হিন্দু চরিত : উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমানেই চোখে
————————————————————–
উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমান, তাদের ইসলাম গ্রহণ নিয়ে গর্ব করে বলে, ইসলাম তাদের হিন্দুত্বের বর্ণবাদী সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি দিয়েছে । ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত সাচ্চা মুসলমানের চোখে ‘হিন্দু’ শব্দটা উপেক্ষা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য এবং এক ধরণের ঘৃণার । আসল গন্ডগোলটা অন্যত্র । ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামী জনসংখ্যার বৃহতাংশ মাদ্রাসা শিক্ষিত মুসলমান এতটাই উচ্চ শিক্ষিত এবং জ্ঞানী, যে তারা এই উপমহাদেশের ইতিহাসকে নিজেদের আঙ্গিকে পাল্টানোর চেষ্টা করেছে, আর্থ-সামাজিক সত্যগুলোকে নিজেদের মত ব্যাখ্যা করে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার অনবরত চেষ্টা বহুকাল আগে থেকেই করে চলেছে । চলুন পাঠক, আজকে এই উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমানের ‘হিন্দু’ দের নিয়ে একটু কচলাই ।
ভারতের সংবিধানের প্রথম বাক্য বলছে :’India, that is Bharat, will be a Union of States’ । সোজা মানে : যা ইন্ডিয়া, তাই ভারত, যেমন যা ইরান তাই পারস্য বা যা এবিসিনিয়া তাই ইথোপিয়া……..। ভারতীয় সংবিধানের কোথাও ভারতবর্ষের কোনো উল্লেখ নেই, শুধু ভারতই বলা হয়েছে । ১৯৪৭ এর দেশভাগ, ভারতবর্ষ থেকে ভারত আর পাকিস্তান সৃষ্টি দুটো পৃথক ভুখন্ড সৃষ্টি করেছিল । এই বিভাজনকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতেই সেদিন ‘ভারতবর্ষ’ থেকে ‘বর্ষ’ টা কাটা পরেছিলো । পাঠক, সত্য হলো, রাজনৈতিক অর্থে ভারতবর্ষের কোনো অস্তিত্ব নেই, কেবল মাত্র ভৌগোলিক অর্থেই সেটা বেঁচে আছে । একটা সত্য এখানে অস্বীকার করলে চলবেনা । এই ভারতবর্ষ কিন্তু এক অর্থে বিশাল ভাগ্যবান । বিশ্বে সকল দেশের কিন্তু প্রাকৃতিক সীমারেখা নেই যেমনটা ভারতবর্ষের আছে । প্রাকৃতিক সীমারেখা না থাকার ফলে পোল্যান্ডকে অনেক দূর্ভোগ পোয়াতে হয়েছিল । বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষ বলতে হিমালয়ের দক্ষিণে সমুদ্র বেষ্টিত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সমগ্র ভূখণ্ডকেই বোঝায় । উত্তর-পশ্চিমে যার বালুচিস্তান, তার উপরে আফগানিস্তান,ইরান, রাশিয়া । উত্তরে নেপাল, তিব্বত ,পূর্বে মায়ানমার, চীন । বাকি সীমানা সমুদ্র দিয়ে চিহ্নিত । বৃহদাংশ উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত মাদ্রাসাছাপ মুসলমানেরা ভারতবর্ষকে ‘হিন্দুস্তান’ উল্লেখ করে । সংক্ষেপে এই উপমহাদেশকে ‘হিন্দ’ বলা হয়েছে কখনো আর ভারতবর্ষের জয় থেকেই উৎপত্তি হয়েছে ‘জয় হিন্দ’ বিজয় ধ্বনির । বাস্তব সত্য হলো, সাম্প্রতিক অতীত বিংশ শতাব্দীতেই ফারসী ‘হিন্দুস্তান’ রূপান্তরিত হয়েছিল হিন্দি হিন্দুস্তানে এবং এই রূপান্তরের ফলে উপমহাদেশের অধিকাংশ ধর্মান্তরিত মাদ্রাসাছাপ মুসলমানেরা এর অর্থ ব্যাখ্যা করলো যে : ‘হিন্দুস্তান’ মানে হিন্দু ধর্মালম্বীদের দেশ । এই মূর্খের দলের এটা বোধের বাইরে যে, ‘হিন্দুস্তান’ শব্দের সাথে হিন্দু ধর্মের কোনো আবশ্যিক সম্পর্ক নেই । ‘হিন্দুস্তান’ বলতে সংকীর্ণ অর্থে উত্তর ভারতকে বোঝায়, যাকে একসময় ‘আর্যাবত’ বলা হতো । ধর্ম নির্বিশেষে এই অঞ্চলের সকলকেই হিন্দুস্তানী বলা হতো । অষ্টাদশ শতাব্দীতে, পরাক্রান্ত মুঘল রাজাদের পরে কে মসনদে বসবে তার ভার এসে পরেছিল সাঈদ ভাতৃদ্বয় আবদুল্লা খান ও হুসেন আলী খানের উপর । এই দুজনেই নিজেদের সগৌরবে হিন্দুস্তানী পরিচয় দিত, অথচ এরা ইসলাম ধর্মালম্বী ছিল । এই হিন্দুস্তানীদের প্রতিপক্ষরা ছিল ভিনদেশী ‘তুরানী’ গোষ্ঠী, যাদের নেতৃত্ব দিতো চীন-কিলিচ-খান, নিজাম-উল মুল্ক । পরবর্তীতে নরপিশাচ নাদীর শাহের অনুসারীদের বলা হতো দুরানী । পাঠক, এটাই অকাট্য প্রমান যে ‘হিন্দুস্তান’ এর কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য নেই, আছে কেবল ভৌগোলিক তাৎপর্য ।
উপমহাদেশের অধিকাংশ ধর্মান্তরিত মাদ্রাসাছাপ মুসলমানের উদ্দেশ্যে বলতে হয় হিন্দুস্তান শব্দটির মূল সিন্ধু নদ । তখনের পারস্যবাসী ‘স’ কে ‘হ’ উচ্চারণ করতো আর আরবীরা ‘প’ কে ‘ফ’ । তাই সিন্ধু হলো হিন্দু আর পারসী হলো ফারসী । সর্ব শক্তিমানকে পারসীরা বলতো ‘অহুর মাজদা’ অর্থাৎ সে যেমন বলীয়ান তেমনই বুদ্ধিমান । ভারতীয়ের উচ্চারণে অহুরের ‘হ’ হলো ‘স’, জন্ম নিলো হিন্দুদের অসুর আর এভাবেই সিন্ধু নদের তীরবর্তী বাসিন্দারা হয়ে উঠলো ‘হিন্দু’ । এই উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমান যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাওঁতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে :’হাত মে বিড়ি, মু মে পান , লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান তুলে ধর্মীয় হিংসায় মেতেছিল, তখন এই মাদ্রাসাছাপ ধর্মান্তরিত মুসলমানেই বোধের আওতাতেই আসেনি যে, ভৌগোলিক হিন্দুরা রাজনৈতিক পাকিস্তানী হতে চলেছে ।
পাঠক, এবারে লেখা শেষ করবো কিছু তথ্য তুলে ধরে । অস্টিক, দ্রাবিড়ীয়, আর্য ভাষা গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয় ঘটেছে ভারতীয় সভ্যতায় । এই সমন্বয়ের ফলেই জন্ম হয়েছে ‘হিন্দু’ ধর্মের । হিন্দু ধর্মের বিকাশে সংস্কৃতভাষী আর্যরা নেতৃত্ব দিলেও তারা একাধিপত্ব পায়নি আর তাই ‘হিন্দু’ ধর্মে সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন হয়েছে যা উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমানের ‘ইসলাম’ এ কল্পনার বাইরে । ধর্ম মানুষের সৃষ্ট একটা ইউটোপিয়া ছাড়া আর কিছুই না, তাই ধর্মান্তরিতরা এর চর্চা থেকে বিরত থাকলেই মানব সমাজের উপকার ।
রেফ : ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ – সুরজিত দাশগুপ্ত ।