সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা রাজশেখর বসু……।।।


রাজশেখর বসু (মার্চ ১৬, ১৮৮০এপ্রিল ২৭, ১৯৬০) ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা। তিনি পরশুরাম ছদ্মনামে তাঁর ব্যঙ্গকৌতুক ও বিদ্রুপাত্মক কথাসাহিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ। গল্পরচনা ছাড়াও স্বনামে প্রকাশিত কালিদাসের মেঘদূত, বাল্মীকি রামায়ণ (সারানুবাদ), কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত (সারানুবাদ),
শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা ইত্যাদি ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থগুলিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। চলন্তিকা অভিধান প্রণয়নের জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিতি। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারেভারত সরকার পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প গ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন

রাজশেখর বসু ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দার্শনিক পণ্ডিত চন্দ্রশেখর বসুর ছিলেন দ্বারভাঙ্গা রাজ-এস্টেটের ম্যানেজার। তাঁর নিবাস ছিল নদিয়া
জেলার বীরনগর (উলা) গ্রামে। রাজশেখর বসু ছিলেন চন্দ্রশেখর ও লক্ষ্মীমণি
দেবীর ছয় সন্তানের (শশীশেখর, গিরিন্দ্রশেখর প্রমুখ) মধ্যে দ্বিতীয়।
দ্বারভাঙ্গায় তিনি শৈশবকাল অতিবহিত করেন ও বাংলা ভাষার তুলনায় হিন্দী ভাষায়
পারদর্শীতা অর্জন করেন। তিনি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বারভাঙ্গা রাজস্কুল থেকে
এন্ট্রাস, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পাটনা কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করেন। ফার্স্ট
আর্টস পাস করার পর শ্যামাচরণ দে’র পৌত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।[১] ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন।[২] তখনও এম.এস-সি কোর্স চালু না হওয়ায় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রসায়নে এম.এ পরীক্ষা দেন এবং প্রথম হন।[৩]

কর্মজীবন

১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল পাশ করে মাত্র তিনদিন আইন ব্যবসায় করেছিলেন। আইন ব্যবসার তুলনায় বিজ্ঞান চর্চাতেই অধিকতর সফলতা লাভের লক্ষ্যে আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস কোম্পানীতে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে রাজশেখর তাঁর চাকুরী-জীবনের শুরু করেন। সেখানে তিনি একজন রাসায়নিক হিসেবে সামান্য বেতনে
নিযুক্ত হন । স্বীয় দক্ষতায় অল্পদিনেই তিনি আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র
রায় ও তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডাঃ কার্তিক বসুর প্রিয়ভাজনর হন। ১৯০৪
খ্রিস্টাব্দে তিনি ঐ কোম্পানীর পরিচালক পদে উন্নীত হন।[১][৩]
একদিকে গবেষণার কাজ, অন্যদিকে ব্যবসায় পরিচালনা — উভয়ক্ষেত্রেই তিনি
অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। কেমিস্ট্রি ও ফিজিওলজির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন
করে তিনি এক নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। স্বাস্থ্যহানির দরুন খ্রিস্টাব্দে
এখান থেকে অবসর নিলেও উপদেষ্টা এবং পরিচালক পদে আমৃত্যু এই কোম্পানীর সাথে
যুক্ত ছিলেন।[১] নিয়মানুবর্তিতা ও সুশৃঙ্খল অভ্যাসের জন্য তাঁর জীবন-যাপন-পদ্ধতি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলে তিনি তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।

সাহিত্যকর্ম

রাজশেখর বসুর সাহিত্যিক কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২০-এর দশকে। ১৯২২
খ্রিস্টাব্দে ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে তিনি একটি মাসিক পত্রিকায়
‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ নামে ব্যঙ্গ রচনা প্রকাশ করেন। সেখানে
অনেকগুলো রসরচনামূলক গল্পগ্রন্থ রচনা প্রকাশ করেন, যা তাঁকে প্রভূত
জনপ্রিয়তা প্রদান করেছিল। শনিবারের চিঠি পত্রিকাতেও তিনি নিয়মিত লিখেছেন। গল্পরচনা ছাড়াও স্বনামে প্রকাশিত কালিদাসের মেঘদূত, বাল্মীকি রামায়ণ (সারানুবাদ), কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত (সারানুবাদ), শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা
ইত্যাদি ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থগুলিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা
অর্জন করে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় রাজশেখর বসু বিরচিত বাংলা
অভিধান চলন্তিকা। এগুলি ছাড়াও লঘুগুরু, বিচিন্তা, ভারতের খনিজ, কুটির শিল্প প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থও রচনা করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ২১টি।[২] রাজশেখর বসুর সম্পূর্ণ গ্রন্থতালিকা নিচে প্রদত্ত হল:[৪]

গ্রন্থনাম বর্গ প্রকাশক প্রথম প্রকাশ (বঙ্গাব্দ)
গড্ডলিকা গল্পগ্রন্থ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩৩১
কজ্জলী গল্পগ্রন্থ ১৩৩৫
চলন্তিকা অভিধান সুধীরচন্দ্র সরকার(এম. সি. সরকার অ্যান্ড সনস লিমিটেড) ১৩৩৭
হনুমানের স্বপ্ন গল্পগ্রন্থ এম. সি. সরকার অ্যান্ড সনস লিমিটেড ১৩৪৪
লঘুগুরু (১৯১২) [৫] প্রবন্ধ-সংগ্রহ রঞ্জন পাবলিশিং হাউজ ১৩৪৬
কুটিরশিল্প জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ – ২) ১৩৫০
কালিদাসের মেঘদূত অনুবাদ গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ ১৩৫০
ভারতের খনিজ জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ – ৭) ১৩৫০

সম্মাননা ও স্বীকৃতি

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করে। আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প বইটির জন্য তিনি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃক গঠিত বানান-সংস্কার সমিতি ও ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের
পরিভাষা সংসদের সভাপতিত্বও করেন রাজশেখর। ১৯৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। এছাড়াও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধি প্রদান করে।[১] ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জগত্তারিণী পদক এবং ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরোজিনী পদকেও ভূষিত হন।
বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় রাজশেখর বসুর দু’টি ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেগুলো হলো পরশ পাথর এবং বিরিঞ্চি বাবা অবলম্বনে নির্মিত’মহাপুরুষ

জীবনাবসান

রাজশেখর বসু মৃণালীনি দেবীকে বিবাহ করেন। বসু দম্পতির এক কন্যা ছিল।
তাঁর মেয়ের জামাই খুব অল্প বয়সে অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে; শোকে
কাতর হয়ে মেয়েও একই দিনে মারা যায়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রী
মৃণালীনি দেবীও লোকান্তরিত হন। পরবর্তী ১৮ বছর স্ত্রীবিহীন একাকী জীবনে
রচিত হয় তাঁর অমূল্য সাহিত্যকর্মসমূহ। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের
দুঃখ-দূর্দশার কথা তাঁর লেখনিতে পাওয়া যায়নি। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতে
থাকেন। অবশেষে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ২৭শে এপ্রিল দ্বিতীয় দফা মস্তিষ্কে
রক্তক্ষরণ হলে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান হয়।