স্মৃতি
মানে উত্তম-সুচিত্রা নয়, মান্না-পিকে-চুনির ছবি নয়, ‘স্বর্ণযুগ’ নিয়ে
দীর্ঘশ্বাস নয়। অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষণ, এই দুইয়ের যোগফলই স্মৃতি। বাচ্চা
বয়সে মোমবাতির শিখায় হাত দিয়ে ছ্যাঁকা খেলাম। তার পর থেকে মস্তিষ্ক শিখে
গেল। মোম দেখলেই বার্তা পাঠাল, আগুনে হাত দিও না। এই শেখা না থাকলে স্মৃতি
অর্থহীন। আগামী ৫ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে এই নিয়েই
বক্তৃতা দিচ্ছেন বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল
সায়েন্সেস-এর বিজ্ঞানী সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়। কানপুর আইআইটির
পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায় কাজ করেন নিউরোবায়োলজি
নিয়ে।
দুই স্নায়ুর সংযোগস্থল বা ‘সাইন্যাপস’-এ তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষমতা
কী ভাবে বাড়ানো যায় সেটিই তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু।
‘একটু
বুঝিয়ে দিন।’ সুমন্ত্রবাবু বললেন, স্নায়ু একের পর এক অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কে
জমা রাখে। এ বার বিপদ বা আনন্দের ইঙ্গিত পেলেই স্নায়ু কী করে? আগের
অভিজ্ঞতা থেকে যা শিখেছিল, সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়। “স্মৃতি শুধু অতীত
নয়, ভবিষ্যতের জন্যও ব্যবস্থা নিতে উদ্দীপ্ত করে।”
স্মৃতি জানাচ্ছে, ১১২ বছর আগে প্রায় এ রকমই ঘটনা ঘটেছিল। ১৯০১ সালের ১০ মে
রয়্যাল সোসাইটিতে এক বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানীর বক্তৃতার বিষয়বস্তু: জীবনের
প্রাণস্পন্দন। তাঁর সামনে সদ্য-আবিষ্কৃত এক যন্ত্র। নাম ক্রেস্কোগ্রাফ।
পাশে বিষাক্ত দ্রবণে ডোবানো লজ্জাবতী চারা। দু’টিকে জুড়ে দেওয়া হল।
পর্দায় ‘পাল্স রেট’-এর মতো আঁকাবাঁকা দাগ। গাছেরও নাড়ি আছে? আছে প্রাণ?
ব্রোমাইড দ্রবণ যত ভরপুর হচ্ছে, পর্দায় তত দ্রুতগতিতে এলোপাথাড়ি দাগ, এক
সময় থেমে গেল সব কিছু। বিষে মারা গিয়েছে লজ্জাবতী।
অতঃপর তুমুল হইচই। কেউ বললেন, ঘটনাটি অর্থহীন। কেউ বাঁকা হাসলেন,
পদার্থবিজ্ঞানের লোক জীবনবিজ্ঞানে অনধিকারচর্চা করলে এই রকম উদ্ভট তত্ত্বই
তৈরি হয়! আগামী বৃহস্পতিবার সেই সব বক্রোক্তি অনুপস্থিত। বাঘা বাঘা
নোবেলজয়ী নিউরোবায়োলজিস্টদের উপস্থিতিতে রয়্যাল সোসাইটির অধিবেশন, ভারত
থেকে এক এবং একমাত্র আমন্ত্রিত বক্তা সুমন্ত্রবাবু। জগদীশচন্দ্রের পর টেম্স
বেয়ে বহু জল গড়িয়েছে। মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু রয়্যাল সোসাইটির
ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন, অশোক সেন পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন।
কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান থেকে জীবনবিজ্ঞানে গবেষণার পথ-বদলানো এক বাঙালি
বিজ্ঞানীকে রয়্যাল সোসাইটির বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো, এখানেই মধুর
প্রতিশোধ!
আসন্ন অধিবেশনের উপলক্ষ: ‘লং টার্ম পোটেনসিয়েশন’-এর ৪০ বছর পূর্তি।
মস্তিষ্ক একটা স্নায়ু থেকে আর একটা স্নায়ুতে ক্রমাগত তথ্য পাঠায়। ১৯৭৩
সালে দুই বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছিলেন, স্নায়ুগুলির তথ্য আদানপ্রদানের শক্তি
বাড়ানো, কমানো যায়। এটাই ‘লং টার্ম পোটেনসিয়েশন’। সলমন বা শাহরুখ খান
যেমন পেশিকে ক্রমাগত খাটিয়ে সিক্স প্যাক বডি তৈরি করে নেন, স্নায়ুরাও সেই
রকম!
এই স্নায়বিক শক্তি বাড়া-কমা রোজকার জীবনে চেনা। অফিসটাইমে হাঁটতে হাঁটতে
ভিড়ে ঠাসা চৌরঙ্গি পেরোই, মস্তিষ্ক হরেক মুখ দেখে। কিন্তু খেয়াল করে না।
অথচ, দূর থেকে পুরনো বন্ধুকে দেখলেই চেঁচিয়ে উঠি, ‘এই হরি, দাঁড়া!’ দিন
কয়েক পরে আমার যদি সেরিব্রাল অ্যাটাক বা অ্যালঝাইমার্স হয়? হরি সামনে এসে
দাঁড়ালেও ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকব, চিনতে পারব না। স্মৃতি, স্নায়বিক
শক্তি শুকিয়ে গিয়েছে।
গত দেড় দশক ধরে সুমন্ত্রবাবু এই স্মৃতি নিয়েই কাজ করছেন। স্মৃতি কোথায়,
কী ভাবে তৈরি হয় পঞ্চাশের দশকেই জানা হয়ে গিয়েছিল। মস্তিষ্কের দু’পাশে
টেম্পোরাল লোবে কাজুবাদামের মতো হিপোক্যাম্পাস, সেখানকার স্নায়ুকোষ
অভিজ্ঞতা মনে রাখে। তৈরি হয় স্মৃতি। কিন্তু প্রশ্ন উঠল, অসুস্থ মানুষ
হয়তো মনে করতে পারেন না এক ঘণ্টা আগে খেয়েছেন কি না! কিন্তু তাঁর কি থাকে
না রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, অভিমান? গবেষণায় দেখা গেল, হিপোক্যাম্পাসে থাকে
তথ্যমূলক স্মৃতি। আর ‘অ্যামিগডালা’ অঞ্চলে আবেগের স্মৃতি। “স্ট্রেস-জনিত
কারণে কিছু স্নায়ুকোষ হয়তো হিপোক্যাম্পাসে তথ্য দেওয়ানেওয়ার ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলছে, কিন্তু
অ্যামিগডালাতে তাদের ক্ষমতা বাড়ছে। এ নিয়েই আমার কাজ,” বলছিলেন
সুমন্ত্রবাবু।
এই স্নায়বিক স্মৃতিচর্চা বাঙালিরই করার কথা ছিল। সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী
মনে করিয়ে দিলেন, মনোবিশ্লেষণে আসার আগে সিগমুন্ড ফ্রয়েডও নিউরোবায়োলজি
নিয়ে কাজ করতেন। এখানেই আর এক বাঙালির প্রবেশ। গিরীন্দ্রশেখর বসুর সঙ্গে
ভিয়েনাবাসী বিজ্ঞানীর বরাবরের হৃদ্যতা। নিউরোবায়োলজির সঙ্গে মনস্তত্ত্বের
ফারাকটাও পরিষ্কার করে দেন আশিসবাবু, “মস্তিষ্কের এই অংশ দেখাকে
নিয়ন্ত্রণ করে, এই অংশ শোনা সেটা নিউরোবায়োলজি ক্রমে পরিষ্কার করে
দিচ্ছে। কিন্তু সেটা দিয়েই মানুষকে বোঝা যায় না। কারও মস্তিষ্কে
শ্রবণঘটিত জায়গাটা হয়তো শক্তিশালী। কিন্তু একটি রাগ রবিশঙ্কর ভালো
বাজালেন না বিলায়েত খান, সেটা বুঝবে না সে।”
সূর্যের তাপে ভেঙে গেল আইসন | ||||
রূপ হারিয়েছে ধূমকেতু, আইসন। কিন্তু ‘মরে’ গিয়েছে কি না, তা নিয়েই চর্চায় ব্যস্ত বিজ্ঞানীরা। ব্যাপারটা কী? বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা বেজে ৭ মিনিটে সূর্যের সব থেকে কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় হারিয়ে গিয়েছিল আইসন। ধরে নেওয়া হয়েছিল, সূর্যের উত্তাপেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে আইসন। শুক্রবার রাতে আচমকাই বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণাগারে ধরা পড়ল, সূর্য থেকে কিছুটা দূরে জ্বলছে একটি গ্যাসীয় পিণ্ড। তা দেখে অনুমান, কেন্দ্রস্থল ভেঙে গেলেও পুরোপুরি বিনষ্ট হয়নি এই ধূমকেতু। ওই জ্বলন্ত পিণ্ডটা আইসনের অবশিষ্টাংশ বলে জানিয়েছেন নাসার বিজ্ঞানীরাও। ২০১২ সালে আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে এই ধূমকেতু নিয়ে বিজ্ঞানীদের নানা আশা ছিল। সূর্যের কাছে আসায় খালি চোখেই এর রূপ ধরা পড়বে বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। তবে আশঙ্কার কথাও বাদ দেননি বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলেছিলেন, সূর্যের খুব কাছ দিয়ে যাওয়ার ফলে উত্তাপে গলে যেতে পারে আইসনের কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি। সেটাই সত্যি হল! কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা, পজিশন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন বলছেন, “খালি চোখে আইসনের দেখা আর মিলবে না।”
|