বিদ্যারূপেন।

বিদ্যারূপেন

ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।”
(অথর্ববেদ ১১.৫.১৮)
অর্থাত্‍ ঠিক যেমন যুবক ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদুষী কন্যাকে বিয়ে করবে ঠিক তেমনি একজন যুবতীও ব্রহ্মচর্য শেষ করে পছন্দমত বিদ্বান যুবককে স্বামী হিসেবে গ্রহন করবে।

পাণিনি তার সংস্কৃত ব্যকরন শাস্ত্রে ছাত্রীদের ব্রহ্মচর্যের প্রতিষ্ঠান ছাত্রীশালা ও এর মহিলা অধ্যাপক আচার্যনি এর এর উল্লেখ করেছেন-

“মাতুলাচার্যাণামানুক্ত”
পাণিনি ৪.১.৪৬

এবং “ছাস্যাদযঃ ছাত্রীশালাযাম্”
পাণিনি ৬.২.৭৬

ব্রহ্মচারিনী ছাত্রীদের নারী শিক্ষক উপদেষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদ ১.৩.১১,১০.১৫৬.২ প্রভৃতিতে।

“চেতন্তি সুমতিনাম যজ্ঞম দধে সরস্বতী”
>ঋগ্বেদ ১.৩.১১
এখানে নারী শিক্ষিকাকে জ্ঞানদাত্রী ও প্রেরনাদাত্রীরুপে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।

পবিত্র বেদ ও শতপথ ব্রাহ্মনে আমরা দেখতে পাই যে কিভাবে গার্গী,মৈত্রেয়ী,অত্রেয়ী,বাক,অপালাসহ বিভিন্ন নারীরা ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে ঋষি পর্যায়ে উন্নীত হন।

উত্তররামচরিতমানস এর ২.৩ এ পাওয়া যায় ঋষিনী অত্রেয়ী বলছেন,
“এই অঞ্চলে অগস্ত্যসহ অনেক বিখ্যাত মহর্ষি আছেন।আমি মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম থেকে এখানে এসেছি তাঁদের কাছ থেকে বেদ অধ্যয়ন করতে।”

ওঁ শুদ্ধ পুত যোসিত যজ্ঞিয়া ইমা ব্রাহ্মনম হস্তেষু প্রপ্রতক সদায়মি।
যত্‍কামা ইদমাভিসিন্চমি বো হামিন্দ্রো মরুত্বন্স দদাতু তন্বে।। ওঁ

আমার সকল কন্যাগন পবিত্র,ধর্মনিষ্ঠ,সকল ধর্মানুষ্ঠান(যজ্ঞাদি) পালনে যোগ্য।তাঁরা সকলে পবিত্র বেদ মন্ত্র নিষ্ঠার সহিত পাঠ করবে।তাঁদের সকলে বিদ্বান গুরুর নিকট বিদ্যালাভ করবে।ঈশ্বর তাদের নৈবেদ্য গ্রহন করবেন।

এর চেয়ে সুস্পষ্ট প্রমান আর কি হতে পারে বৈদিক শাস্ত্রে নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য পালনের?বৈদিক যুগে, উপনিষদের যুগে দেখতে পাব- মৈত্রেয়ী গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয়া মেয়েরা ব্রম্মবিচারে ঋষিস্থানীয়া হয়ে রয়েছেন। হাজার বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সভায় গার্গী সগর্বে যাজ্ঞবল্ককে ব্রম্মবিচারে আহবান করেছিলেন।………মেয়েদের পূজা করেই সব সব জাত বড় হয়েছে।

আজ এক ব্রহ্মবাদিনী নারীর কথা বলি।

মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। রাজা স্বয়ভূব মনু জিজ্ঞাসা করলেন – মা, কাকে তোমার পছন্দ হয়?

তখনকার দিনে মেয়েরা স্বয়ম্বরা হোত। রাজকন্যা দেবহুতি বললেন – তেমন কোন রাজপুত্র তো দেখছি না, বাবা।

–রাজপুত্র ছাড়া অন্য কোন পাত্র?

–তাহলে কর্দম ঋষি….

মনু তখনই চললেন কর্দম ঋষির কাছে। কর্দম অল্পবয়সেই পাণ্ডিত্যে বিশেষ খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বিদ্যার অভিমান তাঁর ছিল না, মনুর অনুরোধ তিনি রক্ষা করলেন।

রাজার মেয়ে দেবহুতির সাথে আশ্রমবাসী সন্ন্যাসী কর্দমের বিয়ে হয়ে গেল। রাজপ্রাসদের বিলাস ছেড়ে রাজকন্যা স্বেচ্ছায় স্বামীর তপোবনে গিয়ে উঠলেন।।

কথা উঠলো —  নির্জন অরণ্যে রাজকন্যার কত না কষ্ট হবে।

দেবহুতি বলেলেন – রাজার মত ঐশ্বর্যের আকাঙ্খা থাকলে কোন রাজপুত্রকেই বিয়ে করতাম, কিন্তু তাতো আমি চাই না। আমি চাই জ্ঞান, জ্ঞানচর্চার জন্য অরণ্যের নির্জনতাই শ্রেষ্ঠ। সেইজন্যই আমি ঋষির আশ্রমকেই পছন্দ করেছি।

দেবহুতি ছেলেবেলা থেকেই বিদ্যাচর্চায় বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। নির্জন তপোবনে স্বামীর পাশে বসে জ্ঞানচর্চা চললো সমভাবেই। ভারতের মহীয়সী মহিলাদের মধ্যে তাঁর নামও যুক্ত হয়ে পড়লো অজানিতে।

আশ্রমের কাজ আর স্বামীর সেবা করার পর যে অবসরটুকু তিনি পেতেন, তারই মাঝে চিন্তা ও অনুশীলনের দ্বারা এক নতুন ভাবধারার উন্মেষ হোল তাঁর চিত্তে। সেই ভাবধারাকে তিন পূর্ণতা দিতে না পারলেও তাঁর পুত্র তাকে পূর্ণতা দিল—সাংখ্যদর্শনে।

দেবহুতির পুত্র কপিলই এই দর্শনের জনক। মানুষের মনকে বিশ্লেষণ করে তিনিই প্রথম দুঃখের কারণ নির্ণয় করেন ও মুক্তির সন্ধান দেন তাঁর সাংখ্যাসূত্র-তত্ত্বমাসে।

কত রাজবংশ, কত সিংহাসন ভারতভূমির ধূলার মাঝে হারিয়ে গেছে, কিন্তু হাজার হাজার বছরের বিপ্লব ও মহাকালের আবর্তনকে উপেক্ষা করে বেঁচে আছেন কপিলের মা দেবহুতি। তাঁর উপলব্ধিই সত্য হয়েছে—সিংহাসনের সোনার চেয়েও পুঁথির পাতা ওজনে ভারী।

চরিত্রগুলি হয়তো ইতিহাসের পাতায় ধূসর ছবি। আমাদের আধুনিক জীবনে চরিত্রের ভিড়ে ঠাসা স্মৃতির কোষগুলিতে এঁদের কোনো স্থান নেই। হয়তো এঁরা অপাংক্তেয় হয়েই বাইরে অপেক্ষা করেন, কখন কে পড়বে এঁদের জীবনগাথা।

(সূত্র- বৃহদারণ্যক উপনিষদ)