কুত্তার মত পিটানোর ইচ্ছাটা মোটেই নতুন কিছু নয়। ইচ্ছাটা ঐতিহাসিক। কেন সেটা আস্তে আস্তে বলি…।

কুত্তার মত পিটানোর ইচ্ছাটা মোটেই নতুন কিছু নয়। ইচ্ছাটা ঐতিহাসিক। কেন সেটা আস্তে আস্তে বলি…।

অবিভক্ত পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের একক প্রচেষ্টাতেই দেশভাগ সম্ভব হয়েছিল। হিন্দুদের বাংলাদেশ থেকে খেদাতে না পারলে মুসলমানদের কোন ভবিষ্যত নেই- এটাই ছিল পাকিস্তান করার মন্ত্র। তারপর হিন্দুরা যখন বাংলাদেশ মাত্র দশ ভাগ হতে বাধ্য হলো- তখন সেই পাকিস্তান আন্দোলনকারীরাই বাংলাদেশ সেক্যুলার ধর্ম নিরপেক্ষ হলো। এই সেক্যুলার সাজার মূলে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পাঠান-পাঞ্জাবীদের কাছে মুসলমান হয়েও বৈষম্যের শিকার হওয়া। পাকিস্তানের দু জায়গাতেই মুসলমান প্রধান। পূর্ব পাকিস্তানীরা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল পাঞ্জাবী-পাঠানীদের জ্যাতিভিমানের কারণে। এখান থেকেই ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের’ সূচনা। ‘আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যেতে চেয়েছি’ কিংবা ‘সাত কোটি বাঙালীরে দাবাই রাখতে পারবা না’- এই বাঙালী তো আসলে মুসলমানই।

এই সত্যগুলোর মুখোমুখি হবার সময় এসেছে। বাংলাদেশে কখনই সেক্যুলারিজম ছিল না। যারা নিজেদের সেই পরিচয় দিতেন তারাও বাঙালী জাতীয়তাবাদকেই সেক্যুলারিজম বলে জানতেন। পাকিস্তান আমলে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালী পরিচয়টি মুসলিম পরিচয়ের চেয়ে গুরুত্ব দেয়াটাই তাদের কাছে ছিল বিরাট একটা মুভমেন্ট। কিন্তু তাদের নিজেদের কাছেই দেশভাগ বিষয়ে কোন মিমাংসা ছিল না। দেশভাগের জন্য জিন্না-নেহেরু আর ইংরেজদের দায়ী করে ধরি মাছ না ছুই পানি গোছের অবস্থান তাদের হিপোক্রেট মানসিকতার পরিচয়। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের বছর রোজই ঢাকাতে কোথাও না কোথাও উত্তেজিত জনতা ‘ভারতের দালাল’ কাউকে গণপিটুনি দিচ্ছে দেশপ্রেমের তীব্র প্রতিক্রিয়ায়। ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ পাশ করে ৬৫ সালেই হিন্দুদের জায়গা জমি রাষ্ট্রীয়ভাবে দখল করে মুসলমানরা লিজ নিয়ে বেদখল করার উৎসবে মেতে উঠে। এই কালাকানুন ৭২ সালের সংবিধান কিংবা তখনকার সংসদও বাতিল করেনি। এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর বহু আগেই স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দুদের সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ দেখিয়ে দখলের মচ্ছব জারি ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের প্রায় সবাই পাকিস্তানের জন্য জান দিয়ে লড়েছেন প্রথম জীবনে। পরিণত বয়েসে এসে তারা কেউ অবিভক্ত বাংলার জন্য আফসোস করেননি। অর্থ্যাৎ হিন্দুদের তাড়ানোটা তাদের নিজেদের জন্য তখনো প্রয়োজনীয় ছিল বলেই মনে করতেন। আপনি যদি একবার মনে করেন ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত হবার সেই সময়ের ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল কিংবা দেশভাগ না হলে পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা নিজেদের উন্নত করতে পারত না- তাহলে আপনাকে তত্ত্ব হিসেবে সেক্যুলারিজমকে ছাড়তে হবে কারণ এটি আপনার কাছে অকার্যকর। পাকিস্তান করার পর যখন দেখলেন মুসলমান হবার পরও আপনার অবস্থা একই থেকে যাচ্ছে কারণ আপনি জাতিতে বাঙালী বলে। আর তাতেই আপনি বাঙালী পরিচয়ে লড়াই শুরু করলেন বলেই আপনি সেক্যুলারিজম ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে গেলেন না। ৭২ সালের সংবিধানে তাজ উদ্দিনদের মত সেক্যুলারদের ইচ্ছাই প্রকাশ পেয়েছিল। তাজউদ্দীনদের বলা হয় বামঘেষা রাজনৈতিক নেতা। ৭১ সালের গণহত্যার শিকার হওয়া বুদ্ধিজীবীরাই ছিলেন সেক্যুলারিজমের মূল পাওয়ার হাউস। এ কারণেই তাদের মরতে হয়েছিল। যেমনটা এসে আজকের সময়ে মরতে হচ্ছে। এখন তো পাকিস্তানীরা নেই। এখন যারা মারছে আর মারাটাকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে তাদের চোখে সবচেয়ে বড় শত্রুই নাস্তিক, সেক্যুলার, ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা। তাই ‘সনাতন পিটানোর’ ইচ্ছাটা ঐতিহাসিকভাবেই এসেছে। পাকিস্তানীরাও সেক্যুলারবাদীদের ‘হিন্দু কাফের’ মনে করত। বর্তমান বাংলাদেশ তাদের ‘সনাতন’ (ব্যক্তি নাম ধরছি না) মনে করে। মনে রাখবেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যেভাবে পিটিয়ে মেরেছে, সেই আক্রোশ আজো জারি আছি…।