শুধু সুবীর নন্দী নয়, আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতেও বাঙালি মুসলমানরা একইভাবে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ কারণ কি???

শুধু সুবীর নন্দী নয়, আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতেও বাঙালি মুসলমানরা একইভাবে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করেছিল। কিন্তু কেন একজন সঙ্গীতশিল্পী মারা গেলে তাতে মুসলমানদের আনন্দ পাওয়ার কি আছে?

ইসলামে গান বাজনা হারাম সেটাই কি প্রধান কারণ?যদি তাই হয় তাহলে সুবীর নন্দীর মত শিল্পীকে কারা সৃষ্টি করেছে? কোটি কোটি মানুষ তার গানকে হৃদয়ে ধারণ করেছে, তারা কি সবাই অমুসলিম? নাকি মুসলিম?

অবশ্যই তার বড় একটা অংশ মুসলমান, তারপরেও কেন এত বিদ্বেষ, তার পরেও কেন তার মৃত্যুতে মুসলিমদের উল্লাস? সব মুসলমান কি উল্লাস করতেছে? নাকি হাতে গোনা কয়েকজন অনলাইন এক্টিভিস্ট এই উল্লাসে অংশ নিয়েছে?

ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ, ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের উপর আক্রমণ, ভিন্নধর্মী মানুষের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ, এগুলো একদিনে তৈরি হয়নি। শুধুমাত্র সংগীত শিল্পীরা আক্রমণের শিকার হচ্ছে, বিষয়টা ঠিক সেটাও না।

বাঙালি মুসলিমদের আক্রমণের শিকার সবাই। কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী, নাস্তিক এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী বর্তমান সময়ে এরা সবাই মুসলিমদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। জোর করে মানুষের উপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া, ধর্ম অস্বীকার করলে তার ওপর আক্রমণ করা, এগুলো এখন খুবই স্বাভাবিক বিষয়।

কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের এই বিশাল পরিবর্তনের পিছনে আসল কারণ কি? কখনো কি আপনারা এটার গভীরে যাওয়ার চিন্তা করেছেন?

যারা আনন্দ করতেছে তারা কারা? তারা কি মাদ্রাসার ছাত্র? তারা কি সবাই মডারেট মুসলিম? তারা কি সবাই মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মুসলিম? তারা কি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত? নাকি তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা মুসলিম?

অবশ্যই তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা মুসলমান, তারা হতে পারে প্রবাসী, হতে পারে মাদ্রাসা ছাত্র, হতে পারে স্কুল পড়ুয়া মডারেট ধার্মিক, হতে পারে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত?

কিন্তু তাদের এই বিদ্বেষ এই ঘৃণা কারা শিখাচ্ছে? তাদের এই উগ্রতার পিছনে কারা ইন্দন দিচ্ছে? স্কুলের শিক্ষকরা, মাদ্রাসার হুজুররা, নাকি রাজনীতিবিদরা? কারা এই উগ্রতার পিছনে দায়ী?

খুব খেয়াল করবেন, বিজ্ঞানের বদৌলতে প্রযুক্তি এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। সবার হাতেই মোবাইল। আর তার মধ্যে আছে ফেসবুক, ইউটিউব। বাঙালি মুসলমানরা ফেইসবুক, ইউটিউবে সাধারণত কি দেখে?

বিশেষ করে ইউটিউবে আসাযাক। নাটক, মুভি, বিভিন্ন ধরনের সংগীত, ইসলামী সংগীত এবং ওয়াজ মাহফিল। ইউটিউব এ বাঙালিরা এগুলোই বেশি দেখে?

তাহলে তাদের উগ্র মনোভাবের পিছনে কি নাটক, মুভি অথবা বিভিন্ন ধরনের সংগীত দায়ী? নাকি বিভিন্ন হুজুরের ওয়াজ মাহফিল?

এবার ফেসবুকে আসা যাক। বিভিন্ন ছবিতে লাইক কমেন্ট শেয়ার করা, বিভিন্ন স্ট্যাটাস পড়া, ভিডিও দেখা, নিজের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করা, এবং বিভিন্ন গ্রুপে একটিভ থাকা, সচরাচর বাঙালি মুসলমানরাই এগুলাই করে থাকে।

তাহলে ফেসবুকে এমন কি আছে যেটা তাদের উগ্রতার কারণ হতে পারে?নিজের ছবি শেয়ার করা অন্যের ছবিতে লাইক কমেন্ট করা বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাটাস পড়া, সেগুলো নাকি বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখা?

এবার আসা যাক বাঙালি মুসলমানরা কি ধরনের ভিডিও দেখে, ফেসবুকে সচরাচর সব ধরনের ভিডিও টাইমলাইনে চলে আসে, কিন্তু বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও গুলো একটু বেশি দেখা যায়।

তাহলে ধরা যাক, বাঙালি মুসলমানরা ইউটিউব এবং ফেসবুকে, বিভিন্ন ধরনের ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও গুলো বেশি দেখে, এবং শেয়ার করে।

তাহলে কি উগ্রতা ছড়ানোর পিছনে এই ধরনের ওয়াজ মাহফিল গুলাই দায়ী?

বর্তমানে ইউটিউব একটা লাভজনক ব্যবসা। বিভিন্ন ধরনের ভিডিও ইউটিউব এবং ফেসবুকে শেয়ার করে খুব ভালোভাবে টাকা ইনকাম করা যায়। হাজার হাজার ইউটিউবার, নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে, এই ধরনের ভিডিওগুলো সব জায়গায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর তাদের পরিচিতি পাওয়ার জন্য একই কাজ তারা ফেসবুকেও করে যাচ্ছে।

তাহলে বাঙালি মুসলমানদের উগ্রতার পিছনে কি ওয়াজ মাহফিল গুলো দায়ী? কিন্তু ওয়াজ মাহফিলে কি এমন আলোচনা করা হয় যেটার কারনে বাঙালি মুসলমানের মানসিকতা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, দিন দিন তারা উগ্র হয়ে যাচ্ছে, ওয়াজে কি এমন বলা হয় যে তারা মুসলমান ব্যতীত অন্য কোন ধর্মালম্বীদের কি সহ্য করতে পারে না?

বর্তমানে হুজুররা ওয়াজ মাহফিল গুলোতে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা করে। কোন লেখক মারা গেলে, কোন শিল্পী মারা গেলে, কোথাও জঙ্গি হামলা হলে, কোথাও কোন নারীরা পুরুষের চেয়ে এগিয়ে গেলে, কোথাও কোন বিজ্ঞানী নতুন কোন তথ্য আবিষ্কার করলে, সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো হুজুরদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে যায়।

ওয়াজের বক্তারা নিজেদেরকে অনেক বড় জ্ঞানী মনেকরে, আর সামনে যারা বসে থাকে তাদেরকে মনে করে তারা খুবই অশিক্ষিত ধর্ম সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণা নেই। তাই তাদের কাছে ধর্মের সত্যতা পৌঁছে দেওয়া তাদের কর্তব্য। আর ইসলাম সেটাই বলে, আলেমরাই সাধারণ মুসলমানকে ধর্ম শিক্ষা দিবে।

কিন্তু আলেমরা কি ধর্ম শিক্ষা দিচ্ছে? নাকি উগ্রতা, জঙ্গিবাদ, নারী বিদ্বেষ, এই ধরনের বিষয়গুলোকে জাগিয়ে দিচ্ছে। সমাজ নিয়ে হুজুররাই বা কতটুকু ধারণা রাখে, হুজুররা কতটুকু ধারণা রাখে রাজনীতি নিয়ে? হুজুররা কতটুকু ধারণা রাখে বিজ্ঞান নিয়ে? যে হুজুররা মাহফিলে নিজেদেরকে মহাজ্ঞানী সাজিয়ে বসে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তারা কতটুকু জ্ঞানী?

যে হুজুররা প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করতে বলে, যে হুজুররা নিজের মতাদর্শের বাইরে গেলে যে কাউকে কাফের উপাধি দিয়ে দেয়, যে হুজুররা কোন সঙ্গীত শিল্পী মারা গেলে তাতে উল্লাস প্রকাশ করে, যে হুজুররা কোন লেখককে চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করলে, প্রকাশ্যে সেটাকে সমর্থন করে। যে হুজুররা মনের মধ্যে লালন করে ওসামা বিন লাদেনকে। যে হুজুররা মোল্লা ওমরকে নিজেদের আদর্শ মনে করে। যে হুজুররা চিৎকার করে বলে, যে নাস্তিক হবে তার কল্লা ফেলে দিতে হবে।

যে হুজুররা নারীদেরকে বেশ্যা পতিতা বলে সম্বোধন করে। যে হুজুররা মেয়েদেরকে তরমুজ মনে করে। যে হুজুররা মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে। যে হুজুররা বাংলাদেশকে ১০০ ভাগ মুসলিম কান্ট্রিতে রূপান্তরিত করার ঘোষণা দেয়। যে হুজুররা বাংলার জমিনে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে। যে হুজুররা আফগানিস্তান পাকিস্তান কে নিজেদের আদর্শ মনে করে। যে হুজুররা ইহুদি নাস্তিক খ্রিস্টানদের বিজ্ঞান কে লাথি মেরে ভাঙতে বলে, আর সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই ধর্ম প্রচার করে যাচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য সেই ভয়ঙ্কর উগ্র জঙ্গীবাদের আদর্শ লালনকারী সেই হুজুররাই আজকে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করতেছে। আর রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে, হুজুরদের সেই উগ্র মনোভাবকে সমর্থন দিয়ে, দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান পাকিস্তানের কাতারে।

নিঃসন্দেহে চোখ বন্ধ করে বলা যায়, সুবীর নন্দীর মৃত্যুতে এই উল্লাস এর আসল কারণ, মোল্লাদের ধর্মীয় উন্মাদনা। আর রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থ। যেটাকে পুঁজি করে তরুণ প্রজন্ম দিন দিন অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রিয় সুবীর নন্দী আপনার প্রতি ভালোবাসা, আপনার রেখে যাওয়া হাজারো গানের মাঝেই আপনি বেঁচে থাকবেন। কোন উগ্রবাদ, কোন জঙ্গিবাদ আপনার সৃষ্টি করা সংগীতকে ধ্বংস করতে পারবে না।