নুহাশ এর বিজ্ঞাপনচিত্র পাহাড়কে নিয়ে ইসলামপন্থি চরমপন্থিদের যে পরিকল্পনা- এই বিজ্ঞাপনচিত্রে সে আকুতি খুব স্পষ্ট।

হুমায়ূন আহমদে জীবনে এমন কিছু লিখেননি যাতে তার পুত্র-কন্যারা আলোকিত হতে পারত। হুমায়ূন আহমেদের কোন শত্রু ছিলো না। জামাতী, লীগার, বিএনপি… এমনকি চরমোনাই পীরের পার্টির সমর্থকদের দেখেছি হুমায়ূন আহমেদের নাটকের অনুরাগী। হুমায়ূন আহমেদ প্রথম ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের ঘৃণ্য ভূমিকার বিপরীতে তাদের ইমেজ উদ্ধারে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে মহান সব চরিত্র করে তুলেছিলেন। তিনি রাজাকারদের পরিস্থিতির শিকার দেখিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন। তার পুত্র নুহাশ যে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছেন সেটি একদিক দিয়ে নিখাঁদ, কারণ হুমায়ূন আহমেদ চিরকাল স্ববিরোধীতায় ভুগতেন। তিনি একটা সময় পর্যন্ত আস্তিকতায় নাস্তিকতায় দুলেছেন। তার মুসলমান মনটি তার প্রগতিশীল মনটিকে শেষতক পরাজিত করতে পেরেছিলো। নুহাশ সেরকম কোন দোদুল্যমান দেখায়নি। সোজাসুজি তার মন আজানের শব্দ শুনতে না পেয়ে আক্ষেপ করেছে। পাহাড়ে আজানের শব্দ মাইকে শোনা যায় না- এটাই তার বিজ্ঞাপন চিত্রের মূল ফোকাস। পাহাড়ে মসজিদ আর মাইক দিয়ে ভরিয়ে ফেলো। পাহাড়কে মুসলমান বানাও। নুহাশ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মানসিক অসুস্থতা দেখবার মত। সাজেকে বেড়াতে গিয়ে তার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে তাদের মনে হয়েছিলো- এখানে আজানের শব্দের কমতি আছে! স্কিপ্ট রাইটার একটা চরিত্র বেছে নিলো, পাহাড়ী আদিবাসী একটা ‘নওমুসলিম কিশোর’! যে আজানের অভাবে লোকজনকে দৌড়ে দৌড়ে ইফতার আর সেহরির খবর পৌছে দেয়। একটা ‘হিন্দু বাড়িতে’ ভুল করে সেহরির ডাক দিয়ে সে ধমক খায়। হিন্দু লোকটা খেকিয়ে উঠে বলে- ঐ আমি তো হিন্দু! তখন নওমুসলিম পাহাড়ী কিশোর অনুতপ্ত হয়ে বলে, ওহ ‘ভুল বাসায়’ এসে গেছি…। মাগরিবের আজানের সময় হলে পাহাড়ী নওমুসলিম কিশোরটি নামাজ পড়তে দাঁড়ায়…। পাহাড়কে নিয়ে ইসলামপন্থি চরমপন্থিদের যে পরিকল্পনা- এই বিজ্ঞাপনচিত্রে সে আকুতি খুব স্পষ্ট। বিজ্ঞাপন নির্মাতারা দাবী করেছে এই বিজ্ঞাপনচিত্রের মাধ্যমে তারা ধর্মীয় সম্প্রতি তুলে ধরেছেন! বিজ্ঞাপনচিত্রের কনসেপ্ট দিয়েছেন তুরাস আইমান যিনি বিবিসিকে বলেছেন, ধর্মীয় সম্প্রীতির চিত্র তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই বিজ্ঞাপনটি তৈরি করা হয়েছে এবং এর পেছনে তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

এর নাম ধর্মীয় সম্প্রীতি? একটা পাহাড়ী নওমুসলিম চরিত্র তৈরি করেছে যে পাহাড়ে মসজিদ ও মাইকের অভাবে আজানের শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছায় না বিধায় দৌড়ে দৌড়ে আজানের সময় পৌঁছে দেয়। এখানে সম্প্রীতি কোথায়? সারাদেশে মসজিদের মাইকে আজানের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে গেলোও পাহাড়ে নয় কেন? এটা কিসের ইংঙ্গিত দিচ্ছে নির্মাতারা? আরো বেশি করে মুসলমান সেটেলারদের পাহাড়ে ভরে দাও। মসজিদ মাদ্রাসার পরিমাণ বাড়িয়ে দাও। আজানের শব্দ তখন আর কমতি থাকবে না। এসবের নাম সম্প্রীতি? এমন তো না বিজ্ঞাপনে অমুসলিম পাহাড়ী কোন কিশোরের চরিত্র দেখানো হয়েছে যে মুসলমানদের আজানের সময় জানিয়ে দিচ্ছে। একটা হিন্দু চরিত্র দেখানো হয়েছে নেগেটিভভাবে। খেকিয়ে উঠছে হিন্দু লোকটা- ঐ আমি তো হিন্দু!… চরমভাবে মানুষের মাঝে মুসলিম আবেগ জাগিয়ে দাবী করা হচ্ছে ধর্মীয় সম্প্রীতি দেখানো হয়েছে! স্কিপ্ট কনসেপ্ট দাতা আইমান আরো দাবী করেন, ‘বাংলাদেশের পাহাড়ে গিয়ে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে যে হৃদ্যতার সম্পর্ক আমাদের চোখে পড়েছে, সেটি তুলে ধরাই ছিল বিজ্ঞাপনটির মূল উদ্দেশ্য। এখানে কোনো গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা ধর্মের ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে খাটো করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না’।

কত বড় মিথ্যুক! পাহাড়ের এতগুলি বছরের ইতিহাসকে এক লহমায় বিকৃত করে ফেলল! বছরের পর বছর পাহাড়ে সেনাশাসন, কারফিউ, সেটেলার বাঙালীদের কাছে জিন্মি হয়ে থাকা, প্রশাসন থেকে বিমাতা সুলভ আচরণ যে পাহাড়ীদের সশস্ত্র লড়াইয়ে বাধ্য করেছিলো সেই ইতিহাসকে চাপা দেয়ার দু:শাহস দেখিয়েছে তারা। সাজেক ভ্যালির বাংলোতে এইসব ধনীর দুলালরা রাত্রিযাপন করতে গিয়ে সাজেকের প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে ভূমিহারানো মানুষের কান্না তারা শুনতে পায়নি। এরা মুসলমান। এরা এখানে মসজিদ মাদ্রাসা দেখতে পেলে খুশি হবে। মাইকে আজানের হট্টগোলে এরা মুগ্ধ হবে। একটা প্রজন্ম যখন এতখানি ডানপন্থি হয়ে উঠে তখন সেই দেশের আগামীর চিন্তা করলে দু:খ করা ছাড়া কি-ই বা করার থাকে।