“ব্রাহ্মন্যবাদ/ মনুবাদ বলে কি ছিলো বা আছে ? তার জন্যই হিন্দুরা ধর্ম পরিবর্তন করলো”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
ব্রাহ্মন্যবাদী বা মনুবাদী বলে গাল পাড়ার একটিই উদ্দেশ্য । হিন্দুদের এবং বৈদিক ধর্মের নিন্দা করা, বেদ ভিত্তিক ধর্মকে নীচু এবং ঘৃন্য সেটাই বলা। এই নিন্দা করে কি হয় ? হিন্দু বিরোধী গোষ্টি তৈরী করে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজন করে রাজ ক্ষমতা বহাল রাখা। যতোদিন হিন্দুদের দেশে হিন্দুরা শাসন ক্ষমতায় ছিলো, তখন সেই প্রয়োজন পড়েনি। সেই প্রয়োজন হয়েছিলো সম্রাট অশোক বৌদ্ধ হবার পর থেকে। ভালো করে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, সম্রাট অশোকের সময় হিন্দুদের ওপরে কম অত্যাচার হয়নি। আঙ্কোর ভাটের ‘বিষ্ণূ মন্দির” (পৃথিবীর সব চেয়ে বড়ো বিষ্ণু মন্দির) তৈরী করেছিলেন রাজা সুর্য্যবর্মন। তার চতুর্থ পুরুষ রাজা যশো বর্মন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে ৫২ টি বিষ্ণু মুর্তির মাথা কেটে তার ওপরে গৌতম বুদ্ধের মাথা বসিয়ে দেন। এখন সেটাই দেখা যায়।
যিনি যখন শাসক হয়েছেন তিনি তখন তার নিজ ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভারতে যতো বিভিন্ন ধর্মীয় শাসক শাসন করেছেন এই পৃথিবীতে অন্য কোনো দেশে ততো রকম বিভিন্ন ধর্মীয় শাসক শাসন করেননি। সম্রাট অশোক দিয়ে শুরু।
বৌদ্ধ ধর্ম তবু এই দেশ থেকেই শুরু হয়েছিলো। তাই ধর্মীয় পার্থক্য থাকলেও ( বৌদ্ধ ধর্ম ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না) অন্য সব একই ছিলো। তাই বৌদ্ধ ভারত আবার হিন্দু ভারত হতে পেরেছিলো।
গোল বাধলো, হিন্দু ভারতের শাসন ক্ষমতা যখন চলে গেলো আরবী / তুর্কী জেহাদীদের হাতে। ১০০০ বছর আগে ৭১২ সালে হিন্দু ভারত আরবী ভারত হতে শুরু করে। ভাষা, খাদ্যাভাস, পোশাক, জীবন যাত্রা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস, ভাবনা, উপাসনা পদ্ধতি সব আলাদা শুধুই নয় একেবারে উলটো। হিন্দুরা নিজ দেশেই ‘বিধর্মী, কাফের, মালায়ুন’ কতো কি শুরু হয়ে গেলো। শাসক সর্বোতোভাবে ভিন্ন তার প্রজাদের থেকে। কি করে চলে ? সুতরাং নানা ফন্দি ফিকির করো, অত্যাচার চালাও, রাজ কর্মী হতে গেলে ধর্ম পাল্টালে সুবিধা, বাচতে হলে ধর্ম পাল্টালে বেচে যাওয়া যাবে। না হলে মরতে হবে, কাজ কর্ম পাওয়া যাবে না, অথবা কর দাও। সেই করের নাম জিজিয়া কর। হিন্দু ধর্ম পালন করতে হিন্দুদের দেশেই তাদের “ট্যাক্স” দিতে হবে। এই প্রথা দুনিয়ার কোথাও কেউ শুনেছেন ? তা , যাদের অর্থ আছে তারা তো সেই কর দিলো, যাদের নেই বা কম আছে তারা কি করবে? সুতরাং উপায়ান্তর না দেখে দল বেধে দলে দলে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে শাসকদের ধর্ম নিলো। ( ইরাকের মসুল শহরে সম্প্রতি সন্তারসীদের হাত থেকে বাচতে একদনে ১৫০০০ খ্রীষ্টান ধর্ম পাল্টেছে।) প্রকৃত পক্ষে ধর্ম পালটে হাফ ছেড়ে বাচলো।
ভাগ্যিস ‘এক বাংলা’ কে দুভাগ করে পশ্চিম বংগ নামে একটি রাজ্য করা হয়েছিলো, নইলে পুর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি হিন্দুরা কি করতো, কোথায় যেতো জানি না।
ব্রাহ্মনদের অত্যাচারে সব নিম্ন শ্রেনীর (নিম্ন শ্রেনী বা নিম্ন জাতি এই কথাটাই সব বিদেশী শাসকদের তৈরী। হ্যা, হিন্দু সমাজে শ্রেনী অবশ্যই ছিলো-সেটা আসলে গরীব এবং অর্থবান) হিন্দু ধর্ম পরিবর্তন করলো সেটাও এই বিদেশী শাসক শ্রেনীর তৈরী।
বৈদিক ব্রাহ্মন শাসন করতো না। শাসকদের ধর্মীয় রাস্তায় থাকতে উপদেশ দিতো, রাজর্ষি হতে উপদেশ দিতো। বিদ্যালয়, গুরুকুল তৈরী করে প্রকৃত শিক্ষার ব্যাবস্থা করতো, ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষা দিতো। সেই সব শিক্ষাবিদরা তাদের গুরুকুল, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় সব ধংস হতে দেখলেন। রাজারা তাদের রক্ষা করতে পারলো না। সমাজে ধারক এবং বাহকেরা যেখানে দিশাহারা, সেখানে গরীব হিন্দুরা কি করবে ? আগে তো প্রান বাচুক তার পর ধর্ম দেখবো। এখন যে ৮০ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশে পড়ে আছে, এদের ক’জন আর বেশী দিন হিন্দু থাকতে পারবে ????
শ্রী রাম চন্দ্র, শ্রী কৃষ্ণ ব্রাহ্মন ছিলেন না। যাদব রা কোনোদিন ব্রাহ্মন ছিলেন না। যার হাতে বা যাদের হাতে ক্ষমতা নেই তারা কোনোদিন অত্যাচার করতে পারে না। শাসন ক্ষমতা হিন্দু রাজাদের হাতে ছিলো। তারা প্রায় সবাই ক্ষত্রিয় ছিলো। সমাজের অনুশাসন সবাইকে মানতে হয়। কালাপাহাড় এক মুসলমান মহিলাকে বিয়ে করার অনুমতি পায়নি বলেই তো ধর্ম পরিবর্তন করেছিলো। তা সেটা তো আজো হচ্ছে। হিন্দু ধর্মে সব শ্রেনীর মানুষের ই ব্রাহ্মনত্ব পাওয়ার অধিকার আছে। যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনিই ব্রাহ্মন। যে ব্যাক্তি ব্রাহ্মন বংশে জন্মে মাংস বিক্রেতা হন তাকে “চন্ডাল ব্রাহ্মন’ বলা হতো।
হিন্দুদের ধর্ম পরিবর্তন শুরু হয় ১০০০ বছর আগে। “কালাপাহাড়” যে ৫ হাজারী মনসবদার হয়ে হিন্দু মন্দির ধংস করার ব্রত নিয়েছিলো, সে একজন ব্রাহ্মন বংশীয় বাঙ্গালী ছিলো। মুসলমান শাসনের অত্যচারে, রাজ শক্তির আশ্রয় নিতেই সমাজের গরীব শ্রেনী ধর্ম পরিবর্তন করেছিলো। “জিজিয়া কর” দিতে না পেরে গরীব রা দলে দলে মুসলমান হয়ে ছিলো। হিন্দুদের ধর্ম পালন করতে কর দিতে হতো। সেটাই অনেকে দিতে পারতো না। তার মুসলমান না হওয়া ছাড়া কি উপায় ছিলো???