লিখেছেনঃ তাসলিমা নাসরিন
চরম ডানপন্থী– যারা মুসলিম-বিরোধী, তারাই ভারতবর্ষে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি জারি করার দাবি করছে, শরিয়া আইন বাতিল করার জন্যও চিৎকার করছে। কিন্তু যাদের এসব দাবি করার কথা,যাদের আন্দোলন-চিৎকার করার কথা, তারা করছে না, যারা উদারনৈতিক, ধর্মান্ধ নয় বা ধার্মিক নয়, ধর্মনিরপেক্ষ অথবা নাস্তিক, যারা বামপন্থায় বিশ্বাসী, মানবাধিকারে বিশ্বাসী, বাক স্বাধীনতায়, নারী স্বাধীনতায়, সমতায়, সততায়, সমমর্মিতায় বিশ্বাসী– তারা কিন্তু চুপ করে আছেন, কিছুই বলছেন না। মুসলিম মেয়েরা মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারে না, অথবা বাল্য বিবাহের শিকার হয়,বোরখায় শরীর আবৃত করতে বাধ্য হয়, মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার সব কিছুর সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম তাহলে কে করবে? চরম ডানপন্থীরা মুসলিম মেয়েদের বোরখার বিরুদ্ধে বলছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে, মুসলিম মেয়েদের প্রতি ভীষণই তারা সহানুভূতিশীল। সত্যি বলতে কী, মুসলিম মেয়েদের প্রতি কোনও সহানুভূতির কারণে নয়, তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুসলিমদের ভুলভ্রান্তির দিকে আঙ্গুল তুলে রাখে, মুসলিমরা যে আধুনিক নয়, সমাজের জন্য কল্যাণকর কিছু কাজ যে তারা করে না, মেয়েদের বোরখার অন্ধকারে বন্দি করে রাখে, তারা যে ভারতে বাস করার উপযুক্ত নয়, অনিষ্ট ছাড়া আর কিছু যে তারা করতে পারে না, হিংসে মারামারি হানাহানি যে তাদের রক্তে, তাদের মূল সমস্যা যে তাদের ধর্মে, ধর্মগ্রন্থে, ধর্মীয় আইনে — তা বোঝাতে চাইছে। হিন্দুদের বা অমুসলিমদের ধর্মীয় আইনেও যে সমস্যা ছিল, মনুর আইনে যে মেয়েদের অধিকারের কোনও বালাই নেই, মেয়েদের সমানাধিকারের জন্য দীর্ঘকাল আন্দোলন হওয়ার ফলে ধর্মীয় আইন বাতিল করে জোড়াতালি দিয়ে হলেও সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরি করা হয়েছে, এ নিয়ে অবশ্য মুখ তারা খোলে না। চরম ডানপন্থীরাই ধর্মীয় আইন টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। উদারনীতিকরাই– যাঁরা নারীর অধিকারে বিশ্বাস করেন, ধর্মীয় আইনের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে বলেছিলেন বলে রাজা রাম মোহন রায়ের বিপক্ষে, বিধবা বিবাহের পক্ষে বলেছিলেন বলে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে হিন্দু কট্টরপন্থীরাই কি কম ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন? আজ হিন্দু কট্টরপন্থীরা যে কাজ বিদ্যাসাগররা করেছিলেন, সেই কাজ করতে চাইছেন। কিন্তু নিজেদের ধর্মীয় সংস্কার করার জন্য নয়, অন্যের ধর্মীয় সংস্কার করতে। আমি মনে করি না, কোনও ধর্মীয় আচার আচরণের এবং পিছিয়ে থাকা সমাজের সংস্কারের জন্য শুধু ওই ধর্মের মানুষ ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষের এগিয়ে আসা উচিত নয়। মানুষ মাত্রেরই উচিত সব সমাজের কল্যাণের জন্যই কাজ করা । কিন্তু নিজের ধর্মের এবং সমাজের অহেতুক প্রশংসা করবো,ভুলগুলো দেখেও দেখবো না, কিন্তু অন্যের ধর্মের এবং সমাজের বিস্তর নিন্দে করবো,ওদের গালিগালি করবো — এ নিতান্তই নিন্দুকের কাজ, মোটেও কোনও সংস্কারকের কাজ নয়।
আমি কোনও গোত্রের বা গোষ্ঠীর বিরোধী না হয়ে, বা নিতান্তই নির্দলীয় হয়ে নারীবাদী হিসেবে মানবাধিকারের পক্ষে অভিন্ন দেওয়ানী বিধির জন্য লড়ি, হিন্দু কট্টরপন্থীরাও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে লড়েন। দু’ পক্ষের উদ্দেশে নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে, আমি চাই মুসলমানরা ধর্মান্ধতা থেকে উদ্ধার পাক, আধুনিক সমতার সমাজ গড়ে তুলুক, আলোকিত হোক। হিন্দু কট্টরপন্থীদের উদ্দেশ্য আমার কাছে অনেকটাই অষ্পষ্ট। গরুর মাংস খাক বা বিক্রি করুক, এ কারণে আমি মুসলিমকে হত্যা করার বিরুদ্ধে, কিন্তু হিন্দু কট্টরপন্থীরা হত্যা করার বিরুদ্ধে নয়। যে কোনও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধেও। কিন্তু তাই বলে হিন্দু মৌলবাদিরা বদ উদ্দেশেও যদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে বলে, আমি কি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিপক্ষে বলবো? নিশ্চয়ই নয়। আমার চরম শত্রু যদি বলে, সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, আমাকে কি তার বিপরীত কথা বলতে হবে? বলতে হবে, না সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে না, সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে? নিশ্চয়ই নয়। একবার এক বন্ধুকে বলেছিলাম, এত প্রগতিশীল হয়েও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড সাপোর্ট করছো না কেন? সে বলেছিল, কারণ বিজেপি ওটা সাপোর্ট করে। বিজেপি চায় বলে সে চায় না, বা তারা চায় না।
বোরখা নিষিদ্ধের কথা শুনলে লোকে আঁতকে ওঠে। মানবাধিকার মেনে চলায় পৃথিবীর প্রথম সারির ১৪টি দেশ বোরখা নিষিদ্ধ করেছে, কিছু কিছু জায়গায়, অথবা সর্বত্র, কিছুটা, অথবা সবটা। বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, বুল্গেরিয়া, কসোভো, ডেনমার্ক , ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, লাটভিয়া, নরওয়ে। মূলত মুখ ঢাকা নিয়েই এদের আপত্তি। কেউ মুখ ঢেকে চলাফেরা করলে আশে পাশের অনেকে আজকাল নিরাপদ বোধ করছে না। সম্প্রতি শ্রীলংকা নিষিদ্ধ করেছে বোরখা। কোনও সন্ত্রাসী বোরখায় মুখ মাথা বোমার বাক্স সব আড়াল করে ছুটোছুটি করবে আর পুলিশ কিছু টের পাবে না, এ হওয়া উচিত নয় বলেই বোরখা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শ্রীলংকা।
সেদিন বাংলাদেশে চার চারটে ষণ্ডা পুরুষ বোরখা পরে এসে নুসরাত নামে একটি মাদ্রাসার মেয়ের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। নুসরাতকে পুড়িয়ে মেরেছে ওরা। নুসরাতের দোষ, নুসরাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, যে লোকটি যৌন হেনস্থা করতো তাকে, সেটি পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিল।
বোরখা পরে আত্মঘাতি বোমা হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর আমরা তাকে নিরীহ মেয়েমানুষ ভেবে তার আশে পাশে নিরাপদ বোধ করছি, এই বোকামোর দিন শেষ হয়েছে। বোরখা বিভিন্ন মানুষ পরে, ১ দোযখে যাওয়ার ভয়ে ধর্ম দ্বারা মগজধোলাই হওয়া মেয়ে, ২ আত্মীয় স্বজনের চাপে বাধ্য হওয়া মেয়ে, ৩ আত্মঘাতী বোমা, ৪ জেল পালানো দাগী আসামি, ৫ ক্রিমিনাল যার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে , ৬ চোর, ৭ ডাকাত, ৮ খুনী।
বোরখা পৃথিবীর সব জায়গায় নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। বোরখা নিষিদ্ধ হওয়ার পর মেয়েরা মানুষের অধিকার নিয়ে চলাফেরা করতে পারবে, চলমান কারাগারের ভেতর মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার শাস্তি ভোগ করতে হবে না, নামপরিচয়হীন অবয়বহীন একটি ভূতুড়ে জীবন যাপন করতে হবে না। মেয়েদের জন্য এর চেয়ে বড় সুখবর আর কী হতে পারে! যে মেয়েরা বলে বোরখা পরতে তাদের ভালো লাগে, বা এটা তাদের মানবাধিকার — তারা মগজধোলাই হওয়ার কারণে বলে।
মনে আছে ২০১০ সালে বোরখা নিয়ে আমার একটি পুরোনো লেখা কর্ণাটকের একটি পত্রিকায় পূণর্মুদ্রণ করা হয়েছিল, অবশ্য আমাকে না জানিয়েই। দুটো শহরে রীতিমত দাঙ্গা বেঁধে গিয়েছিল। দাঙ্গা করতে নেমেছিল কিন্তু পুরুষেরা। পোশাক কিন্তু মেয়েদের। মেয়েরা কী পোশাক পরবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় পুরুষেরা। এতই যদি বোরখা ভালো পোশাক, এই পোশাকটি পরতে কেন পুরুষের আগ্রহ নেই। মেয়েদেরও যে যৌন আকাঙ্ক্ষা আছে, মেয়েরাও যে পুরুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে, এগুলোর তো প্রমাণ মিলেছে, মেয়েরা এমনকী পর-পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে স্বামীকে খুন করছে। পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষাকে ফুঁসে উঠতে না দেওয়ার জন্য মেয়েদের মুখ মাথা শরীর হাত পা যদি ঢেকেই রাখতে হয়, তাহলে নারীর যৌন আকাংখাকে প্রশমিত করতে পুরুষও বোরখা পরুক। কিন্তু চোর ডাকাত খুনী বদমাশ সন্ত্রাসী ছাড়া কোনও পুরুষই বোরখা পরবে না, কারণ তারা মনে করে, বোরখা তাদের পৌরুষ নষ্ট করবে, যেমন শাড়ি চুড়ি তাদের পৌরুষ নষ্ট করে।
শাড়ি, চুড়ি, বোরখা, লিপ্সটিক, কাজল–এসব মেয়েদের জিনিস। মেয়েদের জিনিস শরীরে চড়ালে, বা মেয়েদের কাজ বলে যেসবকে ভাবা হয়, সেসব যেমন রান্নাবান্না,ঘর পরিষ্কার, বা সন্তান পালন,ইত্যাদি কাজ করলে পুরুষের মান সম্মান চলে যায়। অথচ মেয়েরা দিব্যি পুরুষের পোশাক পরছে, পুরুষের মতোই কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে, এতে মেয়েদের মর্যাদা বরং বাড়ছে। এই চিত্রই তো আমাদের বুঝিয়ে দেয়, মেয়েদের ঠিক পুরুষের মতো মানুষ ভাবা হয় না, কিছুটা কম-মানুষ ভাবা হয়। প্রযুক্তিতে আধুনিক হয়েছে সমাজ, কিন্তু মানসিকতায় বিন্দুমাত্র নয়।
বোরখা মেয়েদের জন্য অসম্মানের প্রতীক, এ আমরা সকলেই জানি, তারপরও এই প্রতীককে সম্পূর্ণ দূর করছি না। সত্যি বলতে, বোরখা মেয়েদের জন্য যতটা অসম্মান, পুরুষের জন্যও তারও চেয়ে বেশি। মেয়েরা বোরখা পরা মানে প্রমাণ হয় সমাজের পুরুষেরা নিজেদের যৌন উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে জানে না। তারা অক্ষম, তারা অপারগ। তাদের ব্যক্তিত্বের উর্ধে তাদের রিপু। মেয়েরা বলুক, ‘তোমার যৌন উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে তুমি পারো না, সে তোমার সমস্যা, আমার নয়। তোমার সমস্যার জন্য আমার মুখ মাথা চুল সব ঢেকে দেবে, এ হতে পারে না। আমি তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নই যে তুমি আমাকে আদেশ দেবে আমি কী পরবো, কীভাবে পরবো, কোথায় যাবো, কতদূর যাবো। তোমার সমস্যার সমাধান তুমি করো। আমাকে তার দায় নিতে হবে কেন! যৌন উত্তেজনা আমারও আছে, সে কারণে তোমার নাক চোখ মুখ ঢেকে রাখার দাবি আমি করিনি। আমার ইচ্ছে হলে আমি চোখে কাজল পরবো,কাজল কালো চোখ দেখলে যদি তোমার সমস্যা হয়, তাহলে আমারে চোখের দিকে তাকিও না। যদি তারপরও চোখ চলে যায় মেয়েদের চোখের দিকে, আর তোমার পুরুষাংগ নিয়ে তুমি বিষম মুশকিলে পরো, তাহলে শক্ত করে নিজের চোখদুটো বেঁধে রাখো কালো কাপড় দিয়ে। এর চেয়ে ভালো সমাধান আর হয় না। তোমাকে উত্তেজিত করে এমন জিনিস তোমাকে দেখতে হবেনা। তুমিও বাঁচবে, আমিও বাঁচবো।’
কেউ কেউ বলছে ভারতে বোরখা যদি নিষিদ্ধ করা হয়, ঘুংঘটও নিষিদ্ধ করতে হবে। হোক নিষিদ্ধ। মেয়েদের মুখ মাথা চুল ঢেকে রাখতে হবে, স্বামী ছাড়া আর কেউ মেয়েদের মুখ দর্শন করতে পারবে না। মেয়েরা হলো স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি — এই বিশ্বাস আজ একুশ শতকেও মানুষ কী ভয়ঙ্কর ভাবে পুষে রেখেছে। যতদিন বোরখা বা ঘুঙ্ঘট মেয়েরা পরবে, ততদিন প্রমাণ হবে এই সমাজে মেয়েরা আজও যৌনবস্তু, মেয়েরা আজও পুরুষের দাসি।