বাঙালি নদীমাতৃক তো বটেই। কিন্তু শুধু নদীমাতৃক নয়, বাঙালি মোহনার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। গৌড়ান্ সমুদ্রাশ্রয়ান্। সরস্বতী সভ্যতার মোহনা অঞ্চলেই সবথেকে বেশি মাতৃকামূর্তি মিলেছে (লোথালে সবথেকে বেশি, যদিও সরস্বতীর মোহনা আর একটু উত্তরে ঢোলাভিরা অঞ্চলে ছিল)। এদিকে পাণ্ডুরাজার ঢিবি হোক বা চন্দ্রকেতুগড়, প্রত্যেকটি প্রত্নসাক্ষ্য সেই মাতৃকা-উপাসনার, প্রকৃতি-উপাসনার দিকে নির্দেশ করে, অর্থাৎ বাঙালিত্বের দিকেই নির্দেশ করে।
এই কথাগুলো সাতচল্লিশ বা একাত্তরে উদ্বাস্তুর ঢল নামার সময়, বাঙালির শেকড়চ্যুত হওয়ার সময় যদি আমাদের ডিসকোর্সের অঙ্গ হত, তাহলে উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্যে গিয়ে কষ্ট পেতে হত না হয়ত। মরিচঝাঁপিকে অ্যামেরিকার চক্রান্ত বলে প্রমাণার্থে সেযুগে সিপিএম প্রচুর বেগ পেয়েছিল। বাঙালির যে অনেক সহস্র বছরের জেনেটিক প্রবণতা আছে নদীমাতৃক এবং ব-দ্বীপ সভ্যতা গড়ে তোলার, সে কথা জানা থাকলে সম্ভবত দণ্ডকারণ্য থেকে সুন্দরবনে চলে আসা লোকজনের পেছনে পুঁজিবাদী চক্রান্ত আবিষ্কার করতেন না কমরেডরা।
একটি জাতির আত্মপরিচয়ের কাঠামো নির্মাণ বন্ধ হয়ে গেলে এই ক্ষতি হয়। বাংলা ভাষার জন্য ধ্রুপদীর মর্যাদা তো ছেড়েই দিন, ও যুদ্ধ অর্থহীন, উড়েরা বাঙালির ইতিহাস দখল করার যুদ্ধে সম্পূর্ণ সফল। কিন্তু আমি বলছি, এই বাঙালি জাতিটি অবলুপ্ত হয়ে যাবে, যদি এই জাতির কয়েকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব-স্থানাঙ্ককে রক্ষা না করা হয়। কিন্তু রক্ষা তো দূরস্থান, আমাদের তো বেশিরভাগেরই ন্যূনতম ধারণা নেই বাঙালি আইডেন্টিটি সম্পর্কে।
গোয়ার গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এজন্য বাঙালির সম্পর্ক বিশেষভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। আরপোরা নামক একটা জায়গা, আঞ্জুনা থেকে বেশি দূর নয়, সেখানে নাথযোগী চৌরঙ্গীনাথের মন্দির। চৌরঙ্গীনাথের একটি মূর্তি, কালো পাথরে খোদাই করা, দক্ষিণী রীতিতে। মন্দিরটার বর্তমান স্ট্রাকচার একেবারেই পুরোনো নয়, কিন্তু মূর্তিটি পুরোনো সন্দেহ নেই।
পালযুগেই মাইগ্রেশনটা হয়েছিল কি না, কে জানে। পালরাজ্যের রাজকুমার টার্নড অ্যাসেটিক চৌরঙ্গীনাথের আশ্রম ছিল কলকাতায়, আজকে যেখানে চৌরঙ্গী। তাঁর মন্দির গোয়ায় কিভাবে তৈরি হল?
নদী ও সমুদ্রের কাছাকাছি থাকা বাঙালির পুরোনো অভ্যেস। গোয়ার বণিকরাও বলেন যে ওঁরাও গৌড় থেকে গেছিলেন।
দেবপালের দিগ্বিজয় অভিযান গোয়া-কর্ণাটক সীমান্তের গোকর্ণ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল, এবং গোকর্ণ তীর্থে তর্পণ করেছিলেন সম্রাট দেবপাল। সেনদের পূর্বপুরুষ কর্ণাটক আর গোয়ার লাগোয়া অঞ্চল থেকেই এসেছিলেন। বাঙালির সঙ্গে এই অঞ্চলের যোগসূত্র তো আছেই।
বাঙালি যদি আবার উদ্বাস্তু হয়, এবার অবশ্য নদী পাওয়া বেশ কঠিন হবে।