বেতার-বার্তায় বিপ্লব: বাঙালির বিজ্ঞানী কৌশিক …………………..।।।

wire-main

 মার্কিন প্রেসিডেন্টের পুরস্কার পাচ্ছেন   কলকাতার কৌশিক চৌধুরী।



বিশ্বের দরবারে তাঁর নামটা ঘোষণা করে গিয়েছেন সদ্য প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
আর তাঁর গলায় পদকটা ঝুলিয়ে দেবেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর মাধ্যমে দু’-দু’জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে গেল কলকাতার
নাম। তিনি কৌশিক। যাদবপুরের কৌশিক চৌধুরী। যাঁর নামটা ঘোষণা করেছেন ও করবেন
দু’-দু’জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কৌশিক কী করেছেন, জানেন? বইপত্তর, মেডেল আর ক্রকারিজে ‘জ্যাম-জমাট’ ক্যাবিনেটের তাকগুলিকে খুব সহজে আর সুন্দর ভাবে সাফ করার উপায় বাতলেছেন!


ওয়্যারলেস রেডিও যোগাযোগের ‘ক্যাবিনেটের সেই সব তাক’


এক লাইনে রাখা হয়েছে কগনিটিভ রেডিওগুলিকে

আর সেই ‘ক্যাবিনেটের তাক সাফ’ করার উপায় বাতলিয়েই বিজ্ঞানী-জীবনের
প্রাথমিক পর্বের কাজকর্মের জন্য আমেরিকার সেরা পুরস্কার- ‘প্রেসিডেন্টস্‌
আর্লি কেরিয়ার অ্যাওয়ার্ড ইন সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’(‘পিইসিএএসই’
বা, ‘পেকাসে’) পাচ্ছেন কলকাতার কৌশিক। হোয়াইট হাউস কৌশিকের নাম ঘোষণা
করেছে, ওই পুরস্কারের জন্য মনোনীত আরও ১০১ জনের সঙ্গে। সম্ভবত মার্চ বা
এপ্রিলে কৌশিকের গলায় পদক আর হাতে সার্টিফিকেট তুলে দেবেন নতুন মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০০৭ সালের পর কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টের
দেওয়া এই বিরল সম্মান পাচ্ছেন কোনও বাঙালি।

কগনিটিভ রেডিওর অআকখ। দেখুন ভিডিও। সৌজন্যে: ড. হাঝেম শাটিলা

ভাবছেন তো, এ আর এমন কী? ক্যাবিনেটের তাকগুলি তো আমি-আপনি সাফ করেই থাকি। নতুনটা আর কী করলেন কৌশিক?

এ বার সেই গল্পটা বলি।

কলকাতার কৌশিক মন সঁপেছেন বেতার যোগাযোগে। আমরা যাকে বলি, ‘ওয়্যারলেস
নেটওয়ার্ক’। বস্টনের বাসিন্দা আমেরিকার নর্থ-ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের
ইলেকট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর
কৌশিকের গবেষণার মূল ক্ষেত্র- ‘কগনিটিভ রেডিও’। যে ভাবে গোটা বিশ্বে
উত্তরোত্তর দুদ্দাড়িয়ে বাড়ছে সেল ফোনের বিক্রি, ব্যবহার, যে ভাবে লাফিয়ে
লাফিয়ে বাড়ছে গ্রাহকের সংখ্যা, তাতে ওয়্যারলেস রেডিও যোগাযোগটা চলে যে
‘হাইওয়ে’ ধরে, সেই ‘মহা-সড়কে’ই এখন ভয়ঙ্কর ‘ট্র্যাফিক-জ্যাম’! ‘টাওয়ার’কে
মাঝখানে রেখে যিনি মোবাইলে ফোন করছেন আর যিনি সেই ফোনটা ধরছেন
(এন্ড-টু-এন্ড), সেই দুই প্রান্তের মধ্যে রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন ঘন ঘন
থমকে যাচ্ছে। ‘মহা-সড়কে’ ভয়ঙ্কর ‘ট্র্যাফিক-জ্যামে’র জন্য! জনসংখ্যার
চাপে ট্র্যাফিক-জ্যাম যেমন এখন বিশ্বের সবক’টি দেশেই অন্যতম প্রধান সমস্যা,
মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও তেমন দুদ্দাড়িয়ে বেড়ে চলায় রেডিও
যোগাযোগের রথের গতিও থমকে যাচ্ছে অসম্ভব জ্যাম-জটে।

বদলে যাচ্ছে সিগন্যালের চরিত্র, গতি ও গুণাগুণ। তীক্ষ্ণতা। কম্পাঙ্কও।
তা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় ট্র্যাফিক-জ্যাম কমাতে যেমন
এখন বিশ্বের সব দেশেই ফ্লাইওভার আর মাল্টি-স্টোরিড ফ্লাইওভার (বহুতল
ফ্লাইওভার) বানানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে, চলছে কর্মযজ্ঞ, রেডিও যোগাযোগের
‘মহা-সড়কে’ও তেমনই ট্র্যাফিক-জ্যাম কমাতে সেখানেও রয়েছে অনেকগুলি ‘বহুতল
ফ্লাইওভার’। প্রযুক্তির পরিভাষায় যার নাম- ‘নেটওয়ার্ক প্রোটোকল স্ট্যাক’
(এনপিএস)। রেডিও যোগাযোগের
সেই ‘বহুতল ফ্লাইওভার’গুলিও এখন কার্যত, হাঁসফাঁস করছে অসম্ভব ট্র্যাফিক-জ্যামে!


কনগনিটিভ রেডিওর যোগাযোগের পথ আর ধাপগুলি

ওয়্যারলেস রেডিও যোগাযোগের ‘মহা-সড়কে’র সেই ভয়ঙ্কর ট্র্যাফিক-জ্যাম
কমাতেই একটি সাড়াজাগানো উপায় বাতলেছেন কৌশিক ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা।
তাঁদের প্রকল্পটির নাম- ‘এন্ড-টু-এন্ড প্রোটোকল ডিজাইন ফর ডাইনামিক
স্পেকট্রাম অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক’। কৌশিক ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণাপত্র
প্রকাশিত হয়েছে তিনটি আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি-জার্নাল- ‘আইইইই ট্রান্সাকশন্স
অন মোবাইল কম্পিউটিং’, ‘আইইইই ট্রান্সাকশন্স অন ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন্স’
এবং ‘আইইইই ট্রান্সাকশন্স অন ভেহিক্যুলার টেকনোলজি’তে। কৌশিকদের গবেষণায়
অর্থ সাহায্য করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর।

কগনিটিভ রেডিও: তত্ত্ব, প্রয়োগ। দেখুন ভিডিও। সৌজন্যে: কৌশিক চৌধুরী

যাদবপুরে জন্ম কৌশিকের। বাবার বদলির চাকরির সূত্রে কৌশিক তার পরেই চলে
যান মুম্বইয়ে। আন্ধেরির ‘সেন্ট ডোমিনিক স্যাভিও’ স্কুল থেকে পাশ করার পর
কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে টেকনিক্যাল ডিগ্রি নিতে কৌশিক ভর্তি হন মুম্বইয়ের
‘ভিজেটিআই’-য়ে। সেখান থেকে ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি নেওয়ার পর
ওহায়োর সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করেন কৌশিক। এর পর ‘জর্জিয়া
ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ থেকে করেন পিএইচডি।

‘ক্যাবিনেটের তাক’গুলি কী ভাবে সাফ করেছেন কৌশিক?


কগনিটিভ রেডিও নেটওয়ার্কের ভিতরের যন্ত্রাংশ

লাইসেন্সড গ্রাহকদের জন্য ট্র্যাফিক-জ্যাম যে সব স্পেকট্রামে

বস্টন থেকে টেলিফোনে কৌশিক আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘ওয়্যারলেস রেডিও
যোগাযোগের ‘মহা-সড়কে’ যে ‘ফ্লাইওভার’গুলি রয়েছে, সেগুলি আদতে
‘মাল্টি-লেয়ারড্‌’। তার অনেকগুলি স্তর রয়েছে। অনেকটা ক্যাবিনেটের মতো! যার
অনেকগুলি তাক রয়েছে। সেখানে আবার এমন তাকও রয়েছে, যেখানে একই সঙ্গে রাখা
যায় বইপত্তর, মেডেল আর ক্রকারিজ। ওই ‘তাক’গুলিকে বলা হয়- ‘অ্যাপ্লিকেশন
লেয়ার’, ‘ট্রান্সপোর্ট’, ‘নেটওয়ার্ক’, ‘লিঙ্ক’ ও ‘ফিজিক্যাল’। আমরা সেই
‘তাক’গুলিকে সাফ করার পথ দেখিয়েছি। যাকে বলে- ‘ক্রস লেয়ার অপটিমাইজেশন অফ
দ্য নেটওয়ার্ক প্রোটোকল স্ট্যাক’। এই পদ্ধতিতে ওয়্যারলেস রেডিও যোগাযোগের
(যার মাধ্যমে চলে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ) ‘ফ্লাইওভার’গুলির জ্যাম-জট ৪০ থেকে
৭২ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব হবে। আর সেটা আমাদের করতে (যাকে বলে,
‘ম্যানুয়ালি’ করা) হবে না। রেডিও সিগন্যাল আপনাআপনিই সেই
‘চ্যানেল-সুইচিং’টা করে নেবে। মানে, কোন ‘ফ্লাইওভার’ ধরে গেলে
‘ট্র্যাফিক-কনজেশন’টা (‘যানজট’) কম হবে, সেই পথ ধরে কত দ্রুত ছোটা যাবে,
ওয়্যারলেস রেডিও সিগন্যাল তা আপনাআপনিই খুঁজে নেবে। আমাদের বলে দিতে হবে
না, রিমোট কন্ট্রোলে। আমাদের ‘গাইড’ করতে হবে না। এই পদ্ধতিটাকেই বলে
‘কগনিটিভ রেডিও’।’’

মোবাইল ফোন ছাড়া কৌশিকের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি-প্রকৌশল আর কী কী ভাবে কাজে লাগতে পারে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে?


কৌশিকদের বানানো
কগনিটিভ রেডিওর ভিতরের যন্ত্রাংশ: অন-বোর্ড প্রসেসর, ফিল্ড প্রোগ্রামেব্‌ল
গেট অ্যারে। মোবাইল, ল্যাপটপের সঙ্গে ফারাকটা যেখানে।

কৌশিক বললেন, ‘‘যুদ্ধক্ষেত্রে যে সব জায়গায় মোবাইল ফোনের টাওয়ার পাওয়া
যায় না বা সেল ফোনের যোগাযোগের ‘মহা-সড়কে’ ভয়ঙ্কর ট্র্যাফিক-জ্যাম হয়,
সেখানে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সামান্য রেডিও দিয়েই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগকে
মসৃণ, নির্ঝঞ্ঝাট, বাধাহীন রাখতে পারবেন জওয়ানরা। জওয়ানদের সঙ্গে আরও সহজে
যোগাযোগ রাখতে পারবেন কর্নেল, মেজররা। এই প্রযুক্তি-প্রকৌশল স্পেকট্রামের
খরচ কমাতে সাহায্য করবে। ট্র্যাফিক-জ্যাম এড়াতে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে
ওয়্যারলেস রেডিও সিগন্যালগুলি তুলনায় ‘ফাঁকা রাস্তা’- ডিজিট্যাল টেলিভিশন
চ্যানেলের ‘রুটে’ আপনাআপনিই ঘুরে যাবে। আর তার জন্য আমাদের ‘ম্যানুয়ালি’
গাইড করতে হবে না।’’

ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থায় শুধু ‘ক্যাবিনেটের তাক’ সাফ করেই ভেল্কি
দেখিয়ে দিলেন কলকাতার কৌশিক। ১০ বছর পর তাঁরই দৌলতে কোনও বাঙালি পেতে চলেছে
মার্কিন প্রেসিডেন্টের পুরস্কার।

অভিনন্দন, কৌশিক!
ছবি  সৌজন্যে: অধ্যাপক কৌশিক চৌধুরী, নর্থ-ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা