সম্পর্কে জানা যাবে সীরাত ইবনে হিশাম থেকে।
>> এরিস্টটল, ভারতীয় চিকিৎসাবিদ চরক, গেলেন, হিপোক্রেটাস এরা সকলে খ্রিস্টের জন্মের তিন-চা্রশো বছর আগে জন্ম নিয়েছিলেন। চাঁদ, পৃথিবী, গ্রহ-নক্ষত্র, মানব ভ্রুণ সম্পর্কে তাদের তখনকার ধারণা সবটাই কুরআনে আছে। বলাই বাহুল্য আধুনিক বিজ্ঞান এই ধারণাগুলির বেশির ভাগই এখন বাতিল করে দিয়েছে। কাজেই ১৪০০ বছর আগে আরবকে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলা যাবে কি?
>>আরবে ইসলাম আসার পূর্বে নারী ছিলো পুরুষের মত সমান অধিকার প্রাপ্ত মানুষ। হযরত মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি সিরিয়া থেকে মালপত্র কিনে আনতেন। এজন্য তাকে পুরুষ কর্মচারীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক রাখতে হতো। তিনি নিজে পছন্দ করে হযরত মুহাম্মদকে বিয়ে করেছিলেন।
>>কুরাইশদের মধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন যারা কুরাইশদের নেতৃত্ব দিতেন। এদের অন্যতম আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ। এই মহিলা সমাজে কথা বলতেন প্রভাবশালীর মত। আবু সুফিয়ানের সঙ্গে ডিভোর্স হবার পর তিনি একা স্বাধীন জীবনযাপন করেছিলেন। এতে প্রমাণ হয় তখনকার নারীদের কতখানি স্বাধীনতা ছিলো।
>> ইসলামের আগের সমাজ ছিলো সেক্যুলারপন্থি। মক্কা ও মদিনাতে প্রচুর ইহুদী খ্রিস্টানরা পৌত্তলিকদের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে প্রতিবেশির মত বসবাস করেছে। কারোর সঙ্গেই সংঘাত লাগেনি। কেউ ধর্মীয় পরিচয়ে নিজ জন্মস্থান ছাড়েনি। আবিসিনিয়ার খৃষ্টান বাদশা নাজ্জাশীর শাসনাধীন সময়ে সেখানে সব ধর্মের মানুষ মিলে মিশে থাকত। সব ধর্মের সমান অধিবার, সব ধর্মের সমান প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সুযোগ ছিলো। এ কারণে হযরত মুহাম্মদ তার সঙ্গিদের আবিসিনিয়াতে যেতে বলেছিলেন সেখানকার সেক্যুলার রাষ্ট্রের সুযোগ নিতে। সেখানে গিয়ে ইসলাম প্রচার শুরু করা হয় বাদশার ধর্মীয় স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে। পরবর্তীকালে ইসলাম ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে হাত নেয়ার পর মক্কা, মদিনা, আবিসিনিয়া, সিরিয়াতে মুসলিম বাদে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। পৌত্তলিকদের ইসলাম ব্যতিত কোন সুযোগ রাখা হয়নি। আরব ব-দ্বীপ থেকে ইহুদীদের সমূলে উচ্ছেদ করা হয়। শেষ হয়ে যায় আরবের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ইতিহাস। তার বদলে স্থান নেন ‘দারুল ইসলাম’ যার অর্থ ‘মুসলমানদের দেশ’!
কন্যা শিশুদের জন্মের পর মাটিতে পুঁতে মেরে ফেললে আরবে এত এত মানুষের জন্ম হলো কিভাবে? হযরত মুহাম্মদের জন্ম সম্ভব হলো কিভাবে? গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ ছিলো, আবার দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চুক্তিও ছিলো। এসব গোত্র বিদ্রোহ তো ইসলাম দূর করতে পারেনি। বরং ইসলাম সবাইকে মুসলমান পরিচয় দিলেও গোত্র জাত্যাভিমান চিরকাল আরবে রয়ে গিয়েছিলো। এটা মনে রাখতে হবে যারা জয়ি হয় তারাই ইতিহাস লেখে। তারা কখনই নিজেদের বদনাম করে না। উল্টো যারা পরাজিত হয় তাদের সম্পর্কে মিথ্যাচার করে বেড়ায়। উপরের সমস্ত তথ্য ইসলামের নিজের লেখা ইতিহাস থেকে নেয়া। একতরফা ইতিহাসের জাতাকলের এদিক সেদিক থেকে যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকেই ইসলাম পূর্বের আরবের আলোকিত কিছু ছবিই আমরা দেখতে পাই…।