সিলেটের স্কুলে সাত বীরশ্রেষ্ঠসহ রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ছবি মুছে দেয়ার নেপথ্যে ইসলামী কারণগুলো জেনে নেই…।

বিশ বছর আগে সিলেটে গিয়ে সিলেটীদের মাত্রারিক্ত ধর্মান্ধতার প্রমাণ পেয়েছিলাম। নাইট কোচে এসেছিলাম বলে সকালে ঘুমিয়ে ছিলাম। শুক্রবার ছিলো। হোটেল বয়রা এসে বার বার রুমের দরজায় কড়া নেড়ে জুম্মার নামাজ পড়ার তাগাদা দিচ্ছিল! এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে আমার কোথাও হয়নি। এখনকার পরিস্থিতি কেমন জানি না। তবে সিলেট বিশ বছর আগেই মোল্লা ছিলো। এ কারণেই আজকাল সিলেট সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে বার বার। আজ দেখলাম সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি স্কুলের দেয়াল থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। স্কুলের মাঠে জানাজা নামাজ পড়ানো হয়, তাই মানুষের ছবি আঁকা থাকলে সেখানে রহমতের ফেরেস্তা আসতে পারবে না। অথচ এইসব ইতরগুলোই পাসপোর্ট-ভিসাতে ছবি লাগিয়ে হজ করতে যায়! এদের কাছে ছবি জিনিসটাই হারাম অথচ গোটা কাবাঘর এলাকাটাই সিসি ক্যামেরাতে ছয়লাব…।

এ ধরণের যুক্তি দেখিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে অবশ্য উত্তরণের কোন পথ নেই। যেসব মডারেট মুসলমান ছবি আঁকা, গান গাওয়াকে হারাম মনে করে না দেখবেন এই সময়গুলোতে তারা মুখে কুলুপ এটে বসে আছে। এর কারণ ইসলাম ধর্মে খুব স্পষ্ট করে মানুষের সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত এ কারণেই ইসলামী ফান্ডামেন্টাল শাসনে আঘাতগ্রস্ত হয়। যেমন তালেবান, আইএস, বকো হারাম ইত্যাদি শাসিত স্থানে এসব শিল্পকর্ম নিষিদ্ধ। সারা পৃথিবীর মুসলমানদের কাছেই গান গাওয়া, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য বানানো, যন্ত্রসংগীত বাজানো নিয়ে স্পষ্ট ধর্মীয় অবস্থান আছে। তারা মনে করে এগুলো মুসলমানরা চর্চা করলেও ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। আসুন সিলেটের স্কুলে সাত বীরশ্রেষ্ঠসহ রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ছবি মুছে দেয়ার নেপথ্যে ইসলামী কারণগুলো জেনে নেই…।

কুরআনের বনী ইসরাঈল সুরায় বলা আছে, ‘এবং তাদের মধ্যে যাদেরকে পার পর্যায়ক্রমে বোকা বানাও তোমার গলার স্বরের সাহায্যে…’ (সূরা বনী ইসরাঈল, ৬৪)। এই আয়াত দ্বারা কি অর্থ বুঝানো হয়েছে তা ইবনে কাসিরের তাফসির থেকে জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘যে কোন আওয়াজ, যা আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহবান জানায়, তার সবই এই আয়াতে বর্ণিত আওয়াজের অন্তর্ভুক্ত (তফসীর ইবন কাসির, সুরা বনী ইসরাঈল)।

এছাড়া সুরা লোকমানে সরাসরি গান, কবিতা, সাহিত্য, শিল্পচর্চাকারীদের লাঞ্ছনা করা হবে বলে আল্লাহ হুংকার দিয়েছেন, ‘এবং মানুষের মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর পথ থেকে (মানুষকে) বিচ্যুত করার জন্য কোন জ্ঞান ছাড়াই অনর্থক কথাকে ক্রয় করে, এবং একে ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে, এদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি’ (সূরা লোকমান, ৬)। এ সম্পর্কে হাদিসে আরো আছে, রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী বস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলে জ্ঞান করবে’ (বুখারী)।

সিলেটের লোকজন জানাজার নামাজ পড়তে অসুবিধা হবার যে দাবী তুলেছেন তার নেপথ্যেও ইসলাম। হাদিস থেকে জানা যায়, ‘আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (র)…সাঈদ ইবনে আবুল হাসান (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনে আব্বাস (রা) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম, এমন সময়ে তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আবু আব্বাস! আমি এমন ব্যক্তি যে, আমার জীবিকা হস্তশিল্পে। আমি এসব ছবি তৈরি করি। ইবনে আব্বাস (রা) তাঁকে বলেন, (এ বিষয়) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি যা বলতে শুনেছি, তাই তোমাকে শোনাব। তাঁকে আমি বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি কোন ছবি তৈরি করে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে শাস্তি দিবেন, যতক্ষণ না সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে। আর তাতে সে কখনো প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে না’।(এ কথা শুনে) লোকটি ভীষণভাবে ভয় পেয়ে গেল এবং তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এতে ইবনে আব্বাস (রা) বললেন, আক্ষেপ তোমার জন্য, তুমি যদি এ কাজ না-ই ছাড়তে পার, তবে এ গাছপালা এবং যে সকল জিনিসে প্রাণ নেই, তা তৈরি করতে পার (সহী বুখারী, চতুর্থ খণ্ড, হাদিস নং ২০৮৪ –ইসলামী ফাউন্ডেশন)।

স্বয়ং নবী মুহাম্মদ শিল্পচর্চাতে রাগান্বিত হয়ে উঠতেন সেটা জানা যায় এই হাদিসটি থেকে। আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য প্রাণীর ছবিযুক্ত একটি বালিশ তৈরি করেছিলাম। যেন তা একটি ছোট গদী। এরপর তিনি আমার ঘরে এসে দু’দরজার মাঝখানে দাঁড়ালেন এবং তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমার কি অপরাধ হয়েছে? তিনি বললেন, এ বালিশটি কেন? আমি বললাম, এ বালিশটি আপনি এর উপর ঠেস দিয়ে বসতে পারেন আমি সে জন্য তৈরি করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (‘হে আয়িশা) (রা) তুমি কি জান না? যে ঘরে প্রাণীর ছবি থাকে, সেখানে (রহমতের) ফিরিশতা প্রবেশ করেন না? আর যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি আঁকে তাকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে? তাকে (আল্লাহ্) বলবেন, ‘তুমি যে প্রাণীর ছবি বানিয়েছ, এখন তাকে প্রাণ দান কর।’ (সহী বুখারী, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নং ২৯৯৭ – ইসলামী ফাউন্ডেশন)।

এর নাম ইসলাম ধর্ম। আফগানিস্থানে এ কারণেই কামান দেগে বুদ্ধমূর্তিগুলো গুড়িয়ে দিয়েছিলো তালেবানরা। আইএস সিরিয়ার জাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলেছিলো। বাংলাদেশের মাদ্রাসার ছাত্ররা লালন ভাস্কর্য, বকের ভাস্কর্য, জাস্টিসিয়াসহ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলোকে গুড়িয়ে দেয়…।
http://samakal.com/todays-print-edition/tp-sylhet-division/article/17123485/%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%AB%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%B9%E0%A6%B2%E0%A7%8B-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF