বখতিয়ারের ঘোড়া আর গর্বিত বাঙালি মুসলমান।।

ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির আগমণ শুনেই লক্ষণ সেন ভয়ে কাপুরুষের মত পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলে বাংলা মুসলিম শাসনের অধিনে চলে আসে- এরকম ডাঁহা মিথ্যা ইতিহাসকে সামনে রেখে বাঙালি মুসলমানের ছাতি ফুলে ৭২ ইঞ্চি হয়ে যায়! এরকম ইতিহাস মুসলমান ঘরের ছেলেমেয়েরা মুখস্থ করে তাদের জীবনের একদম শুরুতে প্রধান দুই কারণে- এক, নিজেকে একমাত্র মুসলিম পরিচয়ে আবিষ্কার করে মুসলিম বীরত্বে গর্বিত হওয়া, দুই- হিন্দুদের পরাজিত প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে শেখা!

বখতিয়ার খিলজি আদতেই ‘বঙ্গ বিজয়’ করেনি। সে কেবল ১২০৩ ও ১২০৪ সালে নদীয়া ও নবদ্বীপের কিছু অংশ জয় করেছিল মাত্র! এদিকে লক্ষণ সেন ১১৭০ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিল ও রাজত্ব করছিল। ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মিথ মতে এ সময়কালে লক্ষণ সেন মারা গিয়েছিলেন। তাহলে কি করে বখতিয়ার খিলজির ভয়ে লক্ষণ সেন খিড়কি দিয়ে পালিয়েছিল? মুসিলম ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই সিরাজ তার ইতিহাস বইতে লক্ষণ সেনের কাপুরুষের মত পালানোর কাহিনী লেখে বখতিয়ারের নদীয়া জয়ের ৪৩ বছর পর নিজামউদ্দীন ও সামসুদ্দীন নামের দুই ভাইয়ের মুখে শুনে। এই একই বইতে তিনি নিজেই লিখেছেন তখন পর্যন্ত লক্ষণ সেনের বংশধররা পূর্ববঙ্গ রাজত্ব করছিল। ‘তবকাৎ-ই-নাসিরীগ্রন্থ মিনহাজ শেষ করেন ১২৬০ সালে। ১১৭০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে লক্ষণ সেনের তিন পুত্র মাধব সেন, বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেনের পূর্ববঙ্গ শাসনের তাম্রলিপির প্রমান পাওয়া গেছে। তাছাড়া মিনহাজ নিজেই ১২৬০ পর্যন্ত বঙ্গে সেন রাজাদের শাসন চলার কথা স্বীকার করছেন। বোঝাই যাচ্ছে বখতিয়ার খিলজি সুবিশাল বঙ্গের নদীয়া ও নবদ্বীপের খানিকটা দখল করেছিল সামন্তদের পরাজিত করে।
নদীয়া জয়ের কাহিনীও যে অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক সেটা বখতিয়ারের ১৮ জন সৈন্য নিয়ে বাংলা বিজয়ের কথা পড়লেই বোঝা যায়। এই কাহিনী বিশ্বাস করতে হলে প্রচুর কল্পনা শক্তি থাকতে হবে। লক্ষণ সেনের বিরাট সৈন্য বাহিনীর কথা জেনেও বখতিয়ার কি করে মাত্র ১৮ জন সৈন্য নিয়ে নদীয়া-নবদ্বীপ দখল করতে সাহস করলো? এ কারণেই পরবর্তীকালের সমস্ত ঐতিহাসিকরাই বখতিয়ার খিলজিকে ‘বঙ্গ বিজয়ী’ বলেননি। সত্য হলো ত্রয়োদশ শতাব্দির পূর্বে বাংলায় মুসলিম শাসনের কোন অস্বিত্ব পাওয়া যায় না! ১২৮৯ সালেও মধু সেন নামের একজন শাসকের নাম পাওয়া যায় যে পূর্ববঙ্গ শাসন করছিল। কাজেই বেশির ভাগ ঐতিহাসিকের মতে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গের রাজধানী নদীয়া বিজয়ের কাহিনী অলীক মাত্র!
বখতিয়ারের বাংলা বিজয় ও লক্ষণ সেনের খিড়কি দিয়ে কাপুরুষের মত পালানোর গল্প বঙ্গের মুসলিমদের কাছে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে দুরত্ব তৈরি করতে বহূ যুগ ধরে পঠিত হয়ে আসছে এতে কোন সন্দেহ নেই। আজও বাংলাদেশের পাঠ্যবইতে বখতিয়ারের এই কল্পিত বাংলা বিজয় ও লক্ষণ সেনের খিড়কি দিয়ে ‘কাপুরুষের মত’ পালানোর কাহিনী অপরিবর্তিত থেকে যাওয়া সেই সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মিশনকে বাস্তবায়নের চেষ্টা মাত্র!
আসল সত্য হলো: তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষণ সেন বাংলার রাজধানী নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন কারণ নদিয়া ছিল বহিঃশত্রুর কাছ থেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত অঞ্চল। বলা হয়ে থাকে যে নদিয়ায় আসার কিছু আগে রাজসভার কিছু দৈবজ্ঞ পণ্ডিত তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এক তুর্কি সৈনিক তাকে পরাজিত করতে পারে। এতে করে লক্ষণ সেনের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং নদিয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন। লক্ষণ সেনের ধারণা ছিল যে ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদশংকুল অরণ্য দিয়ে কোনো সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নদিয়া আক্রমণ করা সম্ভব নয় কিন্তু বখতিয়ার সেইপথেই তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে আসে। নদিয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে তার সাথে মাত্র ১৮ জন সৈনিকই তাল মেলাতে পেরেছিল। বখতিয়ার সোজা রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হয় এবং দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ কর। এতে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষণ সেন দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেয়।
সুত্র: