দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ রায়।
(শাসনকাল ১৮৬৫-১৯১৯ খ্রি.)
👉 #ধ্বংসের_পথে_ঐতিহ্যবাহী_রাজবাড়ী_দিনাজপুর 👈
দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান ও এখানকার রাজ বংশের শেষ নিদর্শন রাজবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হিসাবে বিষণ্ণ মৌনতায়।
অযত্ন আর অবহেলার কারনে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে যেন পৌঁছেছে এটি। রাজ প্রাসাদে থাকা মূল্যবান ও দুর্লভ জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে অনেক আগেই।
দিনাজপুর শহর হতে ৪ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে নিরিবিলি মনোরম এক গ্রাম্য পরিবেশে হিন্দু, মুসলিম ও ইংরেজ এই তিন যুগের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের চিত্রসম্বলিত রাজবাড়িটি অবস্থিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, দিনাজপুরের রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ৪শ’ বছর ধরে প্রায় ১শ’ ৬৬ একর জায়গা জুড়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল বিশাল প্রাসাদ। দিনাজপুর রাজবাড়িতে রয়েছে আয়না মহল, রানী মহল ও ঠাকুরবাড়ি মহল। এছাড়াও ফুলবাগ, হীরাবাগ, সবজিবাগ, পিলবাগ, দাতব্য চিকিৎসা, অতিথি ভবন, কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা, প্রশাসনিক ভবন ও প্রসাদের মধ্যে কয়েকটি বিরাট দীঘি রয়েছে। দ্বিতল আয়না মহলে নীচে উপরে মিলে ২২টি করে মোট ৪৪টি কক্ষ রয়েছে। এই ভবনে মূল্যবান মার্বেল পাথর ও স্টটিকমতি খচিত ছিল। এছাড়াও রাজ প্রাসাদ এলাকায় জলসাগর, তোষাখানা, পাঠাগারসহ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভবন এই মহলে অবস্থিত। আয়না মহলের উত্তরে রানীর দেউড়ি পেরিয়ে রানী মহল অবস্থিত।
রাজপরিবারের ইতিহাসের জনমুখে রয়েছে নানা কাহিনী। তবে যতদূর জানা যায়, দিনাজ রাজা অথবা দিনরাজ রাজা রাজবাড়ি তথা রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারেই দিনাজপুর জেলার নামকরন করা হয়েছে। কালক্রমে রাজা প্রাণনাথ রাজপরিবারের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তিনি কান্তনগর মন্দির (১৭২২) নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রাণনাথের মৃত্যুর পর অবশিষ্ট কাজ তার পালকপুত্র রামনাথ ১৭৫২ সালে এটি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ভূমিকম্পে কান্তনগর মন্দিরে য়তি সাধিত হলে মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরটি সংস্কার করেন।
জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই রাজপ্রাসাদের প্রতি বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরন ও অবহেলার চোখে দেখে আসছিল। তৎকালীন মহারাজা জগদীশনাথের আমলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে তিনি স্বপরিবারে ভারতে চলে যান।
এর পর থেকেই এই রাজপ্রসাদের মধ্যে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হতে থাকে। তৎকালীন সরকার রাজপ্রাসাদের আয়না মহলকে ব্যবহার শুরু করে এতিমখানা হিসেবে। এরপর রাজ প্রাসাদের বিশাল সবুজ চত্বরে তৈরি করা হয় এতিমদের জন্য পাকা পাকা ভবন। রাজ বংশের শেষ রাজা জগদীশ চন্দ্র রায় বাহাদুরের একমাত্র পুত্র রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী রাজকুমার জলধিনাথ রায় এর জন্য নির্মিত রাজকুমার ভবনটি এখন বেদখল হয়ে আছে। রাজ-রাজড়াদের আমলের বিলুপ্তি ঘটার পর পরিত্যক্ত হয় রাজবাড়িও। এখন শুধু কালের সাক্ষী হিসাবে বিশালতা ও দিনাজপুরের গৌরব হিসাবে বহিরাগত দর্শনার্থীদের এই অঞ্চলে আকর্ষিত করতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিষণ্ণ মৌনতায়।
দিনাজপুরের রাজবাড়ি একদিকে যেমন জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান, অন্যদিকে এটি হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য পূণ্যস্থান। রাজবাড়ির মন্দিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। প্রায় দিনই সেখানে পূজা, কীর্ত্তন হয়ে থাকে। দিনাজপুরের রাজবাড়িতে কান্তজিউ আসার পর থেকে প্রতিদিনই এখানে ভোগ দেয়া হয়। এছাড়াও এই প্রসাদের ভিতরে রয়েছে দূর্গাদেবীর মন্দির। এই মন্দিরে দূর্গাপূজার সময় হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়ে থাকে। এর বাইরে বসে বিশাল মেলা। এই মেলায় শুধুমাত্র হিন্দুরা নয়, অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনেরও সমাগম ঘটে।
দিনাজপুরের রাজবাড়ি কোন একক রাজার তৈরি কীর্তি নয়। দিনাজপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাকাল হতে শুরু করে মহারাজা জগদীশনাথ রায় পর্যন্ত প্রায় ৪শত বছর ধরে ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠেছিল এই বৃহৎ রাজবাড়িটি। সাবেক পরিখা ও প্রাকারবেষ্টিত এবং বহু দালান-কোঠাসম্বলিত মূল রাজবাড়ির আয়তন ছিল মাত্র ১৬ একর। পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে ১৬৬ একরে উন্নীত করে রাজা-মহারাজারা।
বহু সংখ্যক প্রাসাদ, প্রকোষ্ঠ, মহল, দেউড়ি, চত্বর, গবা ও অলি গলি সমন্বিত রাজবাড়ি তিনটি মহলে বিভক্ত। আয়না মহল, রানী মহল ও ঠাকুরবাড়ি মহল। তাছাড়া ফুলবাগ, হীরাবাগ, সবজীবাগ, পীলখানা, দাতব্য চিকিৎসালয়, অতিথি ভবন, কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা ও কয়েকটি বিরাট দিঘী মিলে বৃহত্তর রাজবাড়ির আয়তন প্রায় ১৬৬ একর বা ৬৭ হেক্টর।
প্রায় ২২ * ২২ মিটার (৭২ * ৭২ ফুট) চতুষ্কোণিক চত্বরের চারিদিকে ঘেরা দ্বিতল আয়না মহল প্রাসাদ অবস্থিত। বহুমূল্যবান মার্বেল ও স্ফটিকমণ্ডিত দরবারগৃহ, জলসাগৃহ, মিছিল ঘর, তোষাখানা, পাঠাগার প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো এই মহলে অবস্থিত। আয়না মহলের উত্তরদিকে রানীর দেউড়ি পার হয়ে রানীমহল বিদ্যমান। ত্রিশের দশকে পুরাতন রানীমহল ভেঙ্গে আধুনিক দ্বিতল ভবন নির্মিত হয়েছে যা বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত শিশু পরিবারে আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিংহমূর্তি সংস্থাপিত ঠাকুরবাড়ির দেউড়ি পার হয়ে ঠাকুরবাড়ি মহল। ঠাকুরবাড়ি মহলে অবস্থিত মন্দিরের নাম কালিয়াকাণ্ডের মন্দির। হিন্দু ও মোগল স্থাপত্যরীতি সমন্বিত চৌচালা ডিজাইননির্মিত মন্দিরটি এখনও দর্শনার্থীদের চমৎকৃত করে। মন্দিরের শিলালিপি মতে রাজা বৈদ্যনাথের আমলে এই সুদর্শন মন্দিরটি নির্মিত হয়।
রাজপ্রাসাদের ভিতরের ঘরগুলো বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভিতরে যাওয়ার জন্য অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় কেউ ভিতরে প্রবেশ করে না। তবে এর ভিতরের দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। প্রাসাদের রুমগুলোতে কেউ বসবাস না করায় সেখানে বিভিন্ন গাছ, লতা-পাতার জন্ম হয়েছে। এই গাছে রয়েছে এক প্রজাতির শামুক। এই শামুকগুলো দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। রুমগুলো তৈরি করতে যে লোহার প্রয়োজন হয়েছিল সেগুলিও বর্তমানে চুরি হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে এই প্রাসাদের ভিতরে একটি সুড়ঙ্গের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু পরে তা প্রশাসন বন্ধ করে দেয়।
রাজ প্রাসাদের আয়না মহল, রানী মহলসহ রাজবংশের পুরো আবাসিক এলাকাটি এতিমখানা বাউণ্ডারি ওয়ালের ভিতরে। আয়না মহল, রানী মহলের মূল্যবান মার্বেল পাথর, স্টটিকমতি, অসংখ্য স্টিলের বিশাল বিশাল বীমগুলো দিনের পর দিন অপরাধী চক্র পাচার করে আসছে। কোটি কোটি টাকার মালামাল সেখান থেকে চুরি হয়ে গেছে। নেই বলে দালান ছাড়া কিছুই নেই।