বামিয়ানের কাহিনী যেখানে তথাগত অস্ত গিয়েছেন ধর্মের ষাঁড়ের তান্ডবে।

বামিয়ানের কাহিনী যেখানে তথাগত অস্ত গিয়েছেন ধর্মের ষাঁড়ের তান্ডবে

আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস করা কঠিন যে একসময়ে আফগানিস্তান একটি শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশ ছিল।মধ্যএশিয়া এবং আমাদের দক্ষিণ এশিয়া থেকে তীর্থযাত্রী এবং এই ধর্মের মানুষেরা আসতো এই অঞ্চলের আজকের আলোচিত এই বামিয়ান ভূমিতে।তারা এইখানে তৈরী করেছিল মঠ,সম্পর্কিত মূর্তি,পাহাড় কেটে তৈরী করেছিল গুহা যাতে বসে তারা ধ্যান করতো।
বৌদ্ধ ধর্ম আফগানিস্তানে এসেছিল প্রথম শতকে কুশান সাম্রাজ্যের সময়ে। এই বংশের সবচেয়ে বিখ্যাত কণিষ্ক ছিল বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক।সাম্রাজ্য সম্প্রসারের সাথে তার হাত ধরে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার পায় মধ্য এশিয়া পর্যন্ত। ঐতিহাসিক রেশম পথ মানে সিল্ক রোড ধরে কারাকোরাম পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে সুদূর চীন পর্যন্ত এর প্রসার হয়েছিল। 

ইসলামের প্রসার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি বৌদ্ধ ধর্মেকে  পুরো সাফ করে ফেলে এই আফগানিস্তান থেকে। তারপর,শতকের পর শতক কেটে গিয়েছে,যুদ্ধ এবং হিংসার আবাদে একের পর এক বৌদ্ধ মঠ বা নিদর্শনের ধ্বংস হয়েছে। বিবিধ ঐতিহাসিক নিদর্শন এমনকি সুপ্রাচীন সব পারসিক বা এই ভারতীয় সংস্কৃতির ধ্বংস হয়েছে একই ভাবে তবে তার বিষয়ে অন্য কোনো দিন কিছু বলবো আজ বামিয়ান এবং পরবর্তীতে রুস্তমের সিংহাসন বা তখত এ রুস্তম নিয়ে কিছু বলবো।
যে ধ্বংসের কাজকারবার শুরু হয়েছিল ইসলামের সূচনার সময়ে তার হালের পরিণতি তালিবানের হাতে  বামিয়ানের জোড়া বুদ্ধমূর্তির ধ্বংস দিয়ে হয়েছে। আজ বলবো এই বামিয়ানের মূর্তি বা ওই অঞ্চলের উপর। এর জন্য আগের মতোই নির্ভর করেছি কিছু ঐতিহাসি বই যা পেয়েছি আর্কাইভ ডট অর্গ সাইট থেকে আর ইন্টারনেট থেকে। এরই সাথে জুড়েছি পাকিস্তান বা অন্য দেশের কিছু তথ্যসূত্র,ইচ্ছা করেই নিজের দেশের কোনো তথ্যসূত্রকে সংযোজিত করি নি যাতে কারোর কাছে ‘সত্যের অপলাপ’ না মনে হয়।
২০০১ সালে তালিবান গোষ্ঠী এই বামিয়ানের মূর্তিগুলো ধ্বংস করার পরে পৃথিবীর অনেকের নজরে আসে এই শতাব্দী ধরে চলে আসা কর্ম কান্ড। অনেক সভ্য দেশের মনে হতে থাকে ‘আহা,বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে ‘ ,তা সে যাক , আবার বিষয়ে ফিরি। এই বামিয়ান অঞ্চল উপরে যেমন বলেছি,এক সময়ে ছিল বৌদ্ধ ধর্মের একটি তীর্থক্ষেত্রে মতো জায়গা। সপ্তম খ্রিস্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিউ এন স্যাং এটিকে একটি সমৃদ্ধ বৌদ্ধ জনপীঠ বলে বর্ননা করেন। তার ভাষ্যে,গোটা দশেক বৌদ্ধ মন্দির এবং হাজার খানেক স্থায়ী সন্ন্যাসীর একটি আবাসন হিসেবে ছিল এই অঞ্চল। তিনি বর্ননা করেছিলেন,১২০ ফিট এবং ১৭৫ ফিটের দুটো বৌদ্ধ মূর্তির কথা যেইগুলো সোনার রঙে সাজানো আর তার গায়ে দামি এবং উজ্জ্বল মনি মানিক্য দিয়ে সাজানো ছিল। ঐতিহাসিকরা মনে করেন খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যেই ওই দুটি মূর্তি তৈরী হয়েছিল। আরো ধারণা করা হয়,এই মূর্তি দুটো মুখ্য আকর্ষণ ছিল সারা পৃথিবীর বৌদ্ধদের এই অঞ্চলে পরিব্রাজক হিসেবে আসার জন্য।

এই জোড়া মূর্তিদুটি মূলত ওই বালি পাথরের পাহাড়ের খাড়াই ধরে খোদাই করে মানব কাঠামো বানানো। এর অবয়ব মানে বিস্তারিত রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল ওই খোদাই করা অবয়বের উপরে কাঁদামাটি আর তৎকালীন প্লাস্টারের মতো উপকরণ দিয়ে সঙ্গে সূক্ষ্ম কাজের জন্য খড়ের ব্যবহার করা হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই এর ক্ষয় হয়েছিল সময়ের প্রভাবে তবে একটা নিয়মিত পরিচর্যা হতো ওটা আন্দাজ করা যায়। রেশম পথের দিকে মুখ করা এই মূর্তি দুটি স্বাভাবিক ভাবেই ওই পথে সুদূর থেকে আসা মানুষের চোখে পড়ার মতো করেই করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে,এই মূর্তি দুটোর পাদদেশ ধরে তীর্থযাত্রী বা বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা একটি প্রদক্ষিণ করতো ধর্মীয় রীতি পালন করার কারণে। এর কারণ হিসেবে ওই বৌদ্ধ মূর্তির পায়ের কাছে চারিদিকে গোল করে বেদির আকৃতি করে দেওয়ার ভিত্তিতে তারা ওই সিদ্ধান্তে এসেছেন বলে মনে হয়।
নবম শতকে ইসলামের এই অঞ্চলে প্রবেশের পর এই মূর্তিদুটির ধ্বংসের বিবিধ প্রয়াস চলে।  প্রযুক্তিগত কারণে তা সম্ভব হয় নি ,অতঃপর মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বিশেষ উদ্যোগ নেয় এটিকে নষ্ট করতে এবং এরপর ইরানের নাদির শাহ ও একই চেষ্টা করে তবে ওই তৎকালীন প্রযুক্তির বা ধ্বংসের উপকরণের অভাবে তারা এই মহান কাজ করতে পারে নি। এরপর তাদের অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব নেয় আফগান রাজা আব্দুর রহমান। এই লোকটি সফল হয় ওই মূর্তির মুখ পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলতে।

অবশেষে ২০০১ এ তালিবান আমির এবং বর্তমানের নিখোঁজ মোল্লা ওমর তার বিশেষ চেষ্টা শুরু করে।  প্রথমে একদম ট্যাংক থেকে বন্দুক সব এনে গোলা বর্ষণ এবং ক্রমাগত যা কিছু সন্ত্রাসের উপকরণ ছিল সব দিয়ে ওটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে তাতে কোনো কাজ হয় নি। এরপর প্রচুর বিস্ফোরক এবং ধ্বংসের নানান বস্তু দিয়ে কে কটি আর অবশিষ্ট পুরাতাত্বিক নিদর্শন ছিল ঐগুলোকে মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়। ২০০১ এর মার্চ মাসে ওই মূর্তিদুটোর পাদদেশে এবং মূর্তির কাঁধের নানান পাশে বিস্ফোরক রেখে একদম উড়িয়ে দেয় এই ধর্মের আধুনিক ষাঁড়ের দল।এই বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংসে তালিবানদের সাথে যুক্ত ছিল পাকিস্তানি এবং আরব বংশদ্ভুত প্রাণীরা সঙ্গে ছিল চেচেন গোষ্ঠীর উন্মাদরা।

পাকিস্তানের সহি কাগজ থেকে জানতে পারছি এই মূর্তিগুলো কে চাঁদমারি বানিয়ে লাদেন এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ গুলি প্র্যাকটিস করতো। আরো মজার হলো,এই মূর্তিগুলো তালিবান এবং এই লাদেন গোষ্ঠীদের  ভীত করেছিল যে আবার না ওই গুলো মানুষের কাছের হয়ে যায়। আমি বলছি না,পাকিস্তানি পত্রিকা বলছে তাও আবার সেই সময়ের তথ্যসূত্র কে উল্লেখ করে বলছে। সূত্র নিচে দিয়েছি দেখে নিন।প্রসঙ্গত বলা যায়,পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসের অন্যতম নায়ক চেঙ্গিস খান কিন্তু ওটাকে দেখেও নস্ট করে নি!
এই কুকর্মের পরবর্তী পর্যায়ে একটাই ভালো জিনিস হয়েছে ,মূর্তির আড়ালে আরো কিছু গুহা আর দেওয়াল চিত্র আবিষ্কার হয়েছে যা এতদিন মানুষের চোখের অগচরে ছিল।একই সাথে ওই চিত্র গুলো তৈলচিত্র হওয়ায় আগে যে ধারণা ছিল যে তৈলচিত্র ইউরোপেই আগে ব্যবহার শুরু হয়েছিল তার পরিবর্তন হলো!

এই প্রসঙ্গে আরো একটি সুখবর :
২০০৮ সালে তালিবানদের পতন এবং পরবর্তী সরকারের আমলে ফরাসী এবং আফগান যৌথ উদ্যোগে শায়িত বুদ্ধের আরো একটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।পুরাতাত্ত্বিক এবং এই বিষয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়া আনোয়ার খান ফয়েজ ফরাসী প্রযুক্তিবিদ এবং এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সাহায্যে এই উদ্ধার করতে পেরেছেন।সৌভাগ্যের বিষয় ওটা মাটির তলাতে ছিল তাই এই প্রানীগুলো ওটা খুঁজে পায় নি।

আজকের বামিয়ানের এবং ওই গুহাগুলির অবস্থা :
২০০১ সালের ধর্মের ষাঁড়ের তান্ডব এবং ইতিহাসের ধূলিস্যাৎ করার পর এই অপজাতকের দল নজর ফেরায় ওই অঞ্চলে বসবাস করা শিয়া হাজারা জনগোষ্ঠীর নিধন এবং সহি ইসলামের আবাদের জন্য।এই পশুর দল হাজারে হাজারে মেরেছে এই জনগোষ্ঠীর লোক গুলোকে।মরিয়া হয়ে এই  হতভাগ্য মানুষগুলো প্রথমে বিভিন্ন এলাকা এবং এক সময়ে পাকিস্তানের দিকে পালিয়ে গেলেও তালিবানদের পতনের পর আবার ফিরে আসে। ততদিনে তাদের ঘর বাড়ি সব শেষ হয়ে গিয়েছে ,অসহায় এই লোকগুলো আশ্রয় নেয় সেই প্রাচীন গুহাগুলোতে। জীবনধরণের ন্যূনতম সুবিধে ছাড়াও তারা ২০১৫ থেকে বিশ্বাস করছে ওই গুহাগুলোতে। এই লেখার সঙ্গের ছবিগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন একদিকে ইতিহাসের ,মানুষের সভ্যতার বিনাশ এবং মানুষের কি সর্বনাশ করেছে এবং করছে এই ধর্মের ষাঁড় গুলো। 

বুদ্ধ মূর্তির পুনুরুদ্ধারের চেষ্টা
আপাতত বিশেষ আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। জাপানি এবং পরে এক চীনা দম্পতি প্রজেক্টরে ত্রিমাত্রিক বুদ্ধের ছবি ফুটিয়ে বিগত দৃশ্যে ফেরার প্রয়াস করলেও এই অপজাতকরা আবার ফিরে আসতে পারে এই ভয় কোনো পাকাপাকি স্থাপত্য করতে বাধা সৃষ্টি করছে। ধর্মীয় ভাবেও খুব একটা সাড়া পাচ্ছে না কেউ। অথচ স্থানীয় মানুষ চাইছে আবার পর্যটক আসুক ,বামিয়ান আবার গড়ে উঠুক। সম্প্রতি এর চারপাশে মানে বামিয়ানের পাশে একটি হ্রদ আর এই অঞ্চল ধরে স্থানীয় আফগান দর্শনার্থীরা এলেও এখনো বিদেশিরা আসে নি সেই ভাবে।

এই পুনুরুদ্ধারের আরো একটা বড় সমস্যা হলো এই প্রাণীগুলো গোটা খাড়াই ভাগ কে দুর্বল করে ফেলেছে ক্রমাগত গোলা গুলি আর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। যাইহোক ,একটি সার্বিক প্রচেষ্টা চলছে,ইতিমধ্যেই দুটো বুদ্ধ মূর্তির ছোটটার পায়ের অংশ তৈরী হয়ে গিয়েছে। এক সাথে জার্মান প্রযুক্তি ,ইতালির স্থাপত্যবিদ,জাপানের কারিগরি এবং অন্য গোষ্ঠীর মানুষের সাথে অসংখ্য ইতিহাসবিদ আর এই পুনুরুদ্ধারের কাজে আগের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষরা একটা অসাধ্য সাধনের চেষ্টা চালাচ্ছে। দুর্ভাগ্য হলো ওটা হলেও তা হবে একটি নতুন তৈরী করা বস্তু,সেই ইতিহাস আর ফিরে পাওয়া যাবে না ! আফসোস ধর্মের ষাঁড়ের কোনো জায়গায় এই কথা বোঝে না যে ইতিহাস মুছে ইতিহাস কে ভুলিয়ে দেওয়া যায় না !

ইতিমধ্যেই তালিবানের বন্ধু পাকিস্থানের ক্ষমতাতে এসেছে।আশা করি এই কীর্তি আরো সাফল্য পাবে এবার পাকিস্থানেও,সব কিছু নষ্টের দখলে যাবে যতদিন এই নষ্টামি আমাদের অঙ্গনে না আসবে ততদিন আমাদের ঘুম ভাঙ্গবে না তাই আসুন বলি ‘যাক! যা গেছে তা যাক !”

পুনশ্চ : কারোর কাছে তখত এ রুস্তম ( বৌদ্ধ নিদর্শন আবার প্রাচীন পারসিক নিদর্শন ) নিয়ে ভালো বই থাকলে একটু আওয়াজ দেবেন।খুব আগ্রহের কিছু বস্তু আছে যা মিলছে না বৌদ্ধ নিদর্শনের অন্য সব নমুনার সাথে।একটি ছবি ও দিলাম,যারা বোঝার তারা নিশ্চই বুঝবেন !

তথ্যসূত্র :
১. লাদেন এবং মূর্তি ভীতি নিয়ে দেখুন  https://www.dawn.com/news/215984/osama
২. ভেঙ্গে ফেলার পর মনে হলো বড্ড বেশি সর্বনাশ হয়েছে https://www.nytimes.com/2001/03/04/world/over-world-protests-taliban-are-destroying-ancient-buddhas.html
৩. একটু এই সম্পর্কিত আরো কিছু https://www.bbc.com/news/world-asia-31813681
৪. পুনুরুদ্ধারের চেষ্টার উপর জানতে দেখুন https://www.wsj.com/articles/rebuild-afghanistans-giant-buddhas-foot-shaped-pillars-give-legs-to-debate-1411594383
৫. পুনুরুদ্ধার এবং তার সম্পর্কিত আরো কিছু https://www.theguardian.com/world/2015/jan/10/rebuild-bamiyan-buddhas-taliban-afghanistan
৬. ২০০৮ এ তৃতীয় বুদ্ধমূর্তি প্রাপ্তির সূত্র https://www.dawn.com/news/427548।.