দেশভাগে কোলকাতা পাকিস্তানে না আসায় বঙ্গবন্ধু দুঃখ পেয়েছিলেন এবং এর জন্য সে সময়ের সিনিয়র মুসলমান নেতাদের দায়ী করেছিলেন। মাওলান ভাসানী সব সময় বলতেন, আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবেনা’। দাবী যৌক্তিক না অযৌক্তিক সেই বিতর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই নেতাদের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশভাগ হলে এইসব অঞ্চলের হিন্দুদের পরিণতি কি হবে সেকথা কখনই খোলসা করে বলেননি। যেহেতু তারা প্রত্যেকেই ‘মুসলমানদের আলাদা দেশের’ কথা বলতেন, লাহোর প্রস্তব অনুযায়ী দেশ ভাগ চাইতেন, তাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন চলে আসে, আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের মানচিত্রে অমুসলিমদের ভাগ্য কি হবে? যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতেই দেশভাগের কথা উঠেছে। গোটা পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দুদের এখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে ঠাই মিলেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তাই যৌক্তিকভাবে বলা যায় ভাসানীর মন মত দেশভাগ হলে আজকে বাঙালী হিন্দুরা দেশ থেকে বিতারিত হয়ে বাংলার বাইরে ভারতের অন্য কোন প্রদেশে শরণার্থী হিসেবে তাদের আশ্রয় মিলত! বিহারীদের মত বাঙালী হিন্দুরাও হতো দেশহীন এক হতভাগ্য জাতি…।
ভাসানী মাটি চেয়েছিলেন নাকি মানুষ চেয়েছিলেন ইতিহাসের এই প্রশ্নটা অমিমাংসিত থেকেই গেছে। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবর রহমান পশ্চিমবঙ্গকে না পেয়ে যে আক্ষেপ তা কি কেবলই মাটির জন্য? কারণ তিনিও মুসলমানদের জন্য পৃথক দেশের জন্য সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের জন্য জান দিয়ে লড়ছিলেন। তাঁর স্বহস্তে লিখিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এক নতুন মুজিবকে আমাদের সামনে এনে দাঁড় করায়। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেয়া মুজিব হিন্দু মহাসভার সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে মারামারি করতে গিয়ে তার মধ্যে হিন্দুদের প্রতি তীব্র অভিযোগ দানা বাধতে থাকে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১২)। কেমন করে ইংরেজ রাজ মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল… এসব ভেবে তিনি মুসলমানদের জন্য পাকিস্তানের কোন বিকল্প নেই বলেই বিশ্বাস করতেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২২-২৩)। বাঙালি মুজাহিদরা, জেহাদে শরিক হয়েছিল, ভীষণভাবে হিন্দু বেণিয়া, জমিদারদেরকে আক্রমন করতে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২৩)।
দেশভাগের জন্য দায়ী কে- কংগ্রেস নাকি মুসলিম লীগ, জিন্না নাকি গান্ধি, হিন্দুরা নাকি মুসলমানরা- সেই তর্কের চেয়ে সহজ হচ্ছে বাঙালী মুসলমানরা বাংলা ভাগ হয়ে পাকিস্তানে যোগ দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্তের নয়া উত্থান ঘটেছে। বাঙালী হিন্দুদের যে অংশকে নিজেদের জন্য প্রতিদ্বন্দি মনে করত দেশভাগের মাধ্যমে তারা ওপার বাংলায়। হিন্দুদের যে অতি সামান্য অংশ তখনো পূর্ব পাকিস্তানে ছিলো তারা নিম্নবর্গ দরিদ্র। তারা কোনদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাঙালীদের ডিঙ্গিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতায় উচ্চ আসনে যেতে পারবে না। প্রশাসন, চাকরি, সাহিত্য, ব্যবসা কোথাও পাকিস্তানে হিন্দুরা মুসলমানদের সমকক্ষ হতে পারবে না। এইরকম একটা সুনিশ্চিত পরিজিশনে ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ সেক্যুলার’ নেতারা ঠিক কাদের জন্য নিজেদের সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষ করতে বাধ্য হয়েছিলেন?
ভাষা আন্দোলন ছিলো বাঙালী মুসলমানদের চাকরি বাকরি বাঁচানোর লড়াই। এটা মোটেই কোন প্রগতিশীল মুভমেন্ট ছিলো না। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালী মুসলমান পাকিস্তানে কলা বেচে খেতে হতো। ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ বাঙালী মুসলমানের ধর্মীয় রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান ছিলো না। মুসলমান পরিচয়ে পাকিস্তানে কোন দাবী আদায়ের বাস্তবতা ছিলো না। কারণ বাঙালী মুসলমানরা অন্যান্য পাঠান পাঞ্জাবী মুসলমানদের কাছে জাতিগতভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। যে কারণে ‘মুসলমানদের নিজেদের দেশে’ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের ‘বাঙালী’ হওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। নিজেদের আলাদা জাতিসত্ত্বা তুলে ধরার মধ্যে মুসলমানিত্বে বাইরে যে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ছিলো তা পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালী মুসলমানদের কাছেই ছিলো দৃষ্টাব্দ। পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সোভিয়েত ঘেষা সেক্যুলারিজম সমাজতন্ত্রি ক্ষুদ্র একটা ধারা ছিলো যার পুরোটাই বুদ্ধিভিত্তিক অরাজনৈতিক। তাই বাংলাদেশের সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষ হবার কোন তাগিদ কোনদিনই ছিলো না। দেশ স্বাধীন হবার পর ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের’ প্রয়োজনও ফুরিয়ে ছিলো। মুক্তিযুদ্ধে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যের কৃতজ্ঞতায়, তাজউদ্দিন এবং তরুণ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবে ৭২ সালের সংবিধানে সমাজতন্ত্র সেক্যুলারিজ কিছু সময় পর্যন্ত থাকলেও বাংলাদেশ ফিরে যায় তার আদি রূপে। বাংলাদেশ আছে বাংলাদেশের নিজের পথেই…।
শুধীপ্ত পাঠক।