…মোদী সরকারের আমলে ১২৮ টি NCERT পাঠ্যবইতে পরিবর্তন করা হয়েছে ১৩৩৪ টি। এইসব পরিবর্তনের ফলে ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- ১) বিপ্লবী ঋষি অরবিন্দের জীবনী, ২) স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা, ৩) অপরাজেয় বীর দ্বিতীয় বাজিরাও, ৪) অহমিয়া হিন্দুবীর লাচিত বরফুকন, ৫) হিন্দুবীর ছত্রপতি শিবাজীর বীরত্ব ইত্যাদি।
…এইসব মহাপুরুষদের ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব বলেছেন, “যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, লাচিত বরফুকনের মতো তাদের অনেকেই স্কুলপাঠ্যে ঢোকানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ নন, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রাচীন ভারতে গণেশের প্লাস্টিক সার্জারির সম্ভাব্য ইতিহাস পেতে পারেন, সেখানে এমন পরিবর্তন সম্ভব।”
…এ বিষয়ে তৃণমূল নেতা শিক্ষাবিদ সুগত বসু (সুভাষচন্দ্র বসুর আত্মীয়) বলেছেন, “একটি বিশেষ মতবাদ পড়ানোর চেষ্টা চলছে, অতএব ইতিহাসের প্রতি সুবিচার হচ্ছে না। যাদের সমাদর করা হচ্ছে, অতীতে তাদের সাম্প্রদায়িক পরিচয় ছিল। মহারাণা প্রতাপ-বাজিরাওকে নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে, আর এর ফলে মার খাচ্ছে মুঘল ইতিহাস।”
…ইরফান হাবিব ও সুগত বসুরাও নাকি ভারতবাসী ??? সকল ভারতবাসী নাকি এদের আত্মজ ??? আসুন দেখে নেই অহম বীর লাচিত বরফুকনের ইতিহাস আমাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তিকরণ যথাযথ কি না! এই ইতিহাস NCERT’র কোনো বই থেকে কপি-পেস্ট নয়, এ আমার সঠিক ও সত্য ইতিহাস অধ্যয়নের ফসল।
…আসামের তথা ভারতের ইতিহাসে অন্যতম কঠিন আর ভয়ংকর লড়াই হিন্দুরা লড়েছিল মুঘলদের সঙ্গে ১৬৭১ সালে। যা ইতিহাসে “Battle of Saraighat” (সরাইঘাটের যুদ্ধ) নামে পরিচিত। আর এই যুদ্ধের নায়ক ছিলেন এক অসম সাহসী অহমিয়া যোদ্ধা “লাচিত বরফুকন” (‘বরফুকন’ বলা হত অহম সেনার ‘চীফ ফিল্ডমার্শাল’ বা সেনাপতিকে)। আপনারা জানেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভারতের হিন্দু উপজাতিদের গৌরবগাথাগুলি স্থান পায়নি ভারতের ইতিহাসে, আপনাদের সবার কাছ থেকে এসব লুকিয়ে রাখা হয়েছে ভারতকে ধমনিরপেক্ষ সাজাতে।
…১৬৫৮ সালে ভারতের শেহেনশাহ ছিলেন জেহাদি ‘আওরঙ্গজেব’। আর সেই সময় আসামে রাজত্ব করছিলেন হিন্দু রাজা “জয়ধ্বজ সিংহ”। ১৬৬১ সালে আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার “মীর জুমলা খান” কে আসাম অধিকার করার নির্দেশ দেন। মীর জুমলা আসামের রাজধানী “গড়গাঁও” অধিকার করে নিলেও, জয়ধ্বজ সিংহ গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে মুঘলদের অতিস্ট করে তুলছিলেন ফলে মুঘলরা ১৬৬৩ সালে ‘ঘিলাঝারিঘাট-এর সন্ধি’ করতে বাধ্য হয়।
…জয়ধ্বজ সিংহের মৃত্যুর পর আবার মুঘল ফৌজদার “ফিরুজ খান” গুয়াহাটি অধিকার করে নেয়। আসামের সিংহাসনে বসেন জয়ধ্বজ সিংহের কাকাতো ভাই “চক্রধ্বজ সিংহ”। তিনিই “লাচিত বরফুকন”কে আসাম সেনার সেনাপতি নিযুক্ত করেন। সেপ্টেম্বর ১৬৬৭ সালে মন্ত্রী “আতন বরগোহাই” কে সঙ্গে নিয়ে ‘লাচিত বরফুকন”-এর নেতৃত্বে অহম সেনা গুয়াহাটি পুনরুদ্ধার করতে ব্রহ্মপুত্র নদীপথে ‘আপার আসাম’ থেকে নেমে আসেন। দুমাস ধরে চলা স্থল ও নৌযুদ্ধের পর ৪ নভেম্বর ১৬৬৭ সালে আসাম সেনা আবার গুয়াহাটি উদ্ধার করে।
…১৯ শে নভেম্বর ১৬৬৭ সালে এই খবর পেয়ে আওরঙ্গজেব আম্বের এর চার হাজারি মনসবদার রাম সিং কে আসাম আক্রমণ করতে পাঠান। ১৬৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাম সিং রাঙ্গামাটি-তে এসে পৌঁছান। রাম সিং এর মুঘল সেনায় ৪০০০ গেরিলা সৈন্য, ১৫০০ আহাদি, ৫০০ বরকন্দাজ, ৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য, ১৮ হাজার অশ্বারোহী বাহিনী, ২০০০ তীরন্দাজ ও ৪০ টি বিশাল জাহাজ ছিল। এছাড়া কোচবিহারের রাজা “মদন নারায়ণ” এই যুদ্ধে মুঘলদের পক্ষে যোগদান করে প্রায় ১০ হাজার কোচ সৈন্য দিয়ে সাহায্য করে।
…ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সেরা সেনাপতি লাচিত বরফুকন জানতেন মুঘল ও কোচ সেনাকে যদি পাহাড়বেষ্টিত আসাম রাজ্যে ঢুকতে হয় তবে সরাইঘাট এর এক কিলোমিটার চওড়া ব্রহ্মপুত্র নদীপথেই ঢুকতে হবে কারণ আশপাশ ছিল পাহাড়বেষ্টিত। তাছাড়া মুঘলরা নৌযুদ্ধে পারদর্শী ছিল না, তাই তিনি সেখানেই মুঘলসেনাকে আটকাতে স্থলে গেরিলা ও নদীবক্ষে নৌ সমরসজ্জায় মনোনিবেশ করেন।
…১৬৬৯ সালের এপ্রিল মাসে মুঘল সেনা মানস নদী দিয়ে আসামে প্রবেশ করে। শুরুতে স্থল যুদ্ধে পারদর্শী মুঘল সেনা লাচিত-এর অহম সেনার প্রথম প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেয়। লাচিত সেনাকে পিছিয়ে এসে গুয়াহাটি রক্ষা করার নির্দেশ দেন, কারণ গুয়াহাটির পেছনেই সরাইঘাটে তিনি শেষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আসামবাসীর শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত গুয়াহাটি ও কামরূপ মুসলিমদের হাতে তুলে দেওয়া হবে না বলে হুঙ্কার ছাড়েন তিনি।
…গুয়াহাটি অধিকার করতে মুঘল এবং কোচ সেনা চারটি দলে ভাগ হয়ে চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। অহম সেনা দুটি দলে ভাগ হয়ে লাচিত এবং আতন এর নেতৃত্বে লড়াই করছিল। ১৬৬৯ এর জুন মাস নাগাদ মেঘালয়ের “জৈনটিয়া”, “গারো” উপজাতিরা এবং দরং এর রানী-ও অহম সেনার সঙ্গে যোগ দেয়। ছয় মাস ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করেও মুঘল সেনা গুয়াহাটি দখল করতে পারে নি, এই খবর পেয়ে আগস্টে আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে রাম সিং কে সাহায্য করার জন্যে সেনাসহ পাঠান।
…৫ আগস্ট ১৬৬৯ সালে “আলাবই পাহাড়ের” পাদদেশে ৪০ হাজার মুঘল সৈন্যের সঙ্গে ২০ হাজার অহম সেনা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু রাম সিং “মন্দবতী” নামে এক রাজপুত মহিলাকে মুঘল সেনাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হন। লাচিত এরপর মাঠে “ট্রেঞ্চ” খুঁড়ে লড়াই করতে থাকে, ১০ হাজার অহম সেনা মাতৃভূমির জন্যে প্রাণ দেয়। লড়াই চলতে থাকে গুয়াহাটির নানা অংশে।
…মার্চ ১৬৭০ সালে শায়েস্তা খান রাম সিং এর সঙ্গে যোগ দেয়। আলাবইয়ের যুদ্ধে লাচিত বরফুকন অসুস্থ হয়ে পড়লে অহম সেনার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন “লালুক বরগোহাই ফুকন”। অহম সেনার সঙ্গে লড়াইয়ে জিততে না পেরে রাম সিং এই “ফুকন” বা ফিল্ডমার্শালদের কিনে নেবার চেষ্টা করেন কিন্তু দেশপ্রেমী হিন্দু ফুকনরা কেউই বিক্রি হয়ে যান নি। সেপ্টেম্বর ১৬৭০ সালে লাচিত যুদ্ধের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন, স্থলভাগগুলি খাল কেটে জলমগ্ন করে দেন, যাতে মুঘলরা নদীপথে আক্রমণ করতে বাধ্য হয় এবং ৭ টি জাহাজ শেষ লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত করেন।
…জানুয়ারি ১৬৭১ সালে মুঘল এডমিরাল “মুনাব্বর খান” ৪০ টি বিশাল জাহাজ নিয়ে সরাইঘাট নগরের উপকণ্ঠে ব্রহ্মপুত্র নদীবক্ষে অহম সেনার ৭ টি জাহাজের সম্মুখীন হয়। অসুস্থ লাচিত নৌ যুদ্ধেও অত্যন্ত পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সেনাকে উদ্বুদ্ধ করে লড়াই করতে থাকেন। ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ মুঘল সেনা “আন্ধারুবালি” পর্যন্ত এগিয়ে আসে। লাচিত তার সৈন্যবাহিনীকে বলেন- “অহম রাজ আমাকে আসাম রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন, আমার শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত আমি আসাম রক্ষা করবই, স্ত্রী পরিবারের কথা আমি এখন ভাবছি না।” মাত্র ৬ টি জাহাজ নিয়ে ১২ ফেরুয়ারি ১৬৭১ এর সকালে বিশাল ৩৮ টি জাহাজের মুঘল নৌ বাহিনীর উপর আত্মঘাতী আক্রমণ শুরু করে অহম সেনা।
…উত্তর তীরে আমরাজুলিতে ৪ টি মুঘল জাহাজকে গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দেয় অহম সেনা। নদী তীরবর্তী স্থলভাগে মুঘলদের সঙ্গে লড়াই করতে থাকে গারো ও অহম গেরিলা যোদ্ধারা। এরপর কামাখ্যা পাহাড়ের পাদদেশে নদীবক্ষে ৬ টি অহম জাহাজকে ২ টি করে তিনটি দলে ভাগ করে একটি ত্রিভুজ বানিয়ে মুঘল জাহাজগুলিকে ঘিরে ফেলে লাচিত এর নৌবাহিনী। ৩৪ টি মুঘল জাহাজকে ধন্দে ফেলে দিতে প্রায় ৪ শত ছোট নৌকা ব্যাবহার করেন লাচিত। এই নৌকাগুলি নদীবক্ষে একে অপরের গায়ে লেগে প্রায় সমতলভূমি তৈরি করে ফেলে, স্থলভাগের সঙ্গে নদীর ওপরেই অবিচ্ছিন্ন রাস্তা তৈরি করেন নৌকা দিয়ে, লড়াইয়ে এগিয়ে যায় অহম সেনা।
…মার্চ ২১, ১৬৭১ এর মধ্যরাতে ছোট ছোট নৌকা নিয়েই মশালের আলোয় অহম সেনার আক্রমণ শুরু হয়, এক বীভৎস লড়াই চলে প্রায় ৩ দিন দিনরাত। এই লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন “লাচিত বরফুকন”। ব্রহ্মপুত্র নদের জলস্রোত এবং বায়ুপ্রবাহ হাতের তালুর মতই চিনতেন তিনি। ঝটিকা আক্রমণ করে আগুন লাগিয়ে, গোলা দেগে, হাজারে হাজারে তীর ছুঁড়েই ঝটিকা পলায়ন। কখনও ছোট ছোট দ্রুতগামী নৌকা নিয়ে টাঙ্গি বর্শা তলোয়ার নিয়ে মুঘল জাহাজগুলি আক্রমণ।
…নদীবক্ষে অহম সৈন্য ত্রিভুজাকারে ঘিরে রাখায় খাদ্য ও গোলাবারুদের অভাবে হার স্বীকার করে মুঘলরা। তাদের ২১ টি জাহাজ ধ্বংস হয় এবং ৪ হাজার সৈন্য মারা যায়। এডমিরাল মুনাব্বর খান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বাকি জাহাজগুলি নিয়ে পালাতে শুরু করে তারা। কিন্তু লাচিত শত শত দ্রুতগামী ছোট নৌকা নিয়ে পিছু ধাওয়া করেন ব্রহ্মপুত্র থেকে মানস নদী পর্যন্ত। শেষে রাম সিং ৭ এপ্রিল ১৬৭১ সালে হেরে গিয়ে বাকি মুঘল সেনা নিয়ে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে আসাম ছাড়েন।
…মাত্র ২ হাজারের অহম নৌবাহিনীর নিয়ে শুধুমাত্র বীরত্ব আর কৌশলকে সম্মল করে বিশাল ৯ হাজারের মুঘল নৌবাহিনীকে পরাস্ত করেন হিন্দুবীর “লাচিত বরফুকন”। আসামের প্রথম গভর্নর (বরবরুয়া) মোমাই তামুলীর পুত্র ছিলেন এই লাচিত বরফুকন। ভারতের ইতিহাস বইগুলি তাকে জায়গা না দিলেও আসাম সহ সকল হিন্দুর হৃদয়ে তিনি আছেন একজন বীর হিন্দু হিসেবে। সেকুলার ঐতিহাসিকরা তাকে ভুলে গেলেও ভারতীয় সেনা কিন্তু তাকে ভোলে নি, ন্যাশানাল ডিফেন্স একাডেমী থেকে প্রতিবছর পাস করা বিভিন্ন বিষয়ে সেরা ক্যাডেটদের “লাচিত বরফুকন গোল্ড মেডেল” দিয়ে সম্মান জানানো হয়।
…যতদিন আসামবাসীর দেহে লাচিত বরফুকনের রক্ত থাকবে ততদিন আসাম হিন্দুদের ছিল, আছে, থাকবে। কোন ইসলামী ষড়যন্ত্র মেনে নেবে না আসামবাসী। ভবিষ্যতে এই বীর যোদ্ধার বীরত্ব নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইল। আর ইরফান হাবিবের মতো জেহাদি ঐতিহাসিক এবং সুগত বসুদের মতো শিক্ষাবিদের প্রতি রইলো একরাশ ঘৃণা ও ধিক্কার।
©#Writankar_Das