বীরভূমে আফগানিস্থানের ছায়া!!!!

বীরভূমে আফগানিস্থানের ছায়াঃ গান গাওয়ার অপরাধে ৯ ভাই খুন ; ৩ দশকেও হল না বিচার…।।

রামপুরহাট, ৬ অগাস্ট : ভাগনি জন্মানোর খুশিতে বোনের বাড়ি গান গাইতে এসেছিলেন সুফি মতবাদে বিশ্বাসী নয় ভাই। আর সেই গানের মধ্যে ‘প্রভু’ উচ্চারণ করায় প্রকাশ্যে দিবালোকে বোনের সামনেই তাঁদের কুপিয়ে খুন করেছিল একদল দুষ্কৃতী। তারপর কেটে গেছে তিন দশক। কিন্তু, এখনও ভাইদের খুনের বিচার মেলেনি।

আশির দশক। ময়ূরেশ্বর থানার মাড়গ্রামের খাঁর পুকুর পাড়ার বাসিন্দা আনোয়ারা বিবির ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। পাঁচ ছেলের বিয়ে দেওয়ার পর বড় মেয়ে নইমার বিয়ে দেন ময়ূরেশ্বর থানার কোট গ্রামে। চাষাবাদের পাশাপাশি সুফি গান গাইত ছেলেরা। আশপাশে বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠে সেই গান।

১৯৮১ সালের অগাস্ট মাসে একটি কন্যাসন্তান হয় বড় মেয়ে নইমার। খবর পেয়ে নাতনির মুখ দেখতে ছোটো মেয়ে ফরিদা এবং ছোটো ছেলে সানোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে ৮ অগাস্ট সকালে বড় মেয়ের শ্বশুড়বাড়ি যান আনোয়ারা বিবি। সেখানে পৌঁছেই সুফিবাদে বিশ্বাসী সানোয়ার শেখ ভাগনি হওয়ার খুশিতে গজ়লের আসর বসান। কিন্তু, গজ়ল সেখানে গাওয়া যাবে না বলে ফতোয়া দেয় গ্রামের কয়েকজন।

খবর পেয়ে সানোয়ারের বাকি পাঁচভাই নূর হোসেন শেখ, নূর আলি, আবুল হোসেন, জিয়ার হোসেন, আনোয়ার শেখের সঙ্গে তিন মাসতুতো ভাই জ়াফর আলি, পিয়ার শেখ ও ঘুলু শেখ গিয়ে পৌঁছয় ওই গ্রামে। সুফি বা গজ়ল গান মুসলিম ধর্মের মানুষকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়, এটা বোঝাতে যায় তারা। সুফি মতবাদের বই নিয়ে গিয়ে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টাও করে তারা। পরিস্থিতি যখন প্রায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে ঠিক তখনই গানের মধ্যে থাকা প্রভু শব্দটি নিয়ে আপত্তি করে গ্রামের ধর্মান্ধ একদল মানুষ। তারা দাবি করতে থাকে গানের মধ্যে কোনওভাবেই প্রভু উচ্চারণ করা যাবে না। সানোয়াররা সুফিবাদের বই দেখিয়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেও কোনও লাভ হয়নি। উলটে গ্রামবাসীদের সঙ্গে বচসা বেঁধে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে তাঁরা ছুটে গিয়ে বোনের শ্বশুরবাড়ির একটি ঘরের মধ্যে ঢুকে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন।

কিন্তু, ধর্মান্ধ গ্রামবাসীদের রোষানলে পড়ে শেষরক্ষা হয়নি। উত্তেজিত একদল মানুষ প্রথমে যে ঘরে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিল সেই ঘরের দেওয়াল কেটে ফেলে। তারপর শুকনো কাপড়ের মধ্যে কেরোসিন তেল ঢেলে, তাতে শুকনো লঙ্কা বেঁধে আগুন ধরিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। একদিকে কালো ধোঁয়া ও অন্যদিকে লঙ্কাপোড়ার ঝাঁজে অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে ন’ভাইয়ের। প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে দরজা খুলে একে একে বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে তারা। বাইরে আসতেই একে একে ন’জনকে কুপিয়ে খুন করে দুষ্কৃতীরা।

ঘটনার পরেরদিন ১৬ জনের নামে ময়ূরেশ্বর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয় (৪০/৮৬)। কিন্তু, কিছুদিন জেলে থাকার পরেই জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় অভিযুক্তরা। দু’বছর পরে তদন্ত শেষ করে সিউড়ি আদালতে মোট ৭২ জনের নামে চার্জশিট জমা করে পুলিশ। এরপর শুধু চার্জ গঠন করতেই কেটে যায় ১০টি বছর। কোনও দিন সরকারি আইনজীবী আসতে পারেন না, তো কোনওদিন অনুপস্থিত থাকেন বিচারক। আর যেদিন কপালগুণে দু’পক্ষই হাজির থাকেন, সেদিন আদালতে কর্মবিরতি পালন করেন আইনজীবীরা। আর যদি এ সবকিছু নাও হয়, তা হলে মামলার দিন প্রয়োজনীয় কাগজ খুঁজে পায় না পুলিশ।

এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময়। আচমকা ১৯৯৮ সালে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন পাওয়ার পরে তিন মাসের মধ্যে মামলাটি শেষ করার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু, এখানেও বিধিবাম ! মামলা শুরু হওয়ার আগেই হঠাৎ মারা যান সরকারি আইনজীবী। এরপর নতুন সরকারি আইনজীবী নিয়োগ হতে লেগে যায় আরও কয়েকটা বছর।

শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টার পরে ২০০৩ সালে ফের নিযুক্ত হন নতুন সরকারি আইনজীবী। কিন্তু, দায়িত্ব নেওয়ার পরই আগের সরকারি আইনজীবী কেস ডায়েরি হারিয়ে ফেলেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। এর ফলে মামলা কী ভাবে এগোবে তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

বাদীপক্ষের তরফে এরপর হাইকোর্টে মামলা করা হয়। শেষমেশ কেস ডায়েরিও জমা পড়ে সিউড়ি আদালতে। এরপর প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ২০০৬ সালের মার্চ মাসে। বছরখানেকের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু, তারপরেও কেটে গেছে  ১০টি  বছর। আজও এই মামলা বিচারাধীন।

বাদীপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ মুন্নার অভিযোগ, “বিচারক হয় তো কোনও রিপোর্ট পুলিশের কাছে চাইছেন। কিন্তু, অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সেই কাগজ পাঠাতে দেরি করছে পুলিশ। আগামী ২৮ অগাস্ট মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রয়েছে। ঘটনার সময় ৭২ জনের নামে চার্জশিট দায়ের হলেও এখন জীবিত রয়েছে ৫৩ জন। সূচপুরের ১১ জন কৃষককে খুনের মামলায় রায় হয়েছে। কিন্তু তিন দশক পরেও রায় হয়নি নয় ভাইয়ের হত্যার।  অভিযুক্তরা সবাই বর্তমানে শাসকদলের ছত্রছায়ায় থাকায় মামলাকে বিলম্বিত করা হচ্ছে।”

সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, তিনি সরকারি আইনজীবী হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর গত চার বছরে ৪০ জনের সাক্ষী নেওয়া হয়েছে। শুনানির কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে।

মামলার অন্যতম অভিযুক্ত জ়াকির হোসেনের কথায়, “ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে ঘটনাটা ঘটেছিল। তবে অনেক নির্দোষ এবং বয়স্ক মানুষকে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। ওই ঘটনার দিন আমিও নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলাম। কিন্তু, আমার নামও চার্জশিটে ঢোকানো হয়েছে। এখনও মামলা চলছে। এক অভিযুক্ত হজ করতে গেছেন। তিনি ফিরলেই আমরা আদালতে যাব। মামলার যা রায় হবে তা মাথা পেতে নেব।” 

কথায় বলে, Justice delayed is justice denied। অর্থাৎ বিচারে বিলম্ব, বিচার না পাওয়ার সামিল। আনোয়ারা বিবি গত হয়েছেন। তিনি তো তাঁর ছেলেদের হত্যার বিচার পেলেন না। এখন রয়েছেন নইমা। তিনিও ভাইদের হত্যার  বিচারের আশায় দিন গুনছেন। আর কতদিন ?

সৌজন্যেঃ http://bangla.eenaduindia.com/States/South/Birbhum/2017/08/05204959/9-brother-killed-for-singing-Justice-pending-for-3.vpf