এই যে লম্বা দাড়ির ক্রিকেটার হাশিম আমলা, তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দিতে টুইট করেছেন। পাকিস্তানের মসজিদে জুম্মার নামাজের সময় তিনি বক্তব্য রেখেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতনকে বিশ্ব বিবেক যেন প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে। এই একই ব্যক্তি সৌদিদের চালানো গণহত্যার সময় নিরব ছিলেন। মিডিয়াতে আসা ইয়েমেনী নারী-শিশু বৃদ্ধদের রক্তাক্ত ছবি তো রোহিঙ্গাদের রক্তাক্ত ছবির মতই লাল ছিলো- তবু আমলার মত সেলিব্রেটিদের মানবতাবোধ ঘুমিয়েছিলো কেন?
গেল রোজায় কমলাপুরের যে বৌদ্ধ বিহার মুসলমানদের ইফতার বিতরণ করেছিলো এক মাস ধরে- সেই তারাই এখন ভয়ে মন্দির ছেড়ে বাইরে আসে না হামলা হতে পারে ভেবে। মন্দিরের বাইরে পুলিশ প্রহরা। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পরে সারা বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির এবং বাড়িঘরে হামলা চলেছিলো। সেই কাহিনীর উপর লেখা তসলিমার ‘লজ্জ্বা’ উপন্যাস নিষিদ্ধ করেছিলো সরকার। কারণ মুসলমানদের অপকর্মের কোন প্রমাণ রাখা যাবে না। এসব লিখলে দেশে দাঙ্গা বাধবে। মানে যারা মন্দির ভেঙ্গেছে, হিন্দু মেরেছে, বৌদ্ধ মেরেছে তারাই এসব পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ফের হামলা চালাবে। তাই দেশের ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি’ ধরে রাখতে রামু, গোপালগঞ্জ, মালোপাড়া, নাসিরনগরের ঘটনা ভুলে যেতে হবে…।
সত্য কথা বললেই আপনি হিন্দু, আরএসএস, শিবসেনা, ভারতীয় এজেন্ট…। কাস্মিরী জিহাদীদের কিংবা রোহিঙ্গা জিহাদীদেরকে আপনাকে ফিডমফাইটার বলতে হবে- তাহলেই আপনি নিরপেক্ষ। আপনি কাস্মিরের স্বাধীনতা চান কিন্তু বেলুচের স্বাধীনতা চান না। কাস্মিরে মুসলমানদের উপর নির্যাতন আপনার চোখে পড়ে কিন্তু কাস্মিরী পন্ডিতদের কাস্মির থেকে বিতাড়ন আপনি এড়িয়ে যান। বার্মার তাড়া খেয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখে আপনার খারাপ লাগে কিন্তু দেশী সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা পাহাড়ীদের দেখে খারাপ লাগে না। রোহিঙ্গা গ্রামের আগুন আর সাঁওতাল পল্লীর আগুন তো একই। দুটোই পুড়ায় কিন্তু আপনার সাম্প্রদায়িক মনে দুরকম অনুভূতি হয়…।
আমার আপত্তিটা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা প্রদর্শনটি পুরোপুরি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটেছে। এতে গোটা দেশের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। মিডিয়া ‘বৌদ্ধদের হাতে মুসলমান নিধন’ বানিয়ে দিলো। অপরদিকে জাতিসংঘ, ইউরোপ বার্মিজদের যে চাপ দিচ্ছে সেটি সম্পূর্ণ মানবিক দিক থেকে। এমনকি শিখ সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় সংগঠন প্রতিদিন ৩৫ হাজার রোহিঙ্গাদের রান্না করা খাবার পরিবেশন সম্পূর্ণ মানবিক অবস্থান। কিন্তু সারাদেশে ‘রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাহায্য করুন’- একপেশী সাম্প্রদায়িক প্রচারণাই বলে দেয় তাদের এই দান আর ত্রাণ রোহিঙ্গারা মুসলমান বলেই।
মজা হচ্ছে, মুসলমানরা কোন ধান্দা ছাড়া নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিও কোন সহানুভূতি দেখায় না। যদি সত্যিই তাদের নুন্যতম কোন মানবতাবোধ থাকত তাহলে সারা বিশ্ব থেকে হজ করতে গিয়ে এ বছর হাজিরা সৌদিতে ইয়েমেনের মুসলমানদের উপর চালানো সৌদি বর্বরতা জন্য প্রতিবাদ জানাত। সেটা সম্ভব না হলে এ বছর সৌদিতে হজ বয়কট করে ইয়েমেনের মুসলমানদের প্রতি সৌদিদের গণহত্যার প্রতিবাদ জানানো যেতো। ইরানীরা গত বছর হজ বয়কট করেছিলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অপরাধে সৌদিরা বাংলাদেশী মুসলমানদের জন্য হজ নিষিদ্ধ করেছিলো। তার মানে হজ বয়কট বা নিষিদ্ধ করার অতিত ইতিহাস আছে। তাহলে মুসলমানরা সৌদিদের ইয়েমেনী মুসলিম নিধনের প্রতিবাদ জানালো না কেন?
বেলুচ নারীদের পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরে ধরে রেপ করে। প্রতিবাদী বেলুচদের কপালে হত্যা, জেল নয়ত দেশান্তরী হওয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। বেলুচিস্থানের স্বাধীনতা সংগ্রাম বেলুচদের আজকের নয়। বেলুচরাও মুসলমান কিন্তু আপনি কখনই কি শুনেছেন এদেশের মানুষ নির্যাতিত নিপীড়িত বেলুচদের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হয়েছে? কখনই শোনেননি। আপনি কি কখনো ফেইসবুকে লাইভে এখন যাদেরকে রোহিঙ্গা নির্যাতন-হত্যা নিয়ে আবেগপূর্ণ প্রতিরোধ যুদ্ধের আহ্বান জানাতে দেখছেন তাদের কাউকে সাম্প্রতিক ইয়েমেনে চালানো সৌদিদের গণহত্যার বিষয়ে কোন শব্দ করতে দেখেছেন? ইয়েমেনি শিশুদের বোমার আঘাতে থেঁতলানো শরীরগুলো আর নাফ নদীতে ভেসে আসা রোহিঙ্গা শিশুর মৃতদেহ একই ব্যক্তিকে নিস্পৃহ আর কখনো আবেগীত হতে দেখবেন তখন বুঝবেন তিনি মানুষ নন- কেবল মুসলমান!