জামাই ষষ্ঠী মানেই বাঙালিদের কাছে কার্যত উৎসব। বহু জামাই আছেন এমন দিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে মিষ্টির ঝোলা ও বিশাল মাছ হাতে শ্বশুরবাড়িতে হাজির হতে পছন্দ করেন। কিন্তু, জামাই হল গিয়ে মেয়ের বর। মেয়েকে ছেড়ে জামাই আদরের এত ঘটা কেন? সেটা কখনও কেউ কি ভেবেছেন?
ক’দিন আগেই ক্যালেন্ডারে কেটে গেছে ‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ’ এক বিশেষ দিন। বিবাহিতা কন্যা তথা জামাই বাবাজীবনদের জন্য বাঙালি সমাজে দারুণ এক পার্বণ—জামাইষষ্ঠী! আনকোরা নতুন জামাই থেকে পুরনো জামাই বাবাজিদের জন্য বাংলা পঞ্জিকার এক বিশেষ দিন: জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিনটি। বাংলার জামাইদের জন্য উৎসর্গীকৃত নির্দিষ্ট দিনটিতে জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় শাশুড়িরা প্রতি বছর পালন করেন। এটি মূলত লোকায়ত এক প্রথা ও ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ। পরবর্তীতে এই পুজো ধর্মীয় সংস্কারের চেয়ে সামাজিকতায় স্থান পেয়েছে বেশি।
আধুনিকতার দিক থেকে আমরা যতই সমকালীন হই না কেন, কিছু কিছু প্রথা-পার্বণ আজও বাঙালি ঘরে থেকে গেছে। তাই বিশ্বায়নের যুগে বাঙালি জীবন থেকে আচার-অনুষ্ঠান সবই যে এক-এক করে উঠে যাচ্ছে, তা বোধহয় বলা যাবে না। কখনও পুরনো লোকাচার হাজির হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে, যেমন নয়া মোড়কে জামাই আদর। গ্রামবাংলার পাশাপাশি শহুরে পরিমণ্ডলেও জামাইষষ্ঠী পালনের রীতি-রেওয়াজ খুব একটা ফিকে হয়ে যায়নি। মনোলোভা নানান পদ রেঁধে-বেড়ে জমিয়ে জামাইকে খাওয়ানোর আহ্লাদ আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। আদরের জামাইকে খাতির-আপ্যায়নের ধরনটা যদিও বদলে বদলে যাচ্ছে। যেমন বদলে যাচ্ছে আয়োজনের রকমও। সারা দিন ধরে ঘেমে নেয়ে রান্নার জোগাড় করা থেকে শুরু করে জামাইয়ের জন্য ভুরিভোজ বানানোর ব্যাপার বদলে দিয়েছিল কিছু বাঙালি রেস্তোরাঁর ‘ষষ্ঠী স্পেশাল’ বা ‘স্পেশাল থালি’।
ইদানীং মিডিয়া ফেসবুক অথবা বাণিজ্যিক পত্রিকার কল্যাণে অনেক আগেভাগেই জানা হয়ে যায়, কোন অনুষ্ঠানের জন্য কবে কী ব্যবস্থা থাকছে। পত্রিকা, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদিতে সেই বিশেষ দিন ক’টি নিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচার, তামাশা, রঙ্গ, কেনাকাটার হাতছানি। এ বছর ‘প্যান্টালুনস’ সংস্থার জামাইষষ্ঠীর বিজ্ঞাপনটি এই প্রতিবেদকের বেশ নজর কেড়েছে। সেখানে রয়েছে ৩৪ প্রকার জামাইয়ের চরিত্রের ফিরিস্তি। ঘরজামাই, প্রবাসী জামাই, দায়িত্বশীল জামাই, উদাসীন জামাই, পেন্নামঠোকা জামাই, ইংলিশ-মিডিয়াম জামাই, ডাকসাইটে জামাই, প্রভাবশালী জামাই, সুবিধাবাদী জামাই, মিষ্টিমুখ জামাই, শুগার-ফ্রি জামাই, শৌখিন জামাই, আপনভোলা জামাই, টি-টোয়েন্টি ভক্ত জামাই—এমনই ৩৪ প্রকার জামাইয়ের মজাদার ফিরিস্তি।
তো মাদারস ডে, ফাদারস ডে, অমুক দিবস, তমুক দিবসের ফাঁক-ফোকরে আমাদের বাঙালিদের যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসা সাবেকি প্রথাসিদ্ধ ‘জামাইবরণ’ দিবসটিও একটু নতুন আন্তর্জাতিক মোড়কে ‘সন-ইন-ল’স ডে’ হিসেবে জুড়ে দেওয়া যায় না? যদিও বাংলা পত্রিকায় জামাইষষ্ঠী দিনটি কিন্তু বেশ তুখোড় ভাবেই নিজের স্থান অধিকার করে আছে সেই কবে থেকেই। জামাইষষ্ঠী পার্বণটি লোকায়ত ও সামাজিক প্রথা হলেও মূলত ষষ্ঠী দেবীর পুজো। সন্তানের মঙ্গলকামনায় মা ষষ্ঠীর ব্রত পাঠ করা হয়। জামাইষষ্ঠীর নির্ধারিত দিনটিতে অনেক পরিবারেই মা ষষ্ঠীর পুজোর আয়োজন করা হত। কোথাও প্রতিমার ছবিতে, কোথাও বা ঘটে। মা ষষ্ঠী মাতৃত্বের প্রতীক। বিড়াল তাঁর বাহন। ষষ্ঠীপুজোর থালায় পান সুপুরি ধান দুব্বো, ফলফলাদি অর্থাৎ গ্রীষ্মের জোগান যা যা রয়েছে সেই আম জাম কাঁঠাল তরমুজ লিচু ইত্যাদি এবং অবশ্যই তালপাতার একটি নতুন পাখা রাখা হয়। এ ছাড়াও ঘরের বাইরে কোনও দালান বা খোলা জায়গায় বট ও করমচা গাছের ডাল পুঁতে প্রতীকী অর্থে অরণ্য রচনা করে পুজো-আর্চা করা হয়। সে জন্যই এই ষষ্ঠীকে অন্য অর্থে ‘অরণ্যষষ্ঠী’ও বলা হয়।
মেয়ে-জামাইকে আপ্যায়ন করে ঘরে এনে, প্রথমে জামাইয়ের কপালে পুজোর নৈবেদ্যস্বরূপ পাঁচ রকম ফল, পান, সুপুরি, ১০৮টি দুব্বো-বাঁধা আঁটি, ধানের ছড়া, হলুদ তাগা, মাঙ্গলিক হলুদ ও দই, তালপাতার নতুন পাখার উপর আম্রপল্লব—সব একটি থালায় সাজিয়ে ছোঁয়ানো হয়। এর পর জামাইয়ের ডান হাতের কব্জিতে হলুদ সুতো ও দুব্বোর তাগা বেঁধে দেওয়ার রীতি। শাঁখ ও উলুধ্বনি দিয়ে জামাইকে বরণ করে নেওয়া এবং তাঁকে সামনে আসন পেতে বসিয়ে চর্বচোষ্য ভূরিভোজের এলাহি ব্যবস্থা। জামাইকে নতুন তালপাতার পাখার বাতাসও এ দিনের সনাতনী রীতি।
তবে শুধুই কি আর জামাই আদর? পেছনে লুকোনো একটা অর্থ তো থেকেই যায়। বাড়ির আদরের দুলালীকে তার হাতে সঁপে দিয়েই তো নিশ্চিন্ত হতে চায় বাবা-মায়ের স্নেহাবেগে ভারাক্রান্ত মন। তবু যেন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারা যায় না। চিন্তা থেকেই যায়। নতুন রাজ্যপাট নিয়ে কেমন আছে সে? স্বামীর কাছে, নতুন শ্বশুরবাড়ির কাছে কতটা মান্যতা পাচ্ছে? বাড়ির বউয়ের যথাযথ সম্মানটুকু কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নিতে কোনও বাড়তি বেগ পেতে হচ্ছে না তো? ওই বাড়িতে তাদের আদরের কন্যাটির ঠিকমত যত্নআত্তি করা হয় তো? সত্যিই সুখী হতে পারবে তো আমাদের মেয়ে? কত রকম সাতপাঁচ দুশ্চিন্তা থেকেই যায় অভিভাবকের মনে। কবেকার সেই এক প্রবচন ছিল:
পুড়বে মেয়ে, উড়বে ছাই
তবেই মেয়ের গুণ গাই!’
আদ্যিকালের ওই প্রবচনটি শুনতে হয়তো এখন প্রচণ্ড বোকা বোকা লাগবে। গা জ্বলে যাবে। আগেকার সেই বস্তাপচা মানসিকতা তো এখন আর নেই। যথার্থ আধুনিক সমাজে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও এখন অনেক বেশি স্বচ্ছ ও প্রগতিশীল। আর এ কথাও ঠিক যে, শ্বশুরবাড়িগুলো আজ অনেক বেশি লিবারাল এবং সহৃদয় মুক্তবুদ্ধি শিক্ষিত স্বামীরা আজ শুধু মাত্র ‘স্বামী’ পদবাচ্য নয়। তারাও আজ স্ত্রীদের প্রতি অনেক উদার ও বন্ধুবৎসল। অবশ্য স্ত্রী যাতে সংস্কারে স্বাধিকার ভোগ করতে পারে, সে বিষয়ে স্বামীকেও দায়িত্ববান হতেই হয়। সেটাই দস্তুর। আজকের জামাইরা বউয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট কেয়ারিং।
শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা শুনলে আজকের সপ্রতিভ পুরুষদের আর পেট গুড়গুড় মথা ভনভন হয় না। কাছেপিঠে শ্বশুরবাড়ি হলে তো কথাই নেই। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বউদের তাই এখন আর ‘হ্যাঁ গো, কী গো, যাবে তো?’ এই সব বলেকয়ে স্বামীদের কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে হয় না। বরের সঙ্গে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য কথায় কথায় ‘মাখন মারতেও’ হয় না। জামাইবাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি কিঞ্চিৎ দূরে হলে অবশ্য অন্য কথা। অফিসে ছুটি পাওয়ার হ্যাপা, ট্রেনের রিজার্ভেশনের ঝক্কি এই সব। বাকি শুধু বিমানযাত্রা। তা, পকেটে কিছু রেস্ত থাকলেও জামাইষষ্ঠী খেতে বউকে নিয়ে বউয়ের বাপের বাড়ি ফ্লাইটে যাওয়াটা বেশ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। তাই প্রবাসে বা একটু বেশি দূরে হলে ফি-বছর জামাইষষ্ঠীতে যাওয়া হয়ে ওঠে না। মাঝে মাঝে গ্যাপ দিতে হয়। কী আর করা তখন? সেলফোনে শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম জানিয়ে, আশীর্বাদ রিসিভ করেই কাটিয়ে দেওয়া। কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া অবশ্য ‘ডিউ’ থেকেই যায়। কথায় বলে, ‘যম, জামাই, ভাগনা কেউ নয় আপনা!’ ওটা কথার কথা। যম যেহেতু মৃত্যুর দূত, আর জামাই ও ভাগনা পরের বাড়ির উত্তরাধিকারী—তাই তাদের কখনও নিজের বলে দাবি করা যায় না। তবু জামাই খুশি থাকলে শ্বশুরবাড়িতে মেয়েরও কদর থাকবে। তাই জামাইকে একরকম ঘুষ দিয়েই কন্যাসন্তানের সুখ কিনতে চাওয়া। এ কথা জামাই ও তার বাড়ির লোকও বিলক্ষণ বোঝেন।
হ্যাংলা জামাই যদিও চক্ষুলজ্জার খাতিরে এমন নির্লিপ্ত ভাব করে খেতে বসে, যাতে সকলে তাকে আর একটু খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে! ওই যে একটা ঠাট্টার কথা আছে না? ‘একবার সাধিলেই খাইব’! তেমনই আর কী। তবে এখনকার শাশুড়িরা আসন পেতে, সুদৃশ্য হাতপাখা নেড়ে, কাঁসার থালা-বাটিতে বত্রিশ রকম পদ সাজিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে ঘটা করে আর করেন না। কর্পোরেট অফিসে চাকরি করা জামাই এ সব সেকেলে রকম- সকম মোটেও পছন্দ করবে না।
তবু মায়ের মন চায় নিজে রান্না করে মেয়ে-জামাইকে খাওয়াতে। গালভরা কিছু রেসিপি শিখে ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে খেতে দিলেন। জামাই যখন ওই নানান পদ দেখে ‘কোনটা খাব আর কোনটা রাখব’ করছে—তখন তাকে আরও একটু প্রশ্রয়ের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে, গলায় খানিক আর্তি রেখে শাশুড়ি মা গর্ব করে হয়তো বলবেন, ‘‘আজ কিন্তু সব কিছু খেয়ে নেবে বাবা। আজ আর তোমার কোনও অজুহাতই ধোপে টিকবে না, বলে দিলাম! তোমার শ্বশুরমশাই দেখেশুনে পছন্দ করে সব বাজার করে এনেছেন। গলদা চিংড়িগুলো এত ফ্রেশ ছিল যে..এ দিকে রেওয়াজি খাসির মাংস কিনতেই পাক্কা চল্লিশ মিনিট লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। তার ওপর গাঙ্গুরামের মিষ্টির দোকানেও আজ যা ভিড় ছিল!’’
দুপুরে না হয় একপ্রস্ত চর্ব-চোষ্য হল। দুপুরে হালকা ভাতঘুম দিয়েই বিকেলে মাল্টিপ্লেক্সে সবাইকে নিয়ে একটা ভাল মুভি দেখানোর ফিনান্সের দায়িত্ব কিন্তু জামাইয়ের। নামী রেস্তোরাঁয় আগে থেকেই ডিনার টেবিল বুক করে রাখা। সেও জামাইয়ের দায়িত্ব। মুড বুঝে বাঙালি খানা, নয় তো কন্টিনেন্টাল। ধোঁয়া ওঠা পুরোদস্তুর বাঙালি বনেদি মেনু। আহা, দু’পক্ষই আজ খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে অন্তত দরাজ। খেয়ে, খাইয়ে পরিতৃপ্তির সঙ্গে আলাদা একটা আদেখলেপনাও। দেখনদারি। একটা বিনিময়প্রথা। এখনও কি আর সেই দিনকাল আছে, যখন কোনও যৌথ পরিবারের এ-তরফ বা ও-তরফের কোনও জামাই হঠাৎ করে বিনা নেমন্তন্নেই শ্বশুরবাড়ি এসে পড়েছেন আর বাড়ির কোনও উদয়াস্ত রান্নাঘরে পড়ে-থাকা গিন্নি গাইছেন—
‘বলি ও ননদি, আর দু’মুঠো
চাল ফেলে দে হাঁড়িতে
ঠাকুরজামাই এল বাড়িতে!’
জামাইদের নিয়ে আস্ত একটা দিন সেলিব্রেট করার মধ্য থেকেই শাশুড়ি ও জামাইয়ের মধ্যেকার নির্মল একটা সাবেক পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধন টের পাওয়া যায়। এলাহি খাতির সে দিন। জামাইকে কাছে বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়ানো!’ অবশ্য এখনকার একটু আধুনিক শাশুড়ি মা হলে মেয়ে-জামাইকে তিনি নিয়ে যেতেন আধুনিক কোনও রেস্তোরাঁয়। নিজেই মেনু কার্ডে চোখ বুলিয়ে আমিষ নিরামিষ নানান পদের অর্ডার করে দিতেন। ষষ্ঠীর দিনের জামাই আদর সেই পছন্দসই মেনুতেই দিব্যি হয়ে যায়। রেস্তোরাঁগুলোও অপেক্ষা করে থাকে, শাশুড়ি-জামাইয়ের পাতে ভেটকি পাতুরি, কষা মাংস, চিতল, ইলিশ, ডাব চিংড়ি অথবা চিংড়ি মালাইকারি, মোচার ঘণ্ট, লুচি, বেগুনভাজা, কাতলা মাছের মাথা দেওয়া মুগডাল, আমপানা থেকে ভাপা দই আর বেকড রসগোল্লা তুলে দেওয়ার জন্য—যা খেয়ে সুখ যেমন, খাইয়েও সুখ! গতিশীল যুগেও সে নব্যই হোক বা পুরনো, জামাইরাও এখন দিব্যি অনলাইনের বাজারে ফ্লিপকার্ড বা অ্যামাজন বা স্ন্যাপডিলেই শ্বশুর-শাশুড়ির উপহারটাও চুপিচুপি বুক করে দিচ্ছেন। আসলে শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর চাওয়া-পাওয়ারও তো কদর দিতে হয়। ওঁরাও তো এই বিশেষ দিনটায় জামাইকে নানা আদর-যত্ন ও উপহারে ভরিয়ে দিতে ত্রুটি রাখেন না। অনলাইনে বুক করা উপহার সামগ্রীও এখন জামাই নিজে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছনোরও ঢের আগেই পৌঁছে যায় শ্বশুরবাড়িতে। নিন্দুকেরা হয়তো মুখ বাঁকাবেন। তাঁরা বলবেন, এই নব্যযুগে যথেষ্ট আন্তরিকতার অভাব। এককালে জামাই বাবাজিরা সস্ত্রীক এই জামাইষষ্ঠীর দিনটায় শ্বশুরবাড়ি যেতেন রীতিমত মাঞ্জা দিয়ে। কখনও সোনার চেন আঁটা সোনার বোতাম-সহ সিল্কের পাঞ্জাবি, কিংবা গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি। আর খানিকটা অবধারিত ভাবেই হাতে থাকত পেল্লায় সাইজের মিষ্টি দইয়ের হাঁড়ি, বড় বাক্স ভর্তি নকুড়ের সন্দেশ, আড়াই-তিন কেজির ইলিশ, না হয় কাতলা বা রুই। আর তামাম শ্বশুরকুলের প্রণম্যদের জন্য শাড়ি-জামাকাপড়-সহ অন্যান্য উপহার।
কিন্তু দিনকাল বদলেছে। এখন জামাইবাবুরা একটা কিছু জমকালো অথচ বেশ এথনিক গিফট দিতে চান শাশুড়ি মা ও শ্বশুর মশাইকে। ওই প্যানপ্যানানি সন্দেশ-মিষ্টি, দইয়ের হাঁড়ি আর মাছ এখনকার দিনে ফেড আউট। কেমন এক ভেতো বাঙালি টাইপ আদিখ্যেতা হয়ে যায়। তা ছাড়া এখন নাগালে প্রচুর সুবিধা-সুযোগ, মোবাইলের কি-প্যাডে আঙুলের কারসাজিতে চটজলদি অনলাইনে কেনাকাটার হরেক অফার। তার চেয়ে স্ত্রীকে খানিক উসকে দিয়ে তার মায়ের জন্য নামী দোকানের হালকা সোনার দুল বা পেনডেন্ট। দারুণ ফ্যাশনেবল হবে ব্যাপারটা। তবে এও জামাই বাবাজি ঠারেঠোরে জানে যে, মেয়ে মাকে ওই গয়না বেশি দিন পরতেই দেবে না! কিছু দিন বাদেই নিজের বিয়েতে উপহার পাওয়া একটা অপছন্দের ডিজাইনের দুলের সঙ্গে বদলে নেবে। দিলদার জামাইরা তো আজকাল শ্বশুরবাড়িতে উপহার দিতে বিশেষ হিসেবনিকেশও করেন না। কখনও শৌখিন ব্যাগ, কিচেন গ্যাজেট, ডিনার সেট, বসার ঘরের পুরনো কুশন বা পর্দা পাল্টে একদম নতুন সেট, শ্বশুরমশাইকে বিদেশি শ্যাম্পেন, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল, আইপ়ড, ডিভিডি—কত কিছুই তো দেওয়া যায়। কিছু শৌখিন জামাই আবার উপহার দেওয়ার ব্যাপারে আরও দড়। হয়তো শ্বশুর-শাশুড়িকে চার দিন তিন রাত ট্র্যাভেল প্যাকেজে পাঠিয়ে দিলেন বনভয়েজ-এ। জামাইকেও তো একটু ঠাটবাট, একটু ‘হাটকে পসন্দ’ দেখাতে হবে। তাই না? ছিদ্রান্বেষী নিন্দুকেরা চোখ টাটাল তো ভারী বয়েই গেল! উপহার বিনিময়ে জামাই খুশ। মেয়েও আহ্লাদে গদগদ। শ্বশুর-শাশুড়িরও অপার তৃপ্তি ও ভাল লাগা।
দিন বদলেছে। দু’পক্ষই এখন দু’পক্ষকে দিতে কী বৈভবে, কী দেখনদারিতে টেক্কা দিতে চায়। জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে শপিং মল, দোকানপাট, রেস্তোরাঁয় আহ্লাদের রমরমা। কেনাকাটা, গিফট, রিটার্ন গিফট—কত দেদার আয়োজন! বাড়ির মেয়েটা যেন একটু সুখে-আহ্লাদে থাকে, আরামে থাকে, আনন্দে থাকে, তাই তার ‘কেয়ার অব’ হাজব্যান্ডকে তোয়াজে রাখা আর কী। বচ্ছরকার এই দিনটিতে আমাদের গেরস্তপোষ মননে জামাইদের কিছুটা খাতিরদারি করে, সারা বছরের জন্য মেয়ের ভাল থাকাটা ফের ‘রিনিউ’ করে নেও।
কথাতেই আছে ‘যম-জামাই-ভাগনা- কেউ নয় আপনা। বাঙালি সমাজে এটাই প্রচলিত প্রবাদ।
কিন্তু, নতুন পাখার উপর আমের পল্লব এবং আম ও তৎসহযোগে পাঁচ ধরনের ফল সাজিয়ে জামাই-এর মনঙ্গল কামনায় শাশুড়ির দল ‘জামাই ষষ্ঠী!-র দিনে যে ব্রত রক্ষায় ব্রতী হন তার সারমর্মটা কী?
.
ষষ্ঠী পূজায় ব্রতীরা সকালে øান করে উপবাস থেকে নতুন পাখার ওপর আম্রপল্লব, আমসহ পাঁচফল আর ১০৮টি দুর্বাবাঁধা আঁটি দিয়ে পূজার উপকরণের সঙ্গে রাখে। করমচাসহ পাঁচ-সাত বা নয় রকমের ফল কেটে কাঁঠাল পাতার ওপর সাজিয়ে পূজার সামনে রাখতে হয়। ধান এ পূজার সমৃদ্ধির প্রতীক, বহু সন্তানের প্রতীক হিসেবে ব্যবহƒত হয় এবং দুর্বা চিরসবুজ, চির সতেজ অসীমতার বেঁচে থাকার ক্ষমতার অর্থে ব্যবহƒত হয়। অর্থাৎ দুর্বা হল দীর্ঘ জীবনের প্রতীক। শাশুড়ি-মেয়ে-জামাতার দীর্ঘায়ু কামনা করে ধানদুর্বা দিয়ে উলুধ্বনিসহ ষাট ষাট বলে বরণ করেন। কারণ যম মানুষের মৃত্যু দূত। তাই মেয়ে যাতে সুখে-শান্তিতে তার দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারে এজন্য জ্যৈষ্ঠ মাসে নতুন জামাইকে আদর করে বাড়িতে ডেকে এনে আম-দুধ খাইয়ে পরিতৃপ্ত করে। আশীর্বাদস্বরূপ উপহারসমাগ্রীও প্রদান করে।