“নেশাগ্রস্ত বাঙ্গালী”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
শোনা যায় দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল খবরের কাগজ পড়তেন না। কারন হিসাবে তিনি বলেছিলেন, “খবরের কাগজে থাকে মুলত দুই ধরনের খবর। এক বিভিন্ন স্থানে ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে, যার ওপরে আমার কোনো নিয়ন্ত্রন নেই বা আমার কিছু করার নেই মন খারাপ বা আনন্দিত হওয়া ছাড়া। এর কোনোটাই আমি চাই না। দ্বিতীয়ত, নানা সাংবাদিক এবং সম্পাদক নানা নিজস্ব মন্তব্য করেন যেটা প্রায়শই সঠিক হয় না, আর আমি অন্যের মত শুনে নিজের কর্তব্য কর্ম বা ভাবনা চিন্তা স্থির করি না। এটা এক প্রকার মানসিক দাসত্ব।“
জ্ঞানী ব্যাক্তিরা নিজের বুদ্ধি এবং বিবেক নিয়ে চলেন। তারা ঘটনার বিচার করে সেই মতো নিজস্ব ভাবনা চিন্তা করেন এবং সেই মতো নিজ কর্ম পদ্ধতি ঠিক করেন। এদের চিন্তা ভাবনা হয় মৌলিক এবং তারা প্রগতিশীল মানুষ বলে পরিচিত হন।
মানুষের বুদ্ধি সঠিক ভাবে কাজ করেনা মানুষ যখন নেশাগ্রস্থ থাকে। মানুষের নেশা বহু প্রকারের; নিয়মিত সোম রস পান করা, গাঁজা, ভাং, আফিমের প্রভাবে বুঁদ হয়ে থাকা, চব্য চোস্য লেয্য পেয় করে খাওয়া এবং আরো নানা প্রকারের আদিম প্রবৃত্তির ভোগ লিপ্সা, রেসের মাঠে ঘোড়া দৌড় করা, লটারীর টিকিট কেনা থেকে হাল আমলের ফোনে বা ল্যাপটপে পর্নগ্রাফি দেখা, অর্থের নেশা, প্রগতিশীলতার নামে বৈদেশিক রাজনৈতিক বা ধর্ম মত গ্রহন শুধু নয় তা প্রতিষ্ঠিত করতে জীবন প্রনিপাত করা, নিজের দেশের সব কিছুকে হেয় প্রতিপন্ন করার এক অদম্য চাহিদা, ক্ষমতার নেশা, কেউ না শুনতে চাইলেও বকে যাওয়া, মিথ্যে কথা বলে নিজেকে জাহির করা ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য নেশা আছে। এর কোনটাতে একবার আসক্ত হয়ে গেলেই মানুষ নেশাগ্রস্থ হয় এবং তার বুদ্ধি লোপ পায়। বুদ্ধি লোপ পেলে মানুষের সার্বিক ধংস ছাড়া আর কিছুই হয় না। “বুদ্ধিনাশাৎ প্রনশ্যতি” (গীতা- ২য় অধ্যায় ৬৩ নং শ্লোক)
এক সময় আমাদের বাঙ্গালী প্রগতিশীল বলে পরিচিত ছিলেন। অনেক প্রাতস্মরনীয় মনিষী এই বাংলায় জন্মেছেন। তারা ছিলেন মুক্ত চিন্তার মানুষ। কোন বিশেষ মত বা পথ তারা অনুকরন করতেন না করেন নি।
আমার জ্ঞান বুদ্ধিতে যা বলে, বাঙ্গালী প্রথম অনুকরন করা শিখলো বৃটিশ আমলে। রাত হলে সোম রস পান করে নানা রকম আনন্দ ফুর্তির পরিকল্পনা আগে অল্প স্বল্প থাকলেও প্রবাসী বৃটিশ অফিসার দের ব্যাঙ্কোয়েট হলে যাতায়াত করতে শুরু করার পর এই প্রবনতা বেড়ে গেলো । নব্য অভিজাত শেনী, ব্রাহ্মনত্ব-(প্রকৃত ভাবে জ্ঞান তপস্বী) ছেড়ে যারা বৃটিশত্ব ধরলেন, তারা নিজেদের পোষাক আশাক এমনকি রান্না ঘরের মধ্যেও বৃটিশ খাদ্য ব্যাবস্থা চালু করে দিলেন। কেউ কেউ আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে নতুন এক ধর্ম মত (ব্রাহ্ম) চালূ করে দিলেন। সেই শুরু হলো বাঙ্গালীর মধ্যে খেয়ো খেয়ি।
কিছুদিন চললো বেশ ভালোই, বিশেষ করে ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ আন্দোলনের সময় থেকে বাঙ্গালী একটু আবার নিজস্ব ভাবে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করলো, এক সংগে লড়লো।
কিন্তু নেশা করা যাদের রক্তে তারা কি করে নেশা ছাড়া থাকতে পারে??? রাশিয়ায় ‘বলশেভিক আন্দোলন’ শুরু হতেই কিছু বুদ্ধিমান বাঙ্গালী খবর পেয়ে ছুটলেন সেই রাশিয়ায়, নিয়ে এলেন এক নতুন রাজনৈতিক মত। সেই মত বা পথ আমাদের প্রাচীন ধর্ম সংষ্কৃতির দেশে চলে কিনা তা না দেখে বুঝেই শুরু হয়ে গেলো নেশা কামী (যারা নেশা না করলেও নেশার প্রতি আকর্ষন আছে) দের নতুন ভাবনা চিন্তা ,সেই বিদেশীদের অনুকরন।
সেই থেকে চলছে প্রগতিশীলতার নামে ‘নেশাগ্রস্থ এক শ্রেনীর বুদ্ধিজীবি’দের ওই বিদেশী (যা কিনা সেই বিদেশেই আজ সমাজের আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলেছে) মত কে প্রতিষ্ঠিত করতে ছল চাতুরি, জোর জুলুম, মার ধর, সব কিছু ভেঙ্গে দিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে, এক নতুন সমাজ ব্যাবস্থার মৌতাতের স্বপ্ন। সেই মৌতাতের স্বপ্ন সফল করতে নিজের দেশটাকে ১৭ ভাগে ভাগ করতে আপত্তি নেই, দেশ বিরোধি অপশক্তির সংগে হাত মেলানো এক মহৎ কাজ বলে এরা মনে করে। সে জন্য নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা লাটে তুলে দিয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে আদিম লালাষার সব ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
বাঙ্গালীর তিন তিনটে প্রজন্ম আজ কোন না কোন কিছুর প্রতি অপ্রতিরোধ্য ভাবে “নেশা গ্রস্থ”। বর্তমানে চলছে যেন তেন প্রকারেন ক্ষমতার আসনে থেকে লুটে পুটে খাওয়ার নেশা। “সততার প্রতীক” পরিবর্তিত হয়ে গেছে, দাবী করা হচ্ছে “উন্নয়নের প্রতীক”। শিল্প হীন, কর্ম সংস্থানের উপায়বিহীন দেশে আজ বেকারত্বের সংখ্যা কমানোর কোন উদ্যোগ নেই। বঙ্গ সংষ্কৃতির পিন্ডি চটকে এক অপসংষ্কৃতির ঢক্কা নিনাদে নিরীহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করা হয়েছে। কিন্তু সার্বিক উন্নয়ন নাকি হচ্ছে সীমাহীন, আর বাঙ্গালী সেই কথার নেশায় মশগুল ।
তাই ভাবি ‘নেশাখোর’ আর কাকে বলে ?????????