পন্ডিত। সনাতন গোস্বামী, রূপ গোস্বামী, রঘুনাথ দাস, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ
ভট্ট ও জীব গোস্বামী এই ছয়জনকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ একত্রে ষড় গোস্বামী নামে
অভিহিত করেন। এঁরা কম-বেশি সকলেই চৈতন্যদেবের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছেন
এবং এঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়ই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের ভিত্তি সুদৃঢ়
হয়েছে।
সনাতন গোস্বামী (আনু. ১৪৬৫-১৫৫৫) ছিলেন
ন্যায়শাস্ত্রে সুপন্ডিত। তাঁর গার্হস্থ্য জীবনের নাম অমর। গৌড়ের
নিকটবর্তী রামকেলি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন
দক্ষিণ ভারতীয় কর্ণাট ব্রাহ্মণ। তিনি বাক্লা চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্গত
ফতেয়াবাদ, নবহট্ট বা নৈহাটী এবং মালদহ জেলার রামকেলি এই তিন জায়গায়
বসবাস করেন বলে জানা যায়। নৈয়ায়িক বাসুদেব সার্বভৌম
ও সহোদর মধুসূদন বিদ্যাবাচস্পতি ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। সনাতন সুলতান
হুসেন শাহের রাজদরবারে রাজস্বমন্ত্রী (সাকর মলিক) হিসেবে কাজ করতেন; তাই
আরবি ও ফারসি ভাষায়ও তিনি সুপন্ডিত ছিলেন বলে মনে করা হয়।
রাজকার্যে নিযুক্ত থাকলেও সনাতনের অন্তরে ছিল বৈরাগ্যভাব। চৈতন্যদেবের
বৃন্দাবন গমনকালে (সম্ভবত ১৫১৫ খ্রি) রামকেলিতে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর
তিনি চাকরি ত্যাগ করেন এবং অল্পকালের মধ্যে শ্রীচৈতন্যের অনুগামী হন। এ
সময় থেকেই তিনি সনাতন নামে পরিচিত হন।
চৈতন্যদেব
নীলাচলে যাওয়ার পথে কাশীতে দুমাস অবস্থান করেন। সেখানে তিনি সনাতনকে
বিভিন্ন তত্ত্বোপদেশ দেন এবং চারটি কার্যের আদেশ দেন: ১. ভক্তিগ্রন্থ
রচনা, ২. ভক্তি ও সদাচার প্রচার, ৩. লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার এবং ৪. শ্রীবিগ্রহ
সেবা প্রকাশ। এরপর থেকে সনাতন বৃন্দাবনে অবস্থান করেন এবং বৈষ্ণবধর্মকে
একটি তাত্ত্বিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সময় তিনি সংস্কৃত ভাষায় নানা
গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। সেগুলির মধ্যে বৃহৎ-ভাগবতামৃত, বৃহৎ-বৈষ্ণবতোষিণী
(শ্রীমদ্ভাগবতের টীকা), লীলাস্তব, হরিভক্তিবিলাস ও দিগ্দর্শনী (টীকা)
উল্লেখযোগ্য।
রূপ গোস্বামী (আনু. ১৪৭০-১৫৫৯) ছিলেন সনাতনের অনুজ।
রামকেলিতেই তাঁর জন্ম। তাঁর পিতৃদত্ত নাম সন্তোষ, কিন্তু চৈতন্যদেব প্রদত্ত
‘রূপ’ নামেই তিনি সর্বজনবিদিত। রূপও সুলতান হুসেন শাহের দরবারে চাকরি
করতেন। তিনি ছিলেন সুলতানের ‘দবির খাস’ (প্রধান সচিব)।
রূপ গোস্বামী বাল্যকাল থেকেই ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। চৈতন্যদেব যখন বৃন্দাবন
যাচ্ছিলেন তখন রূপ তাঁকে প্রয়াগে দর্শন করেন এবং তাঁর নিকট ভক্তিতত্ত্ব
সম্পর্কে শিক্ষালাভ করেন। মহাপ্রভুর নির্দেশে তিনি বৃন্দাবন গিয়ে
লুপ্ততীর্থ ও লুপ্ত গোবিন্দবিগ্রহ উদ্ধার করেন এবং কয়েকটি মূল্যবান
বৈষ্ণবগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: হংসদূত,
উদ্ধবসন্দেশ, বিদগ্ধমাধব, ললিতমাধব, দানকেলিকৌমুদী, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু,
উজ্জ্বলনীলমণি, নাটকচন্দ্রিকা, বিলাপকুসুমাঞ্জলি, উপদেশামৃত,
গোবিন্দবিরুদাবলী, অষ্টাদশলীলা, রাধাকৃষ্ণগণোদ্দেশ ইত্যাদি। ষড় গোস্বামীর
মধ্যে রূপ গোস্বামীর কবিত্বশক্তি ও পান্ডিত্য অধিক, কেননা তিনি যেসব
প্রামাণ্য বৈষ্ণবগ্রন্থ রচনা করেছেন সেসব শুধু সংখ্যা হিসেবেই নয়, কাব্য ও
রসবিচারেও উত্তম বলে বিবেচিত হয়। তিনি এসব গ্রন্থে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনের
কৃষ্ণতত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ভক্তিরসের বিশদ আলোচনা এবং মধুরভাবে
রাধাকৃষ্ণ-উপাসনা রীতির প্রবর্তন করেন।
রঘুনাথ দাস (আনু. ১৪৯০-১৫৭৭) সপ্তগ্রামের হরিপুর নামক
স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গৃহ-পুরোহিত বলরাম আচার্যের নিকট
শাস্ত্রাধ্যয়ন করেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে বৈরাগ্যের লক্ষণ প্রকাশ
পায়। তিনি হরিদাস ঠাকুরের ব্যক্তিত্ব ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সেবা করেন
এবং যবন হরিদাসের কৃপাভাজন হন। এসময় চৈতন্যদেবের নাম শুনে তিনি তাঁর চরণে
নিজেকে সমর্পণ করেন এবং একদিন গোপনে গৃহত্যাগ করে নীলাচলে তাঁর সঙ্গে
মিলিত হন। চৈতন্যদেব তাঁকে স্বরূপ দামোদরের তত্ত্বাবধানে অর্পণ করেন। এজন্য
রঘুনাথকে ‘স্বরূপের রঘু’ বলা হতো।
রঘুনাথ ষোলো বছর নীলাচলে ছিলেন। শ্রীচৈতন্য ও স্বরূপ দামোদরের তিরোধানের
পর তিনি বৃন্দাবনে রূপ-সনাতনের আশ্রয় গ্রহণ করেন। রঘুনাথ নীলাচল ও
বৃন্দাবনে নিত্য জীবনচর্যায় ও প্রসাদ গ্রহণে কঠোর নিয়ম পালন করতেন। তিনি
রাধাকুন্ড ও শ্যামকুন্ড উদ্ধার করেন এবং রাধাকুন্ড সংস্কার করে বাকি জীবন
সেখানেই অতিবাহিত করেন। শেষ জীবনে তিনি আহার-নিদ্রা বর্জনপূর্বক
রাধাকুন্ডের তীরে বসে সর্বদা রাধাকৃষ্ণ নাম জপ করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন।
তাঁর আচরণ ও ভজননিষ্ঠা গোস্বামীদের মধ্যেও অতি বিরল। রঘুনাথ দাস রচিত
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো: মুক্তাচরিত, স্তবাবলী, দানচরিত বা
শ্রীদানকেলিচিন্তামণি, মনঃশিক্ষা, সুরাবলী, শিক্ষাপটল, শ্রীনামচরিত
ইত্যাদি।
গোপাল ভট্ট (আনু. ১৫০০-১৫৮৫) দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী
ছিলেন। মুরারি গুপ্তের কড়চা থেকে জানা যায় যে, তাঁর বাল্যকালে চৈতন্যদেব
দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পথে তাঁদের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন। তখন চৈতন্যদেবের
প্রতি তাঁর ভক্তি দেখে পিতা ত্রিমলভট্ট (মতান্তরে বেঙ্কক ভট্ট) পুত্রকে
চৈতন্যের চরণে সমর্পণ করেন। চৈতন্যদেব তাঁকে আশীর্বাদ করেন এবং তাঁরই আদেশে
পিতামাতার সেবান্তে বৃন্দাবনে গিয়ে তিনি অন্যান্য গোস্বামীর সাক্ষাৎ লাভ
করেন। চৈতন্যদেব নীলাচল থেকে তাঁর জন্য নিজ কৌপীন ও একটি কাঠের আসন পাঠান।
বৃন্দাবনে ‘কাঠের পিড়া’ নামক সেই আসনটি রাধারমণ মন্দিরে এখনও পূজিত হয়।
এই মন্দিরের পেছনেই গোপালের সমাধি রয়েছে।
গোপাল সংস্কৃত ভাষা ও দর্শনে সুপন্ডিত ছিলেন। তিনি কৃষ্ণকর্ণামৃত নাটকের
শ্রীকৃষ্ণবল্লভা নামে একটি টীকা রচনা করেন। রূপ-সনাতনের মুখে তত্ত্ববিচার
শুনে তিনি সূত্রাকারে ষট্সন্দর্ভ গ্রন্থের একটি কারিকা লেখেন। তাঁর অপর
গ্রন্থ সৎক্রিয়াসারদীপিকায় বিবাহাদি চতুর্দশ সংস্কারের বিবরণ আছে। এতে
বিভিন্ন বেশ ও বিধির নির্দেশ আছে। সংস্কৃত সাহিত্য পরিষৎ গ্রন্থাগারে গোপাল ভট্টের লেখা দানখন্ড নামে একটি পুথি
(নং ৪২৭) আছে। হরিভক্তিবিলাস নামে অপর একটি গ্রন্থও গোপাল ভট্টের লেখা বলে
কথিত হয়, যদিও কারও কারও মতে এটি সনাতনের রচনা, গোপাল পরে এর
বিষয়বস্ত্তকে বিস্তৃত করেন।
রঘুনাথ ভট্ট (আনু. ১৫০৬-১৫৮০) বৃন্দাবনের লুপ্ত তীর্থ ও
বিগ্রহ উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া বর্তমানেও বৈষ্ণব
ভক্তগণ যে ৮৪ ক্রোশ বন পরিক্রমা করেন সেগুলি নির্ধারণেও তাঁর অবদান ছিল।
রঘুনাথের পিতার নাম তপন মিশ্র। শ্রীচৈতন্য পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে এসে
পদ্মার তীরবর্তী রামপুর গ্রামে তপন মিশ্রের আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং তখন
রঘুনাথকে ভক্তিতত্ত্ব শিক্ষা দেন। রঘুনাথ কাশীতে বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে
পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি নীলাচলে শ্রীচৈতন্যের লীলা প্রত্যক্ষ করেন।
পিতামাতার দেহত্যাগের পর তিনি বৃন্দাবনে যান এবং রূপ-সনাতনের সঙ্গ লাভ
করেন। সেখানে তিনি ভাগবতের শ্রেষ্ঠ পাঠক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
জীব গোস্বামী (আনু. ১৫১৪-১৬০৯) ছিলেন রূপ-সনাতনের
ভ্রাতুষ্পুত্র। রামকেলিতে তাঁর জন্ম। জীবের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন গৌড়ে
অতিবাহিত হয়। পরে নিত্যানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি নবদ্বীপ যান এবং
তাঁর আদেশে কাশীতে পন্ডিত মধুসূদন বাচস্পতির নিকট নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন
করেন। এখানেই পিতৃব্য রূপ-সনাতনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং রূপ গোস্বামী
তাঁকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা দেন। তাঁদের সান্নিধ্যে জীব জ্ঞানসাধনায় আরও
উৎকর্ষ লাভ করেন। তাঁদের তিরোধানের পর জীব গোস্বামী বৃন্দাবনের গৌড়ীয়
বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। কৃষ্ণমূর্তির বামে রাধামূর্তি বসিয়ে
যুগলরূপের পূজা প্রবর্তনে তিনি উৎসাহী ছিলেন।
জীব বাল্যকাল থেকেই শ্রীচৈতন্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন; দীক্ষা
গ্রহণের পর তাঁর সেই অনুরাগ আরও বৃদ্ধি পায়। চৈতন্য তথা বৈষ্ণবধর্ম তাঁকে
মোহিত করে। তিনি বৈষ্ণবধর্ম ও তন্ত্র-বিষয়ক নানা গ্রন্থ ও টীকা-ভাষ্য রচনা
করেন। তাঁর রচিত ষট্সন্দর্ভ একটি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ। এতে ছয়টি
সন্দর্ভ বা অধ্যায় আছে এবং তাতে বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।
জীব গোস্বামীর আরও কয়েকটি গ্রন্থ হলো: গোপালচম্পূ,
হরিনামামৃতব্যাকরণ, ধাতুসূত্রমালিকা, মাধবমহোৎসব, সংকল্পকল্পদ্রুম ও
সারসংগ্রহ। এছাড়াও তিনি উজ্জ্বলনীলমণি, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, গোপালতাপনী ও
ভাগবতের টীকা রচনা করেন। [বাসন্তী চৌধুরী]