“হিন্দু ধর্মে ‘প্রতীক’এর ব্যবহার”- এবং হিন্দুদের নামে গালাগালি।

“হিন্দু ধর্মে ‘প্রতীক’এর ব্যবহার”- এবং হিন্দুদের  নামে গালাগালি
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ

আজকের হিন্দুরা ‘সনাতনী’, সনাতন দর্শনে বিশ্বাসী। এই দর্শন কোনো এক ব্যাক্তির চিন্তা ভাবনার ফসল নয়। অনেক হাজার বছর ধরে অনেক জ্ঞানী চিন্তা বিদের নানা চিন্তা ভাবনা, যুক্তি তর্ক বিতর্ক-সিদ্ধান্তের ফসল। এই ফসলকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা বা সেই সিদ্ধান্ত গুলো ভুল প্রমানিত করার অপচেষ্টা চলছে নানা ভাবে এবং নানা ব্যাক্তি,সংঘটনের দ্বারা। মরুভুমির দেশ থেকে উদ্ভুত দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ক্যমুনিষ্ট নাম ধারী এক অধার্মিক সম্প্রদায় বর্তমানে এর মুখ্য ভুমিকায়।

সনাতনীদের বিরুদ্ধে এই সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধ বেশ সময় ধরেই চলছে। তার কারন একটাই, সারা পৃথিবীতে ওদের সার্বিক ও নিরংকুশ প্রভাব বিস্তার করা এবং যার মুল উদ্দেশ্য আর্থ-রাজনৈতিক। এই সনাতনী চিন্তা ভাবনার বিরোধী পক্ষ যে যুক্তি খাড়া করে তার বেশীর ভাগ তাদের অজ্ঞানতা প্রসুত। ওদের অনেক যুক্তির একটা হলো “হিন্দুরা মুর্তি পুজো করে, গরু, গাছপালা, পাথর এমনকি হাতি ,ঈদুর অবধি। এর সংগে আছে শ্রী কৃষ্ণ, শ্রী রাম, মা কালী, মা দুর্গা, মা সরস্বতী, শিব লিংগ ইত্যাদি নিয়ে আশ্লীল, কুরুচিকর, কুৎসিত সব বর্ননা।

যাক, ওই সব কর্ম ওদের দল ভারী করার কৌশল, ওরা তো করবেই। নিজেদের মধ্যে সারবত্তা না থাকলে অপরের নিন্দা তো  করতেই হবে। একজনকে ছোট বানিয়ে ছাড়া নিজেকে বড়ো বানানোর মতো কোনো গুন ওদের নেই । ওদের কাছে একটি মাত্র মানুষ যা বলে গেছে তাই শেষ কথা, আর তার কথা যতোই অযৌক্তিক হোক সেটাই ধ্রুব সত্য। এদের মস্তিষ্কে বহুত্ববাদের সংজ্ঞা  কখনো ঢুকেবে না।

এরা মুখে বলবে, কোনো মুর্তি বা প্রতীকের ভক্ত হওয়া চলবে না, তাহলে মাথা কেটে ফেলা হবে। সেই কাজ তারা করছেও। এককালে স্পেন থেকে গিয়ে ‘রোমান ক্যাথলিক’ সারা দক্ষিন আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকার (পেরুর ইঙ্কা এবং মেক্সিকোর মায়া সভ্যতার কথা মনে করুন) সমস্ত প্রাচীন সভ্যতা ধংস করে দিয়েছে। রোমান ক্যাথলিকদের রক্ত পিপাসা একটু কম হয়ে যাবার পর সেই গুরু দ্বায়িত্ব নিয়ে নিলো আর এক “আব্রাহামিক ধর্ম”। তাদের নবী বললেন, সব পৌত্তলিকতা শেষ করে দাও। সব প্রতীক ধংস করো। কিন্তু, যে কোনো চার্চে যান ,কি দেখতে পাবেন? যিশুর মুর্তি। সেখানে যিশুর মুর্তির সামনেই তারা মাথা অবনত করে চলেছে আজ ২০১৮ বছর ধরে। ‘শান্তির ধর্মের’ দুতেরা জীবনে  অন্তত একবার কাবাতে যাবে এবং কোন প্রতীকের চারিদিকে ৭ বার প্রদক্ষিন করে ??? কেনো করে ??? ওই কালো পাথর কি এবং কবে এলো সেই প্রশ্ন না করেও প্রশ্ন থেকে যায়। কালো পাথরটা কি কোনো প্রতীক নয় ??????

                  হিন্দু ধর্মে প্রতীকের ব্যাবহার আছে। কেনো ?? নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করা কি সহজ ?? হিন্দুদের মধ্যে যারা অল্প শিক্ষিত, অল্প করে ভাবতে পারে কিন্তু ধর্ম পালন করতে চায় তারা কি করবে?? ‘যিনি বাক্য ও মনের অতীত’ (অবাঙমনসাগোচর) , যিনি ইন্দ্রিয়াতিত, চক্ষু,কর্ন,নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক কোনো কিছু দিয়েই যার সন্ধান পাওয়া যায় না, যাকে জানা যায় একমাত্র ধ্যাননেত্রে তাকে কি করে একজন সাধারন মানুষ ভক্তি বা পুজা করবে ?????

জ্ঞানের দেবীকে তো চাই, ভক্তি করার মতো উজ্জ্বল এবং অপৌরষেয় আদর্শ চাই। এই মহাবিশ্বকে যে মহামায়া শক্তি রুপে ধরে রেখেছেন তাকে কি করে ভক্তি করবে সাধারন বুদ্ধির মানুষ ????? গাছ এবং অন্যান্য উদ্ভিদ আমাদের জীবন ধারনের জন্য অক্সিজেন যোগায়, সে গাছকে কাটা উচিত নয় এই সত্য টা কি করে বোঝাবো যার জীবিকা কাঠ থেকে আসে ? এই রকম হাজারো প্রকৃতিক শক্তি আছে যা আমাদের জীবন ধারন বা এই পৃথিবীতে আমাদের প্রতিপালনের জন্য অতি আবশ্যিক, সেই কথা কি করে বোঝাবো যে মানুষটা কোনোদিন কোনো শিক্ষা লাভ করেনি, যার জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি? সবাই তো ‘দ্বৈত, অদ্বৈত, ব্রহ্ম ইত্যাদি বোঝে না। তাহলে তো সবাইকে স্বামী বিবেকানন্দ বা শংকরাচার্য হতে হয়। তারা ক্ষনজন্মা পুরুষ। ক্ষন জন্মা পুরুষ প্রতি ক্ষনে জন্মায় না।

হিন্দু আচার্য্যরা এই বাস্তবটা জানতেন বুঝতেন। তাই স্রষ্টা এবং সৃষ্টির তত্বগত দিকটাকে নানা প্রতীকের দ্বারা সাধারন মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন। আদর্শ পুরুষ শ্রী রামচন্দ্র, শ্রী কৃষ্ণকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন পুরুষোত্মম, ঈশ্বরের অবতার হিসাবে। যিশু যদি ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে বিবেচিত হন, নবী যদি ঈশ্বর (আল্লার) প্রেরিত দুত হতে পারেন তাহলে এই সব মহাপুরুষদের নিয়ে এতো গালাগাল কেনো ?????

হিন্দুদের দেব দেবী এক একটি প্রতীক। এ ছাড়া আরো যে তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা শুনি, তারা কোন না কোন ভাবে প্রানীর সৃষ্টি এবং স্রষ্টার কথা বলে। যাদের শোনার কান নেই, দেখার চোখ নেই, স্পর্শ করার অনুভুতি নেই তারা কোনোদিন এর হদিশ পাবে না। তারা নিজেরা মা সরস্বতীর স্তন দেখে যৌন উত্তেজনা অনুভব করবে, মা কালীর প্রতীক দেখে হিন্দুদের অর্বাচীন বলবে। তাদের এক পন্ডিত মহাদেবের প্রতীকের ওপরে কন্ডোম পরাবে এবং কবিতা লিখবে, তাদের অঙ্কন শিল্পী হিন্দুদের সব দেবীর নগ্ন ছবি একে রাশি রাশি অর্থ উপার্জন করবে, তাদের ‘জেহাদী’ দস্যুরা দিকে দিকে সব মন্দির ধংস করবে।    
হিন্দুরা জানে এবং বিশ্বাস করে ঈশ্বর সর্ব ভুতে বিরাজমান। “সর্বম খল্লিদং ব্রহ্ম”। তিনি ছিলেন এক কিন্তু সৃষ্টির কারনে তিনি বহু হয়েছেন। তারা জানে ‘যাহা যাহা নেত্র পড়ে তাহা তাহা কৃষ্ণ স্ফুরে”। যেখানেই সৃষ্টি, সেখানেই সেই রুপেই ঈশ্বর বর্তমান। হিন্দুরা সেই বহুত্বের সাধনা করে। তারা ঈশ্বরকে শুধু একটি মানুষের কথা বা লিখে রাখা সম্পুর্ন নিজস্ব ভাবনা চিন্তায় বেঁধে রাখে না। ঈশ্বরকে তারা একটি সমগ্র হিসাবে জেনেও  নানা রুপে, নানা ভাবে ভক্তি করে। উগ্র ভাবনা, দল তৈরী করার এবং সেই দল নিয়ে দেশ দখল করার কৌশলী চিন্তা ভাবনা থেকে সনাতনী দর্শনের উত্তরসুরীদের ( হিন্দু নাম ধারী গরু খোর এবং কন্ডোম কবিদের বাদ দিয়ে) এই প্রতিকী উপাসনা বুদ্ধিতে আনা যাবে না, ধারে কাছে পৌছানোও যাবে না।