উপমহাদেশের বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন দার্শনিক ‘চাণক্য’……………….।।।

এযাবৎ যতজন পণ্ডিত-রত্নের কথা আমরা জানি, তাঁদের মধ্যে
চাণক্য-পণ্ডিতকেই সবচাইতে প্রতিভাবান ও বাস্তববাদী বলে মনে হয়। তাঁর
অবস্থিতিকাল কালিদাস যুগেরও আগে। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর কূটনৈতিক পরিকল্পনায়
সিদ্ধহস্ত এই অসাধারণ প্রতিভাধর পণ্ডিত চাণক্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো
(vishnugupta) বিষ্ণুগুপ্ত (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০- খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৩)।প্রাচীন
ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা তিনি । উনি যে সব
উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেন সেগুলো চাণক্য-শ্লোক নামে পরিচিত।


জন্ম——-সংক্ষিপ্ত পরিচিতি——কর্ম জীবন——অবদান—–চাণক্য-শ্লোক

চাণক্য’ প্রাচীন ভারতের কূটনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম। এই বিজ্ঞ ও
প্রতিভাধর ব্রাহ্মণের জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলায়, বর্তমান
ইসলামাবাদের ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ও রাওয়ালপিন্ডির কিছু উত্তরপশ্চিমে।
তক্ষশিলার কাছেই ছিল গান্ধার নগর ও পুস্কলাবতী, মানে বর্তমান পেশওয়ার।
চণক-ঋষির ঔরসে মহামতি চাণক্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০- খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ )
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন। চণক-ঋষির পুত্র বলেই তাঁর
নাম হয় ‘চাণক্য’। তাঁর জন্মগ্রাম ‘চানকা’ থেকে ‘চাণক্য’ নাম হয়েছে বলেও
অনুমান করা হয়। বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। কারণ এ নামটিই
দিয়েছিলেন তার বাবা মা। চাণক্যের বিখ্যাত ছদ্মনাম ‘কৌটিল্য’।
কর্তব্যনিষ্ঠা ও কুটিলবুদ্ধি পরায়ণ বলে তিনি এ নামে অভিহিত। ‘কুটিলা’
গোত্রভুক্ত হওয়ার কারণে তাঁর ‘কৌটিল্য’ নাম হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।

প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা হিসেবে তিনি
তাঁর কালজয়ী সংস্কৃত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’ কিভাবে একজন শাসককে আরো ভূখণ্ড
ও মূল্যবান সম্পদ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে তাঁর প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ
ও জীবনমান উন্নত করার জন্য কাজ করতে হবে তা লিপিবদ্ধ করেন। নামে
অর্থশাস্ত্র হলেও গ্রন্থটি মূলত শাসকের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতি
বিষয়ক কৌশলের পরামর্শ। চাণক্য লিখেছিলেন ১৫ পর্বের রাষ্ট্রনীতি
নিয়ে গ্রন্থ: অর্থশাস্ত্র। অনেকেই মনে করেন চাণক্যই অর্থনীতির জনক। তাকে
ভারতীয় ম্যাকিয়াভেলিও বলা হয়।

সে সময়ে মগধে ‘নন্দবংশ’ নামে এক রাজবংশ ছিল। ঐ রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন
ধনানন্দ। ধনানন্দের সৎভাই ছিলেন (পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী ‘মুরা’র
গর্ভজাত) চন্দ্রগুপ্ত। চন্দ্রগুপ্তর পুরো নাম চন্দ্রগুপ্ত মোরা। মোরা মানে
ময়ূর। তা থেকে মৌর্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর পূর্বপুরুষেরা ছিল বিন্ধ্যপর্বতে।
ময়ূর পালন করত। রাজা ধনানন্দ প্রজাদের কাছে প্রিয় ছিলেন না। পিতা
মহাপদ্মের মৃত্যুর পর তিনি দাসীমাতা মুরা ও সৎভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে
তাড়িয়ে দেন। অপমানিত চন্দ্রগুপ্ত তার ভাই ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের
সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হন এবং জীবন
বাঁচাতে জঙ্গলে গিয়ে নির্বাসিত জীবন-যাপন করতে থাকেন।

মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য একজন ব্রাহ্মণের
প্রয়োজন হয়। ব্রাহ্মণ সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে মন্ত্রী শকটার উপর। তিনি
চাণক্যকে মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার অনুরোধ জানান। সে
অনুরোধ অনুযায়ী চাণক্য যথাসময়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে পুরোহিতের আসন
গ্রহণ করেন। চাণক্যের চেহারা খুব ভাল ছিল না। পুরোহিতের আসনে কদাকার
ব্রাহ্মণ চাণক্যকে দেখে মহারাজ ধনানন্দ ভীষণ ক্রুদ্ধ হন এবং তাকে তিরস্কার
করে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। পণ্ডিত চাণক্য প্রথমে রুষ্ট না হয়ে
মহারাজাকে হিতবাক্যে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজা ধনানন্দ কোন প্রবোধ
না মেনে অপর লোক দ্বারা চাণক্যকে যথেষ্ট অপমান করেন। চাণক্য ক্রুদ্ধ হয়ে
সেখান থেকে চলে আসেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করেন।

এদিকে তরুণ ও উচ্চাভিলাষী চন্দ্র গুপ্ত, যিনি নন্দ রাজার পদস্থ সামরিক
কর্মকর্তা ছিলেন, তিনিও ষড়যন্ত্র করছিলেন সিংহাসন দখলের। কিন্তু তার
ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং জীবন বাঁচাতে তাকে পালাতে হয়। চন্দ্র গুপ্ত যখন
বিন্ধানের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে
চানক্যের সাথে তার সাক্ষাত্‍ হয়। চন্দ্রগুপ্ত তার সমস্ত কথা চাণক্যের কাছে
খুলে বলেন এবং ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলে চাণক্যের পরামর্শ ও
সাহায্য কামনা করেন। চাণক্য ছিলেন প্রখর প্রতিভাধর কুটিলবুদ্ধি-সম্পন্ন
পণ্ডিত। চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যকে তার গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে
মেনে নেন। চাণক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত ক্রমে একটি শক্তিশালী
সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং গুরু চাণক্যের সুনিপুণ পরিকল্পনা অনুসারে
ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখল করেন। যে পরিস্থিতিতে চন্দ্র গুপ্ত
নন্দ বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তা
অত্যন্ত চমত্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে পঞ্চম শতাব্দীতে লিখিত একটি
রাজনৈতিক নাটক ‘মুদ্রা রাক্ষস’এ। এ নাটকের রচয়িতা বিশাখাদত্ত নামে এক
প্রাচীন নাট্যকার। চন্দ্র গুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং
পাটলিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পারিণত করেন। পাটলিপুত্র বিহারের
আধুনিক শহর পাটনার কাছেই অবস্থিত ছিল। সিংহাসনে আরোহন করার পর মাতা ‘মুরা’র
নামানুসারে (নন্দবংশের পরিবর্তে) রাজবংশের নামকরণ করেন ‘মৌর্যবংশ’ এবং
পণ্ডিত চাণক্যকে করেন তার রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে
খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্র গুপ্ত রাজ্য শাসন করেন। তার সময়কালে
সমগ্র রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিল, প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন
ন্যায়পরায়ণ এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিল সমৃদ্ধিতে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত
লিপিবদ্ধ করে গেছেন চন্দ্র গুপ্তের দরবারে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস
তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে। আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে গ্রিক শাসনের
বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিদ্রোহের সূচনা হয় এবং এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে
চন্দ্র গুপ্ত গ্রিক বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন ও
পাঞ্জাবকে নিজ শাসনাধীনে আনেন। পরে চন্দ্র গুপ্ত একে একে পশ্চিম ভারতের সকল
রাজ্য বিজয় করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সাম্রাজ্য
দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্যে তিনি একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন চানক্যকে
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করে।

চন্দ্রগুপ্তের গুরু ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাণক্য বিলাসবহুল জীবন
কাটাতে পারতেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে। কিন্তু তিনি তা না করে একটি শ্মশানে
কুড়েঘরে সন্ন্যাসীর মত জীবন-যাপন করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুতুল্য।’

চাণক্যের অর্থবিষয়ক জ্ঞানের সংকলন হচ্ছে অর্থশাস্ত্র। এ শাস্ত্রে আছে
শাসকের উদ্দেশ্যে পরামর্শ, প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবনমান উন্নতকরার
কৌশল। চাণক্য তার অর্থশাস্ত্রে রাজাকে এভাবে পরামর্শ দিয়েছেন- ‘যে রাজা
শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার
পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।’
‘সকল উদ্যোগ
নির্ভর করে অর্থের উপর। সে জন্য সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেওয়া উচিত
খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরুপ বা অর্থ আত্মসাতের চল্লিশটি পদ্ধতি আছে।
জিহ্বার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোন
রাজকর্মচারীর পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না-খেয়ে ফেলার ঘটনা
অসম্ভব ব্যাপার। পানির নিচের মাছের গতিবিধি বোঝা যেমন অসম্ভব,
রাজকর্মচারীর তহবিল তসরুপ বোঝাও তেমনি অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির
উড্ডয়ন দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজকর্মচারীর গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত
হওয়া অসম্ভব।’


এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন দার্শনিক ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক
আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেছেন। এ ধরণের
একটি সংকলনের নাম ‘চানক্য নীতি দর্পণ’।

চাণক্য-শ্লোকঃ

১. অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না।

২. অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।

৩. অনেকে চারটি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও আত্মাকে জানে না, হাতা যেমন রন্ধন-রস জানে না।

৪. অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।

৫. অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাচ্ঞায় সম্মান-নাশ হয়, দারিদ্র্যে বুদ্ধিনাশ হয়।

৬. অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্ণে ভোজন, দরিদ্রের সভায় বা মজলিশে কালক্ষেপ এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।

৭. অহংকারের মত শত্রু নেই।

৮. আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্নপ্রকৃতি-কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।

৯. আদর দেওয়ার অনেক দোষ, শাসন করার অনেক গুণ, তাই পুত্র ও শিষ্যকে শাসন করাই দরকার, আদর দেওয়া নয়।

১০. আপদের নিশ্চিত পথ হল ইন্দ্রিয়গুলির অসংযম, তাদের জয় করা হল সম্পদের পথ, যার যেটি ঈপ্সিত সে সেই পথেই যায়।

১১. আড়ালে কাজের বিঘ্ন ঘটায়, কিন্তু সামনে ভাল কথা বলে, যার উপরে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।

১২. ইন্দ্রিয়ের যে অধীন তার চতুরঙ্গ সেনা থাকলেও সে বিনষ্ট হয়।

১৩. উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য।

১৪. উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।

১৫. ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।

১৬. একটি দোষ বহু গুণকেও গ্রাস করে।

১৭. একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বন ভস্মীভূত হয়, তেমনি একটি কুপুত্রের দ্বারাও বংশ দগ্ধ হয়।

১৮. একটিমাত্র পুষ্পিত সুগন্ধ বৃক্ষে যেমন সমস্ত বন সুবাসিত হয়, তেমনি একটি সুপুত্রের দ্বারা সমস্ত কুল ধন্য হয়।

১৯. একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একটি গুণী পুত্র বরং ভাল। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সকল তারা মিলেও তা পারে না।

২০. কর্কশ কথা অগ্নিদাহের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

২১. খেয়ে যার হজম হয়, ব্যাধি তার দূরে রয়।

২২. গুণবানকে আশ্রয় দিলে নির্গুণও গুণী হয়।

২৩. গুণহীন মানুষ যদি উচ্চ বংশেও জন্মায় তাতে কিছু আসে যায় না।
নীচকুলে জন্মেও যদি কেউ শাস্ত্রজ্ঞ হয়, তবে দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন।

২৪. গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনও জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।

২৫. গৃহে যার মা নেই, স্ত্রী যার দুর্মুখ তার বনে যাওয়াই ভাল, কারণ তার কাছে বন আর গৃহে কোনও তফাৎ নেই।

২৬. চন্দন তরুকে ছেদন করলেও সে সুগন্ধ ত্যাগ করে না, যন্ত্রে ইক্ষু
নিপিষ্ট হলেও মধুরতা ত্যাগ করে না, যে সদ্বংশজাত অবস্থা বিপর্যয়েও সে
চরিত্রগুণ ত্যাগ করে না।

২৭. তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয়: নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, জপ, আর দান এই তিন বিষয়ে যেন কোনও সন্তোষ না থাকে।

২৮. দারিদ্র্য, রোগ, দুঃখ, বন্ধন এবং বিপদ- সব কিছুই মানুষের নিজেরই অপরাধরূপ বৃক্ষের ফল।

২৯. দুর্জনের সংসর্গ ত্যাগ করে সজ্জনের সঙ্গ করবে। অহোরাত্র পুণ্য করবে, সর্বদা নশ্বরতার কথা মনে রাখবে।

৩০.দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।

৩১.দুষ্টা স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সসর্প-গৃহে বাস মৃত্যুর দ্বার, এ-বিষয়ে সংশয় নেই।

৩২. ধর্মের চেয়ে ব্যবহারই বড়।

৩৩. নানাভাবে শিক্ষা পেলেও দুর্জন সাধু হয় না, নিমগাছ যেমন আমূল জলসিক্ত করে কিংবা দুধে ভিজিয়ে রাখলেও কখনও মধুর হয় না।

৩৪. পরস্ত্রীকে যে মায়ের মত দেখে, অন্যের জিনিসকে যে মূল্যহীন মনে করে এবং সকল জীবকে যে নিজের মত মনে করে, সে-ই যথার্থ জ্ঞানী।

৩৫. পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।

৩৬. পাঁচ বছর বয়স অবধি পুত্রদের লালন করবে, দশ বছর অবধি তাদের চালনা করবে, ষোল বছরে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করবে।

৩৭. পুত্র যদি হয় গুণবান, পিতামাতার কাছে তা স্বর্গ সমান।

৩৮. পুত্রকে যাঁরা পড়ান না, সেই পিতামাতা তার শত্রু। হাঁসদের মধ্যে বক
যেমন শোভা পায় না, সভার মধ্যে সেই মূর্খও তেমনি শোভা পায় না।

৩৯. বইয়ে থাকা বিদ্যা, পরের হাতে থাকা ধন একইরকম। প্রয়োজনকালে তা বিদ্যাই নয়, ধনই নয়।

৪০. বিদ্বান সকল গুণের আধার, অজ্ঞ সকল দোষের আকর। তাই হাজার মূর্খের চেয়ে একজন বিদ্বান অনেক কাম্য।

৪১. বিদ্যাবত্তা ও রাজপদ এ-দুটি কখনও সমান হয় না। রাজা কেবল নিজদেশেই সমাদৃত, বিদ্বান সর্বত্র সমাদৃত।

৪২. বিদ্যা ব্যতীত জীবন ব্যর্থ, কুকুরের লেজ যেমন ব্যর্থ, তা দিয়ে সে গুহ্য-অঙ্গও গোপন করতে পারে না, মশাও তাড়াতে পারে না।

৪৩. বিদ্যাভূষিত হলেও দুর্জনকে ত্যাগ করবে, মণিভূষিত হলেও সাপ কি ভয়ঙ্কর নয়?

৪৪. বিদ্যার চেয়ে বন্ধু নাই, ব্যাধির চেয়ে শত্রু নাই। সন্তানের চেয়ে স্নেহপাত্র নাই, দৈবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বল নাই।

৪৫. বিনয়ই সকলের ভূষণ।

৪৬. বিষ থেকেও অমৃত আহরণ করা চলে, মলাদি থেকেও স্বর্ণ আহরণ করা যায়,
নীচজাতি থেকেও বিদ্যা আহরণ করা যায়, নীচকুল থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা
যায়।

৪৭. ভোগবাসনায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়।

৪৮. মিত ভোজনেই স্বাস্থ্যলাভ হয়।

৪৯. যশবানের বিনাশ নেই।

৫০. যাঁরা রূপযৌবনসম্পন্ন এবং উচ্চকুলজাত হয়েও বিদ্যাহীন, তাঁরা সুবাসহীন পলাশ ফুলের মত বেমানান।

৫১. যে অলস, অলব্ধ-লাভ তার হয় না।

৫২. যে গাভি দুধ দেয় না, গর্ভ ধারণও করে না, সে গাভি দিয়ে কী হবে! যে বিদ্বান ও ভক্তিমান নয়, সে পুত্র দিয়ে কী হবে!

৫৩. রাতের ভূষণ চাঁদ, নারীর ভূষণ পতি, পৃথিবীর ভূষণ রাজা, কিন্তু বিদ্যা সবার ভূষণ।

৫৪. শাস্ত্র অনন্ত, বিদ্যাও প্রচুর। সময় অল্প অথচ বিঘ্ন অনেক। তাই যা
সারভূত তারই চর্চা করা উচিত। হাঁস যেমন জল-মিশ্রিত দুধ থেকে শুধু দুধটুকুই
তুলে নেয়, তেমনি।

৫৫. সত্যনিষ্ঠ লোকের অপ্রাপ্য কিছুই নাই।

৫৬. সত্যবাক্য দুর্লভ, হিতকারী-পুত্র দুর্লভ, সমমনস্কা-পত্নী দুর্লভ, প্রিয়স্বজনও তেমনি দুর্লভ।

৫৭. সাপ নিষ্ঠুর খলও নিষ্ঠুর, কিন্তু সাপের চেয়ে খল বেশি নিষ্ঠুর।
সাপকে মন্ত্র বা ওষধি দিয়ে বশ করা যায়, কিন্তু খলকে কে বশ করতে পারে?

৫৮. সুবেশভূষিত মূর্খকে দূর থেকেই দেখতে ভাল, যতক্ষণ সে কথা না বলে ততক্ষণই তার শোভা, কথা বললেই মূর্খতা প্রকাশ পায়।

৫৯. হাতি থেকে একহাজার হাত দূরে, ঘোড়া থেকে একশ হাত দূরে, শৃঙ্গধারী
প্রাণী থেকে দশহাত দূরে থাকবে। অনুরূপ দুর্জনের কাছ থেকেও যথাসম্ভব দূরে
থাকবে।