ভারততত্ত্ববিদ, সংস্কৃত বিশারদ, এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

ভারততত্ত্ববিদ, সংস্কৃত বিশারদ, এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদ
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (ভট্টাচার্য) (জন্মঃ- ৬ ডিসেম্বর, ১৮৫৩ – মৃত্যুঃ- ১৭ নভেম্বর, ১৯৩১)(সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান অনুযায়ী)

ছাত্রাবস্থায় তাঁর বন্ধু ও গুরু হয়ে ওঠেন অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। রাজকৃষ্ণই হরপ্রসাদকে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রথম গবেষণাপত্রটি ‘ভারত মহিলা’ নামে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে হরপ্রসাদ এই পত্রিকার নিয়মিত লেখকে পরিণত হন এবং নানা বিষয় নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন। উপন্যাস ও বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধ মিলিয়ে তাঁর প্রায় ৩০টি রচনা বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা পায়।
ইতিহাসবিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সহায়তায় ১৮৮৫ সালে হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন। রাজেন্দ্রলালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ দি স্যান্সক্রিট বুডিস্ট লিটারেচার অব নেপাল (১৮৮২) গ্রন্থে সংকলিত বৌদ্ধপুরাণের অধিকাংশ অনুবাদ তিনি সম্পন্ন করেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের আকরস্বরূপ বিভিন্ন ভাষা ও বিষয়ের পুঁথি সংগ্রহ ও পুঁথির বিবরণাত্মক সূচি (Descriptive Catalogue) প্রকাশের প্রকল্প তত্ত্বাবধান করতেন রাজেন্দ্রলাল। তাঁর মৃত্যুতে ১৮৯১ সালের জুলাই থেকে হরপ্রসাদ সেই শূন্য পদে ‘Director of the Operations in Search of Sanskrit Manuscripts’-নিযুক্ত হন। সংস্কৃত পুঁথি সন্ধানের সূত্রেই তাঁর আগ্রহে প্রাচীন বাংলা পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু হয় এবং এ বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেন দীনেশচন্দ্র সেন এবং  মুনশি আবদুল করিম। এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা প্রকল্পের মধ্যে হরপ্রসাদই প্রথম ‘বাংলা পুঁথি সন্ধান ও বিবরণ প্রকাশ’ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করেন। অল্প কয়েকজন সহকারী নিয়ে হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির দশ হাজার পুঁথির ক্যাটালগ প্রস্তুত করেন। এই ক্যাটালগের যে দীর্ঘ মুখবন্ধটি তিনি রচনা করেছিলেন, তা সংস্কৃত সাহিত্যের একটি মূল্যবান ইতিহাস। সংস্কৃত পুঁথি নিয়ে চর্চা করতে করতেই হরপ্রসাদ বাংলা পুঁথির বিষয়েও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পুঁথির সন্ধানে তিনি অনেকবার নেপাল গিয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে তাঁর হাতে আসে বাংলার প্রাচীনতম কবিতা-সংগ্রহ চর্যাগীতির পুঁথি। দীর্ঘ সাতআট বছর পুঁথির রচনাগুলি গবেষণা করে তিনি আবিষ্কার করেন যে, গানগুলির ভাষা প্রাচীন বাংলা। ১৯১৬ সালে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা গ্রন্থে দুটি দোহা কোষ ও ডাকর্ণব পুঁথির সঙ্গে চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় পুঁথি হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় বা চর্যাগানের সংকলনটি আবিষ্কার ও সম্পাদনা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

১৯১৯ ও ১৯২০ সালে দুই বছর হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির পদ এবং পরে আজীবন সহসভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। সোসাইটিতে Descriptive Catalogue সংকলন-সম্পাদনা ছাড়া ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বহু তথ্য তিনি উদ্ধার ও প্রকাশ করেন যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য  বৃহদ্ধর্মপুরাণ, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম্ ও আর্যদেবের চতুঃশতিকা।
১৮৮৫ সালে হরপ্রসাদের সহযোগিতায় রমেশচন্দ্র দত্ত ঋগ্বেদসংহিতা-র অনুবাদ প্রকাশ করেন। রমেশ দত্তের প্রভাবে হরপ্রসাদ অর্থনীতি বিষয়ক ইতিহাসেও আগ্রহী হন এবং পাঁচটি প্রবন্ধ রচনা করেন, যার মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে লেখা ‘নূতন খাজানা আইন সম্বন্ধে কলিকাতা রিভিউর মত’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধটি ১২৮৭ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শন কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

এশিয়াটিক সোসাইটির সংগঠন ও পরিচালনায় ইংরেজদের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। বাঙালিদের আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলার নিজস্ব একাডেমি গড়ে তোলা। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ পায় ১৩০০ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তিনি সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ১২ বৎসর সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অভিভাবকত্বে বাংলা ভাষা-সাহিত্য নিয়ে বহুমুখী গবেষণা, পরিষদ-পত্রিকার মান উন্নয়ন, আধুনিক পদ্ধতি অনুযায়ী দুর্লভ প্রাচীন গ্রন্থের সম্পাদনা ও প্রকাশ, ব্যাপকভাবে বাংলা পুঁথি সংগ্রহের আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালির এই নিজস্ব সংস্কৃতিকেন্দ্র পূর্ণ বিকাশ লাভ করে।
হরপ্রসাদের লেখক জীবনের বিস্তার প্রায় ৫৫ বছর। তাঁর সাহিত্য-জীবন বঙ্কিমযুগ থেকে রবীন্দ্রযুগ অবধি প্রসারিত। তিনি বহু গবেষণাপত্রও রচনা করেন। তিনি ছিলেন এক খ্যাতনামা হিস্টোরিওগ্রাফার। স্বীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছিলেন বহু পুরস্কার ও সম্মান। তাঁর বিখ্যাত বইগুলি হল বাল্মীকির জয়, মেঘদূত ব্যাখ্যা, বেণের মেয়ে (উপন্যাস), কাঞ্চনমালা (উপন্যাস), সচিত্র রামায়ণ, প্রাচীন বাংলার গৌরব ও বৌদ্ধধর্ম। তাঁর উল্লেখযোগ্য ইংরেজি রচনাগুলি হল মগধান লিটারেচার, সংস্কৃত কালচার ইন মডার্ন ইন্ডিয়া ও ডিসকভারি অফ লিভিং বুদ্ধিজম ইন বেঙ্গল।

জীবনে হরপ্রসাদ বহু বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানের সম্মাননা পেয়েছেন, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য- ১৮৮৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন ফেলো মনোনয়ন; ১৮৯৮ সালে সরকারের দেওয়া সম্মান ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি (মহারানী ভিক্টোরিয়ার ৬০তম রাজ্যাঙ্কে প্রবর্তিত); ১৯১১ সালে ‘সি.আই.ই’ উপাধি; ১৯২১ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির অনারারি মেম্বার মনোনয়ন; ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি ডি.লিট এবং ১৯২৮ সালে পঞ্চম ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের (লাহোর) মূল সভাপতি। ১৯৩১ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

তাঁর আসল নাম ছিল হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য।
হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁদের আদি নিবাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটিতে। তাঁর পারিবারিক পদবী ছিল ভট্টাচার্য। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর হরপ্রসাদ কলকাতার সংস্কৃত কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতায় তিনি তাঁর বড়দা নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বন্ধু তথা বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে থাকতেন। ১৮৭১ সালে হরপ্রসাদ Entrance পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৭৩ সালে পাস করেন F.A. পরীক্ষা। ১৮৭৬ সালে B.A. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৮৭৭ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে M.A. পরীক্ষায় পাস করে তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন। উক্ত পরীক্ষায় হরপ্রসাদই ছিলেন প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ একমাত্র ছাত্র।

কর্মজীবন
১৮৭৮ সালে তিনি হেয়ার স্কুলে শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। একই বছর তিনি কিছুদিন লখনৌ ক্যানিং কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৮৮৩ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এই সময়ই বাংলা সরকার তাঁকে সহকারী অনুবাদক নিযুক্ত করে। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরিতে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃত বিভাগীয় প্রধান হন। এরপর ১৯০০ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। ১৯০৮ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি সরকারের তথ্যকেন্দ্রে যোগ দেন। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান। অধ্যাপনা ও সরকারি কাজের পাশাপাশি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দু বছর এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি, বারো বছর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি এবং লন্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য ছিলেন।
………………