জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের রাধাগোবিন্দ চন্দ্র…………………………….।।

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র (১৬ই জুলাই, ১৮৭৮, বাগচর গ্রাম, যশোর৩রা এপ্রিল, ১৯৭৫, দুর্গাপল্লী, বারাসাত) ভারত উপমহাদেশের
সফলতম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একজন। তিনি এ অঞ্চলে পর্যবেক্ষণমূলক
জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তার জন্ম তৎকালীন
ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গে তথা বর্তমান বাংলাদেশে

প্রাথমিক জীবন

রাধাগোবিন্দ ১৮৭৮ সালের জুলাই ১৬ তারিখে বর্তমান বাংলাদেশের যশোর
সদর উপজেলার বকচর (বাগচর নামেও পরিচিত) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা
গোরাচাঁদ স্থানীয় একজন ডাক্তারের সহকারী ছিলেন, আর মা পদ্মামুখ ছিলেন একজন
গৃহিণী। বকচর পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষে রাধাগোবিন্দ যশোর জিলা স্কুলে
পড়াশোনা করেন। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিলনা। বরং রাতের
আকাশের প্রতি আকর্ষন ছিল বেশি। পড়াশোনায় অমনোযোগের কারণে তিন তিন বার
প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ১৮৯৯ সালে তার বয়স যখন মাত্র ২১ বছর তখন তার সাথে মুর্শিদাবাদের
গোবিন্দ মোহিনীর বিয়ে হয়। তখন মোহিনীর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। বিয়ের পর
রাধাগোবিন্দ শেষবারের মত প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নেন এবং এবারও অকৃতকার্য
হন। বারবার অকৃতকার্য হয়ে তিনি পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ
করেন। তার এক ছেলের নাম কাল ও মেয়ের নাম বর্ষা।

জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা

ছোটকাল থেকেই রাধা আকাশের তারা সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন তখন তাদের পাঠ্যবই ছিল চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ। এই গ্রন্থে অক্ষয়কুমার দত্ত রচিত একটি প্রবন্ধ ছিল যার নাম “ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড”। এই প্রবন্ধ পড়ে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।[২][৩] এ ব্যাপারে তিনি তার আত্মজীবনীমূলক পাণ্ডুলিপিতে লিখেছেন,“অক্ষয়কুমার
দত্তের চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়িয়া, নক্ষত্রবিদ হইবার জন্যে আর কাহারো
বাসনা ফলবর্তী হইয়াছিল কিনা জানি না, আমার হইয়াছিল। সেই উদ্দাম ও
উচ্ছৃঙ্খল বাসনার গতিরোধ করিতে আমি চেষ্টা করি নাই।”
১০ বছর বয়সে যশোর
জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি তিনি তারা দেখা শুরু
করেন। বকচরের একতলা বাড়ির ছাদ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি আকাশ দেখতেন।
কিন্তু কোন উপযুক্ত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক শিক্ষা না থাকায় প্রথমদিকে তাকে
বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ১৪ বছর বয়সে তিনি আকাশের তারা চেনার
ব্যাপারে সিদ্ধ হয়ে উঠেন। এই সময় যশোর শহরের উকিল কালীনাথ মুখোপাধ্যায়
তাকে সহায়তা করেন।

কর্মজীবন

পড়াশোনা
শেষ করার পর প্রথম দুই বছর তাকে বেকার জীবন কাটাতে হয়। এরপর যশোর
কালেকটরেট অফিসে খাজাঞ্চির চাকুরি পান। এসময় তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ১৫
টাকা। এ থেকে পরে তিনি ট্রেজারি ক্লার্ক ও কোষাধ্যক্ষের পদে প্রমোশন পান।
অবসর নেবার সময় তার মাসিক বেতন ছিল ১৭৫ টাকা।

হ্যালির ধূমকেতু অন্যান্য অবদান

১৯১০ সালে হ্যালির ধূমকেতু আকাশে আবির্ভূত হয়। প্রথমে খালি চোখে ও পরে একটি বাইনোকুলার দিয়ে রাধাগোবিন্দ তার পর্যবেক্ষণ লিখে রাখলেন। পরে এই নিয়ে লিখলেন একাধিক প্রবন্ধ। তার একই প্রবন্ধ হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।[২]

দুরবিন সংগ্রহ

শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞান শিক্ষক জগদানন্দ রায় তাকে দূরবীন
কেনার পরামর্শ দেন। ১৯১২ সালের দিকে রাধাগোবিন্দ তাঁর বেতনের টাকা ও
খানিকটা জমি বিক্রির টাকা দিয়ে একটি দুরবিন সংগ্রহ করেন। এটি ৩ ইঞ্চি
ব্যাসের একটি প্রতিসরণ দুরবিন ছিল। ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুরবিনটি
ইংল্যান্ডের F. Bernard থেকে মেসার্স কক্স সিপিং এজেন্সি লিমিটেড এর
মাধ্যমে রাগাগোবিন্দের কাছে আসে। রাধাগোবিন্দকে খুব হিসেব করে চলতে হত।
সাংসারিক খরচের দ্বায়িত্ব থেকে আকাশ চর্চায় যা ব্যয় হত তা তিনি লিখে
রাখতেন। সম্পূর্ণ দুরবিনটি দাম পড়েছিল ১৬০টাকা ১০ আনা ৬ পাই। এই হিসেবটি
তাঁর খাতায় লেখা ছিল। প্রথমে মূল দুরবিনটির টিউব ছিল কার্ডবোর্ডের তৈরি।
পরে তিনি আরও ৯৬ টাকা ১০ আনা খরচ করে ইংল্যান্ডের মেসার্স ব্রহহার্স্ট এণ্ড
ক্লার্কসন থেকে পিতলের টিউব আনিয়ে নেন এবং দুরবিনটির উন্নতি সাধন করেন।
রাধাগোবিন্দের নথিপত্রে তাঁর নিজের হাতের লেখায় তিনি লিখে গেছেন: “সন ১৩১৯
সালের আশ্বিন মাসে দুরবিন আসার পরে রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের নক্ষত্রবিদ্যা
অনুশীলনের ৪র্থ পর্ব আরম্ভ। এই সময়ে তিনি কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের
‘ভগোলচিত্রম’ ও ‘তারা’ পুস্তকের সাহায্যে এটা-ওটা করিয়া যুগল নক্ষত্র,
নক্ষত্র-পুঞ্চ নীহারিকা, শনি, মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহ দেখিতেন। পরে জগদানন্দ
রায়ের উপদেশ মত স্টার অ্যাটলাস এবং ওয়েব’স সিলেসিয়াল অবজেক্ট ক্রয়
করিয়া যথারীতি গগন পর্যবেক্ষণ করিতে আরম্ভ করেন। কিন্তু ইহাতেও তাঁহার
কার্য্য বেশীদূর অগ্রসর হয় নাই। তবে তিনি এই সময়ে গগনের সমস্তরাশি
নক্ষত্র ও যাবতীয় তারা চিনিয়া লইয়াছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট তারায়
দুরবিন স্থাপনা করিতে পারিতেন।”[৪]

নোভা অ্যাকুইলা-৩ আবিষ্কার

জুন ৭, ১৯১৮
সালে তিনি আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পেলেন যা তার নক্ষত্রের
মানচিত্রে ছিল না। তিনি তার এই পর্যবেক্ষণের কথা হাভার্ড মানমন্দিরে জানান
এবং এভাবেই নোভা অ্যাকুইলা-৩ ১৯১৮ আবিস্কৃত হয়। পরে তাকে আমেরিকান এসোসিয়েসন অফ ভেরিয়েবল স্টার অবজারভার (‘American Association of Variable Star Observers'(AAVSO)) সম্মানসূচক সদস্যপদ প্রদান করে। ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪
এর মধ্যে তিনি ৩৭২১৫টি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন এবং এসব তথ্য
আভসো (AAVSO)কে প্রদান করেন। তার এওই কার্যক্রমের জন্য তিনি সর্বোচ্চ
গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত আভসোর এক
তালিকাভুক্ত হন, যাতে আরও ২৫ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী যারা ১০,০০০ বেশি
পরিবর্তনশীল তারা দেখেছেন।[২]

বাংলাদেশ ত্যাগ

বাংলাদেশে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেও ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের পরে পাকিস্তানভারত সৃষ্টির কিছুকাল পর তিনি ভারতে চলে যান। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে তিনি ১৯৬০ সালে ভারতে যান। এসময় তিনি অবসর জীবনযাপন করছিলেন। যশোরের তৎকালীন জেলা কমিশনার
এম.আর. কুদ্দুস সহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা তাকে ভারতে চলে যেতে
বলেছিলেন। মার্কিন সরকার তাকে একটি দূরবীন উপহার দিয়েছিলো। এছাড়া তিনিও
জমি বিক্রি করে একটি দূরবীন কিনেছিলেন। ভারতে যাবার সময় তিনি দূরবীন নিয়ে
যান। কিন্তু বেনাপোল বন্দরে কাস্টম্‌স তার দূরবীন জবরদস্ত করে। এরপর ভারতে যেয়ে তিনি আমেরিকাফ্রান্স সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। যশোরের ডিসি বাড়িতে এসে তার দূরবীন ফেরত দিয়ে যান।

স্বীকৃতি

১৯২৬ সালে হাভার্ড মানমন্দির
থেকে তাকে একটি ছয় ইঞ্চি ব্যাসের দূরবীন পাঠানো হয়। দূরবীনের সঙ্গে
হাভার্ড মানমন্দিরের পরিচালক হ্যারলো শ্যাপলির লেখা চিঠি – “বিদেশ থেকে
পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সম্পর্কে আমরা যে সব পর্যবেক্ষন মূলক তথ্য পেয়ে থাকি
তার মধ্যে আপনার দান অন্যতম। আপনাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।”।
ফরাসি সরকার ১৯২৮ সালে পরিবর্তনশীল নক্ষত্রের ওপর তার কাজের জন্য তাকে OARF (Officer d’Academic Republic Francaise) পদক প্রদান করে।

মৃত্যু

১৯৭৫ সালের এপ্রিল ৩ তারিখে ৯৭ বছর বয়সে একরকম বিনা চিকিৎসায় ভারতের বারাসাতে রাধাগোবিন্দ মৃত্যুবরণ করেন। শেষ বয়সে তার বেশ আর্থিক অনটন দেখা দিয়েছিলো।

প্রকাশিত গ্রন্থ

  • ধূমকেতু

এছাড়া বেশ কিছু অপ্রকাশিত পাণ্ডলিপি রয়েছে।