গৌরী লঙ্কেশ আমাদের মতই কঠিন ধর্ম সমালোচক ছিলেন। এই সমালোচনার বিরাট অংশ ছিলো হিন্দু ধর্ম। হিন্দুদের কুখ্যাত জাতপাত, শ্রেণী বিভাজনের ঘৃণার বিরুদ্ধে, হিন্দু ধর্মে নারীর প্রতি চরম বৈষম্যের তুমুল সমালোচনা করে অনলাইনে এবং গৌরীর পত্রিকাতে লিখে তিনি ধর্মাবতারদের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমরা যেমন বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলামের তুমুল সমালোচনা করি, ইসলামের মানবতা বিরোধী বিধি, নারীর প্রতি বৈষম্য, অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণার সমালোচনা করি, সংখ্যালঘুদের প্রতি সংখ্যাগুরুদের দমন-পীড়ণকে অনলাইনে তুলে ধরি, গৌরী ছিলেন ভারতে আমাদের সহচরদের একজন।
বাংলাদেশে বাবু, নীলয়, অনন্ত, অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছিলো প্রগতিশীলতা, মুক্তচিন্তা প্রসার এবং ধর্মের সমালোচনার করার কারণে। এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমান বিধায় এখানে ইসলাম ধর্ম তার বিষাক্ত দাঁত-নখ মেলে ধরতে পারে রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে। যে কারণে মুক্তচিন্তক অনলাইন লেখকদের সমালোচনার তীর ইসলামের দিকেই বেশি হয়ে থাকে। গৌরী লঙ্কেশ ভারতের ক্ষমতাবাণ হিন্দু ধর্মাবতারতের সাম্প্রদায়িকতা, নিচু জাত আখ্যা দিয়ে সমাজের মৌলিক অধিকার থেকে দূরে রাখা জনগোষ্ঠি এবং নারীর প্রতি ধর্মের বৈষম্যে নিয়ে লেখালেখি করে বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে তার পত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তচিন্তার প্রবন্ধগুলো জন্য একজন বিজেপি সংসদ সদস্য তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত থেকে জামিন নিয়ে গৌরী তার লেখালেখি অব্যাহত রাখাকালেই সম্প্রতি তাকে গুলি করে নিজ বাড়ির দরজার সামনে হত্যা করা হয়। যদিও বিবিসি মতন মিডিয়ে হিন্দুবাদকে এই হত্যা জন্য দেখিয়েছে।কিন্তু তার পরিবার বলছে ভিন্ন কথা। হত্যা পিছেনে মাওবাদিদের হাত আছে।
গৌরী হত্যা পরবর্তী ভারত এবং বাবু-নীলয়-অভিজিৎ হত্যা পরবর্তী বাংলাদেশ পরিস্কার কিছু তফাত পরিলক্ষিত হয়েছে যা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেই আলোচিত হওয়া উচিত বলে মনে করি। মনে রাখতে হবে গৌরী ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ধর্মান্ধদের বিশ্বাস ও আস্থাতে আঘাত দিয়ে লেখালেখি করছিলেন। যাকে আমরা কুসংস্কার, নারীর প্রতি বৈষম্য, মানুষের প্রতি ঘৃণা বলছি সেটাই কোটি কোটি ধর্মান্ধের কাছে ঈশ্বরের বিধান। গৌরী সেই বিধানের সমালোচনা করে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন। গৌরীকে গুলি করে হত্যা করার পর ভারতের কোন বুদ্ধিজীবী বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন কিন্তু তার ধর্ম সমালোচনাকে আড়াল করে তাকে কেবল ‘বিজ্ঞান লেখক’ কিংবা ‘সমাজ সেবক’ ইত্যাদি কোন ঘোড়াপটে আটকে রেখে তার ধর্ম সমালোচনাকে আড়াল করতে চায়নি। তারা গৌরীর মুক্তচিন্তাকে সন্মান জানিয়েই রাজপথে নেমেছেন। গৌরীর লেখালেখিকে ভারতের কোন বুদ্ধিজীবী ‘নাস্তিকতার আস্ফলোন’ বলে বিতর্কিত করেনি। ‘ধর্ম নিয়ে লেখালেখিকে সমর্থন করি না আবার গৌরী হত্যাকেও সমর্থন করি না’- এরকম মন্তব্য করে গৌরীর হত্যাকে পরোক্ষভাবে একটা যৌক্তিক কারণ দেয়ার চেষ্টাও কেউ করেনি। সবচেয়ে বড় কথা ভারতের মৌলবাদী, হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি অনেক নেতা গৌরীর হত্যাকে সমালোচনা করেছে। যদিও এটা তাদের কুমিরের কান্নার মতই নাটক। কিন্তু এই যে তার হত্যার সমালোচনা করতে তারা বাধ্য হয়েছে এ থেকে প্রমাণ করে ভারতের গণতন্ত্র অনেকখানি শক্তিশালী। বাংলাদেশের কোন ব্লগার হত্যার পর ব্লগারদের লেখক অধিকারের নিমিত্তে কোন ইসলামপন্থি দল কি তাদের হত্যাকে বিরোধীতা করেছে? প্রশ্নই আসে না। বরং আরো নাস্তিক হত্যার জন্য প্রকাশ্যে ফতোয়া দিয়েছে। যারা ফতোয়া দিয়েছে তারা সবাই আইন আদালতে উর্ধের মানুষ। তারা সরকারের ভিআইপি মর্যাদাতে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে।
এম এম কালবুর্গি, ডঃ পানসারি এবং গৌরী লঙ্কেশ মত হিন্দু ধর্মের কঠোর সমালোচকদের মৃত্যুতে ভারতের ধর্মান্ধরা অনলাইনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। এটা অবাক হবার মত কোন ঘটনা নয়। বাংলাদেশে যে কোন প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তার লেখককে হত্যা করার পর ইসলামপন্থিরা যেমন দাঁত কেলিয়ে হাসে। তফাতটা এখানে বাংলাদেশের আধুনিক প্রগতিশীলতার ভান করে এমন লোকজন হত্যাকে জাস্টিফাই করেছে প্রকাশ্যে। তারা কেউ রাস্তায় নামেনি। উল্টো খুনিদের কাজকে নৈতিক ভিত্তি দিয়েছে। এ কারণেই অভিজিৎকে খুন করে খুনিরা থেমে থাকেনি, তার বই যারা প্রকাশ করেছে তাদের ধরে ধরে খুন করেছে। জাস্টিফাই বুদ্ধিজীবীরা বইমেলায় ‘নাস্তিকদের বই’ অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করেছে খুনিদের খুশি করতে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাহিত্য সংস্কৃতির মত প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি মৌলবাদী তোষণে নেমেছে। গৌরীর জন্য যেখানে ভারতের বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদের মুখর হয়েছে সেখানে গৌরীর মত একই ধারার লেখক-প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকের লেখালেখিকে ‘ঘৃণ্য- এটা কেউ পড়বেন না’ বলে নির্লজ্জভাবে বুদ্ধিজীবীরা স্বধর্মের পক্ষ নিয়েছিলেন। এখানই ভারত বাংলাদেশের একটা বুদ্ধিভিত্তিক লেবের পরিস্কার পার্থক্য।
ভারতের প্রগতিশীলদের অভিনন্দন তাদের এই প্রতিবাদ মুখর ভূমিকার জন্য। একই সঙ্গে তাদের কাছে একটি প্রশ্ন, গৌরী লঙ্কেশকে যদি কোন মুসলিম জিহাদী হত্যা করত তাহলে কি তারা প্রতিবাদমুখর হতেন? তসলিমা নাসরিনকে বার বার ভারতের মুসলিম জিহাদীরা লাঞ্ছিত করেছে তখন আপনারা একদম চুপ করেছিলেন। একইভাবে নানা সময়ে ভারতের মোল্লা সমাজের ধর্মাবস্থানের সময়ও ভারতের প্রগতিশীলদের নিরবতা, কখনো কখনো ইসলাম তোষণ ছিলো আতংকিত হবার মত। তারা কি ইসলাম তোষণ থেকে বের হয়ে আসবেন? ইসলাম এবং মুসলমান যে দুটো ভিন্ন বিষয় আশা করি দ্রুত ভারতের প্রগতিশীল এবং বামরা বুঝতে পারবেন।